জাতীয়

চার মিউচুয়াল ফান্ডে ভয়াবহ জালিয়াতি: আত্মসাৎ ২৩৫ কোটি টাকা

মনির হোসেন

ঢাকা, ২৪ মার্চ – জালিয়াতির মাধ্যমে শেয়ারবাজারে ৪ মিউচুয়াল ফান্ড থেকে ২৩৫ কোটি ১২ লাখ টাকা সরিয়ে নিয়েছে সম্পদ ব্যবস্থাপনা কোম্পানি ইউনিভার্সাল ফাইন্যান্সিয়াল সলিউশন (ইউএফএস)। এরমধ্যে ইউএফএসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সৈয়দ হামজা আলমগীরের নেতৃত্বে ১৭০ কোটি ৬৯ লাখ টাকা সরাসরি আত্মসাতের প্রমাণ মিলেছে। এই টাকা নিয়ে ১৩ অক্টোবর তিনি দুবাই পালিয়েছেন।

এ বিষয়ে ১ জানুয়ারি প্রতিবেদন প্রকাশ হলে নড়েচড়ে বসে সংশ্লিষ্ট সংস্থা। স্বতপ্রণোদিত হয়ে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ও বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) প্রতি রুল জারি করেন সর্বোচ্চ আদালত। সর্বশেষ বিএসইসির তদন্ত রিপোর্টে ঘটনার সত্যতা মিলেছে। এ ঘটনায় সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে বৃহস্পতিবার বেশকিছু পদক্ষেপের সিদ্ধান্ত নিয়েছে কমিশন। এসব পদক্ষেপের মধ্যে ইউএফএসের লাইসেন্স বাতিল, কোম্পানির এমডিসহ সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে মামলা, অডিট কোম্পানি নিষিদ্ধ করার বিষয়টি আছে। এছাড়া সরকারি বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশের (আইসিবি) বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।

ইউএফএস একটি সম্পদ ব্যবস্থাপনা (অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট) কোম্পানি। নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির অনুমতি নিয়ে এই কোম্পানি বিভিন্ন গ্রাহকের কাছ থেকে টাকা সংগ্রহ করে তালিকাভুক্ত কোম্পানির শেয়ারে বিনিয়োগ করে। এই প্রক্রিয়াকে শেয়ারবাজারের পরিভাষায় মিউচুয়াল ফান্ড বলা হয়। নিয়ম অনুসারে মিউচুয়াল ফান্ডে বিনিয়োগে কোনো অনিয়ম হলে, ট্রাস্টি ও কাস্টডিয়ান প্রতিষ্ঠানকে নিয়ন্ত্রক সংস্থার কাছে রিপোর্ট করতে হয়। কিন্তু ট্রাস্টি ও কাস্টডিয়ানের সামনেই এই জালিয়াতি করেছে ইউএফএস। ভুয়া সম্পদ এবং অস্তিত্বহীন ব্যাংক ব্যালেন্স দেখিয়েছে।

