জাতীয়

আরাভকে ফেরাতে তিন দেশের বোঝাপড়া দরকার

সাজ্জাদ মাহমুদ খান

ঢাকা, ২৫ মার্চ – পুলিশ হত্যা মামলার আসামি রবিউল ইসলাম ওরফে আরাভ খান এখন আন্তর্জাতিকভাবে ‘মোস্ট ওয়ান্টেড’ আসামি। গতকাল শুক্রবার আন্তর্জাতিক পুলিশ সংস্থা ইন্টারপোল বাংলাদেশি নাগরিক হিসেবে আরাভ খানের বিরুদ্ধে রেড নোটিশ ইস্যু করেছে। এর ফলে আরাভ খানের দেশে ফেরানোর উদ্যোগ এক ধাপ এগিয়ে গেল বলে মনে করছেন পুলিশ কর্মকর্তারা।

তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আরাভ খানের দেশে ফেরানো নির্ভর করছে বাংলাদেশ, ভারত ও দুবাই সরকারের মধ্যকার সম্পর্ক বা বোঝাপড়ার ওপর। তাকে দেশে ফেরাতে ভারতীয় পাসপোর্টও বাতিল করতে হবে। দুবাই সরকার আরাভ খানকে বাংলাদেশের কাছে দিতে রাজি হলে তাকে সেখানে গ্রেপ্তার করতে হবে। এরপর বাংলাদেশের দূতাবাস থেকে ইস্যু করা ট্রাভেল পাসের মাধ্যমে দেশে ফেরানো যাবে এই অপরাধীকে। বর্তমানে আরাভ খান দুবাই সরকারের নজরদারিতে রয়েছেন।

শুধু আরাভ নয়, ইন্টারপোলের রেড নোটিশের তালিকায় থাকা আরও দুই বাংলাদেশি দুবাইয়ে পলাতক জীবনযাপন করছেন। এরা হলেন- মালিবাগের হোটেল সানরাইজে দুই পুলিশ হত্যা মামলার আসামি ও ঢাকার শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসান আহমেদ জিসান এবং আতাউর রহমান মাহমুদ চৌধুরী। দীর্ঘদিন ধরে তাদের বিরুদ্ধে রেড নোটিশ ঝুলে থাকলেও ফিরিয়ে আনতে পারেনি বাংলাদেশ। কয়েকবার তাদের ফিরিয়ে আনতে তোড়জোড় করা হলেও শেষ পর্যন্ত ভেস্তে গেছে। ভারতীয় পাসপোর্টে দুবাই যাওয়া আরাভ খানকেও দেশে ফেরানো জটিল ও সময়সাপেক্ষ বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

গতকাল শুক্রবার ইন্টারপোলের ওয়েবসাইটের রেড নোটিশের তালিকায় আরাভ খানের নাম লেখা রয়েছে রবিউল ইসলাম ওরফে রবিউল। এতে তার ছবি, লিঙ্গ, জন্মস্থান, জন্মতারিখ, বয়স, জাতীয়তা ও অভিযোগের তথ্য রয়েছে। রেড নোটিশে রবিউলের জাতীয়তা লেখা হয়েছে ‘বাংলাদেশি’। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ হিসেবে লেখা আছেÑ ‘হত্যা’। বাংলাদেশের অনুরোধে এই নোটিশ জারি করা হয়েছে বলে ইন্টারপোলের ওয়েবসাইটে উল্লেখ করা হয়েছে।

সংশ্লিষ্ট তদন্ত কর্মকর্তারা জানান, দুবাইয়ে আরাভ গ্রেপ্তার হলে উচ্চপর্যায়ের কূটনৈতিক যোগাযোগের মাধ্যমে তাকে দেশে ফেরানো সম্ভব। যদি তার নামে ইস্যু করা ভারতীয় পাসপোর্ট বাতিল হয়, তাহলে ফেরানোর প্রক্রিয়া সহজ হবে।

আরাভ খানকে দেশে ফিরিয়ে আনার প্রক্রিয়া হিসেবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পলাতক যে কোনো আসামিকে কূটনৈতিক ও পুশব্যাকের (কোনো দেশ নিজেদের উদ্যোগেই যদি ফেরত পাঠায়) মাধ্যমে দেশে ফেরত আনা যায়। কূটনৈতিক প্রক্রিয়ায় বহিঃসমর্পণ চুক্তি না থাকলেও অপরাধীকে ফেরানো যায়। তবে চুক্তি থাকলে দুই দেশের মধ্যে এক ধরনের বাধ্যবাধকতা থাকে। এতে অপরাধীকে ফিরিয়ে আনা তুলনামূলক সহজ। চুক্তি না থাকলে অপরাধী ফিরিয়ে আনার বিষয়টি দুই দেশের পারস্পরিক সম্পর্কের ওপর নির্ভর করে। আরাভ খানকে ফিরিয়ে আনার ব্যাপারেও দুই দেশের পারস্পরিক সম্মতি লাগবে। এ ক্ষেত্রে প্রথম বাধা দুবাইয়ের বর্তমান নীতি। উদার বাণিজ্য নীতির কারণে দুবাই বিভিন্ন দেশের ধনীদের স্বর্গরাজ্য। আরাভ খানকে ফিরিয়ে দিলে অন্য ব্যবসায়ী এবং অবৈধ অর্থের মালিকদের মধ্যে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।

সাম্প্রতিক সময়ে দুবাই কোনো আসামিকে বাংলাদেশে ফেরত দেয়নি। তাই আরাভ খানকে ফিরিয়ে দেওয়ার ব্যাপারে তারা ইতিবাচক মনোভাব নাও দেখাতে পারে। এ ছাড়া তিনি দুবাই গেছেন ভারতের পাসপোর্টে। ভারত যদি আরাভের পাসপোর্টকে বাতিল ঘোষণা করে, তাহলে এই ঘটনার সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের শাস্তি দিতে হবে। এ ছাড়া ভারতে এমন ভুয়া পাসপোর্ট যে তৈরি করা হয়, সেটা প্রকাশ্যে চলে আসবে। এতে করে বিশে^ ভারতের ভাবমূর্তির নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। আরাভকে ফিরিয়ে আনতে দুবাই ও ভারত কতটুকু সাড়া দেবে, সেটাও কূটনৈতিক তৎপরতার ওপর নির্ভর করছে।

তবে বহিঃসমর্পণ চুক্তির বিষয়ে বিশেষজ্ঞ, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব এবং জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. কামাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘সংযুক্ত আরব আমিরাতের সঙ্গে আমাদের বহিঃসমর্পণ চুক্তি নেই। তবে তাদের সঙ্গে আমাদের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রয়েছে। এই সম্পর্কের খাতিরে তারা আরাভকে আমাদের দেশে পাঠিয়ে দিতে পারে। তাকে ফেরানো নির্ভর করছে বাংলাদেশের সঙ্গে দুবাই ও ভারতের সম্পর্কের ওপর।

দুবাইয়ে বাইরের প্রচুর বিনিয়োগ আছে। আরাভকে ফেরত দিলে বিনিয়োগে প্রভাব পড়ার বিষয়টি দুবাই ভাববে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এমনটা তারা ভাবতেও পারে। তবে আরাভ তো শুধু বিনিয়োগকারী না। তিনি একটি খুনের মামলার আসামি। একজন আসামিকে রেখে তাদের কী লাভ, সেটাও ভাবতে হবে।’

আরাভের ভারতীয় পাসপোর্টের ব্যাপারে তিনি বলেন, ‘ভারতীয় পাসপোর্ট যে ভুয়াভাবে করছে, সেটা বোঝা যাচ্ছে। এখন তার ভারতীয় পাসপোর্ট বাতিল হওয়া দরকার। কারণ তার হাতে একটি পাসপোর্ট তো এখন আছে। সুতরাং তার পাসপোর্ট বাতিল হওয়ার পর বাংলাদেশের দূতাবাস থেকে একটি ট্রাভেল পাস দেবে। কারণ ভারতীয় পাসপোর্ট বাতিল হওয়ার পর ট্রাভেল করতে গেলে তো একটা ডকুমেন্ট লাগবে। ইতোমধ্যে ভারতীয় পাসপোর্ট বাতিল করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে। আর ভারতের সঙ্গে আমাদের চুক্তি আছে ‘মিচুয়াল লিগ্যাল অ্যাসিসট্যান্স ক্রিমিনাল ম্যাটার্স’। এখন কোনো বাংলাদেশি অপরাধী যদি ভারতে থাকে, তাহলে তার জন্য তারা সহযোগিতা করবে। এ ক্ষেত্রেও ভারত আমাদের সহযোগিতা করবে।

এদিকে ইন্টারপোলের পাশাপাশি ভারতকে আরাভের বিষয়ে নথিপত্র সরবরাহ করেছে বাংলাদেশ। আরাভ ও তার মা-বাবার বাংলাদেশি নাগরিকত্বের সনদের অনুলিপি গতকাল কূটনৈতিক চ্যানেলে ভারতে পাঠানো হয়েছে।

পুলিশ সদর দপ্তরের মুখপাত্র এআইজি মনজুর রহমান বলেন, আরাভকে দেশে ফেরাতে ইন্টারপোলের কাছে বাংলাদেশ যে আবেদন করেছে, তা গ্রহণের পর রেড নোটিশের তালিকায় তার নাম উঠেছে। এখন বাকি কাজ আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে হবে।

জানা গেছে, ইন্টারপোল নিজে কাউকে গ্রেপ্তার করে না। সদস্য রাষ্ট্রের পুলিশকে অনুরোধ জানায়, ওই অপরাধীকে যেন আইনের আওতায় নেওয়া হয়। তখন ওই দেশের পুলিশ তাদের আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নিয়ে থাকে।

দুবাইয়ের স্থানীয় সূত্র বলছে, দুদিন ধরে আরাভ আত্মগোপনে রয়েছেন। ইন্টারপোল তার ব্যাপারে কার্যক্রম শুরু করেছেÑ এমন খবর প্রচারের পর থেকে প্রকাশ্যে তাকে দেখা যায়নি। নিজের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানেও তাকে দেখা যায়নি। গত বুধবারের পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কোনো স্ট্যাটাসও দেননি তিনি।

পুলিশ ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, আরাভ ভারতের যে ঠিকানা ব্যবহার করে পাসপোর্ট নিয়েছেন এবং যে কার্যালয় থেকে পাসপোর্ট নিয়েছেন, সে বিষয়েও তারা খোঁজখবর নিচ্ছে। আশা করা যায়, শিগগিরই আরাভ খানের ভারতীয় পাসপোর্ট বাতিলে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

পুলিশের চিঠিতে বলা হয়েছে, অভিযুক্ত আরাভ খান নিজের পরিচয় গোপন রেখে কোনোভাবে ভারতীয় পাসপোর্ট সংগ্রহ করেন। ওই পাসপোর্ট নিয়ে তিনি সংযুক্ত আরব আমিরাতে গিয়েছেন। এই প্রেক্ষাপটে যত দ্রুত সম্ভব আরাভ খানের ভারতীয় পাসপোর্ট বাতিলের অনুরোধ করা হয়েছে চিঠিতে।

ইন্টারপোলের আট ধরনের নোটিশের মধ্যে রেড নোটিশ জারির অর্থ হলোÑ ওই ব্যক্তিকে সংশ্লিষ্ট দেশের সরকার ও বিচার বিভাগ বিচারের মুখোমুখি করতে অথবা দণ্ড কার্যকর করার জন্য খুঁজছে। সদস্য দেশগুলো ইন্টারপোলের মাধ্যমে পলাতক আসামি সম্পর্কে তথ্য বিনিময় করতে পারে। বাংলাদেশ সরকারের সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে এবং সে দেশের সরকার তা খতিয়ে দেখে সন্তুষ্ট হলে তাকে গ্রেপ্তার করতে পারে। অবশ্য সে ক্ষেত্রে সে দেশের সরকারই তার বিচার শুরু করবে। আর তাকে বাংলাদেশে ফিরিয়ে এনে বিচারের মুখোমুখি করতে হলে আসামি প্রত্যর্পণ চুক্তির প্রয়োজন হবে। বাংলাদেশ ও আরব আমিরাতের মধ্যে এই চুক্তি নেই। ফলে রেড নোটিশ জারি হলেও রবিউল ওরফে আরাভকে ফেরাতে হলে কূটনৈতিক তৎপরতার ওপর জোর দিতে হবে।

পুলিশ সদর দপ্তরের এনসিবি শাখা সূত্রে জানা গেছে, রবিউলের জন্ম বাগেরহাটের চিতলমারীতে মামার বাড়িতে। সেখানেই তার বেড়ে ওঠা। তার জাতীয় পরিচয়পত্রে স্থায়ী ঠিকানা হিসেবে বাগেরহাট উল্লেখ করা হয়েছে। রেড নোটিশ জারি করতে বাংলাদেশ থেকে পাঠানো আবেদনে রবিউলের জাতীয় পরিচয়পত্রের বাংলা ও ইংরেজি কপি সংযুক্ত করে দেওয়া হয়েছিল। তাই তার জাতীয় পরিচয়পত্র অনুযায়ীই ইন্টারপোলের নোটিশে ঠিকানা উল্লেখ করা হয়েছে।

জাতীয় পরিচয়পত্র অনুযায়ী নির্বাচন কমিশন (ইসি) থেকে জানানো হয়, পুলিশ কর্মকর্তা হত্যা মামলার আসামি আরাভ খান মামলার এজাহারভুক্ত রবিউল ইসলাম নামেই জাতীয় পরিচয়পত্র নিয়েছিলেন। ঠিকানা হিসেবে বাগেরহাট জেলাও উল্লেখ করেছিলেন।

এনআইডি অনুযায়ী, রবিউল ইসলামের জন্ম ১৯৮৭ সালের ১৯ আগস্ট। পড়ালেখা করেছেন মাধ্যমিক পর্যন্ত। রবিউলের বাবা মতিউর রহমান, মাতা লাখি ও স্ত্রীর নাম রুমা। এনআইডিতে আরাভ খান স্থায়ী ও বর্তমান ঠিকানা উল্লেখ করেছেন বাগেরহাট জেলার মোল্লারহাট উপজেলার কোদলিয়া ইউনিয়নের আড়ুয়াডিহি গ্রাম।

সূত্র: আমাদের সময়
এম ইউ/২৫ মার্চ ২০২৩

Back to top button