বিএসইসির তদন্ত রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়, ৫টি মিউচুয়াল ফান্ড পরিচালনা করছে ইউএফএস। এসব তহবিলের আকার ৪৪০ কোটি টাকা। ইউএফএসের ফান্ডগুলোর মধ্যে-আইবিবিএল ২শ কোটি টাকা, ব্যাংক এশিয়া ১০০ কোটি, পপুলার লাইফ ৮০ কোটি, পদ্মা লাইফ ৫০ কোটি এবং প্রগতি লাইফ ইউনিট ফান্ডের ১০ কোটি টাকার তহবিল পরিচালনা করছে এই প্রতিষ্ঠান। এছাড়াও সানলাইফ ইউনিট ফান্ডের ১০ কোটি এবং ইউএফএস ইউনিট ফান্ডের ১০ কোটি টাকার তহবিল প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। এরমধ্যে ১৭০ কোটি ৬৯ লাখ টাকা আত্মসাৎ করেছে কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ হামজা আলমগীরের নেতৃত্বাধীন সিন্ডিকেট। এরমধ্যে নিজের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ করেছে ৫৮ কোটি ৯০ লাখ, এফডিআর থেকে তুলে নিয়েছে ৪৭ কোটি ৯২ লাখ এবং তালিকাভুক্ত কোম্পানিতে থাকা ৬৩ কোটি ৮৭ লাখ টাকার শেয়ার বিক্রি করেছে। এর বাইরে আরও ৬৪ কোটি ৫২ লাখ টাকার সুবিধা নিয়েছে চক্রটি। এই মোট ২৩৫ কোটি ১২ লাখ টাকার আত্মসাতের প্রমাণ মিলেছে। এরসঙ্গে জড়িত রয়েছেন কোম্পানির প্রধান বিনিয়োগ কর্মকর্তা মো. মমিনুল হক, ম্যানেজার সাকিব আল ফারুক, প্রধান পরিচালন কর্মকর্তা হাফিজুর রহমান রাজিব, উপদেষ্টা সুলতানুল আবেদীন মোল্লা এবং মো. রফিকুল ইসলাম সিদ্দিকী। এছাড়াও ফখরুল আলম নামে আরও একজনের সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে। তবে তিনি কাছে দাবি করেন, ইউএফএস থেকে কিছু টাকা ঋণ নিয়েছেন। এর বাইরে তার কোনো সম্পৃক্ততা নেই। অন্যদিকে এই চার মিউচুয়াল ফান্ডের মাধ্যমে শুধু কাটালি টেক্সটাইলের শেয়ার কিনেছে ইউএফএস।

মিউচুয়াল ফান্ডের টাকায় কয়েকটি প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দিয়েছে হামজা আলমগীর। এগুলো হলো-আরআই এন্টারপ্রাইজ, নেত্রকোনা এক্সেসরিস লিমিটেড, ভেনগার্ড ট্রেডার্স লিমিটেড এবং তানজিল ফ্যাশন লিমিটেড, স্পেট্রে কমোডিটি, নিটওয়্যার ক্রিয়েটর, ম্যাক্স সিকিউর লিমিটেড এবং মাল্টি ম্যাক্স ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড। সব প্রতিষ্ঠানের মালিকানায় হামজা আলমগীর নিজে এবং তার নিকটাত্মীয়রা। এছাড়াও এর সঙ্গে জড়িত রয়েছেন কোম্পানির উপদেষ্টা রফিকুল ইসলাম সিদ্দিকী। এছাড়াও খুলনা অঞ্চলের সরকারের একজন প্রভাবশালী সংসদ-সদস্যের সম্পৃক্ততা মিলেছে। স্বাভাবিকভাবে এসব বিষয়ে অডিটে ধরা পড়ার কথা। কিন্তু দুটি অডিট কোম্পানি আহমেদ জাকের অ্যান্ড কোং এবং রহমান মোস্তফা আলম অ্যান্ড কোং এসব ভুয়া আর্থিক রিপোর্টের বৈধতা দিয়েছে।

এ বিষয়ে ১ জানুয়ারি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এরপরই নড়েচড়ে বসে দেশের নীতিনির্ধারকরা। এ ব্যাপারে হাইকোর্ট রুল জারি করেন। এ ব্যাপারে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য বিএসইসিকে চিঠি দিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়। এছাড়াও আলাদা তদন্ত কমিটি গঠন করে আইসিবি। এরপর তদন্ত রিপোর্টের আলোকে ২০৭ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে ইতোমধ্যে পল্টন থানায় মামলা করেছে আইসিবি। এছাড়াও এর সঙ্গে জড়িত ১৫ জনের ব্যাংক হিসাব স্থগিত করে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইউনিট (বিএফআইইউ)। এরমধ্যে রয়েছে-ইউনিভার্সাল ফাইন্যান্সিয়াল সলিউশন, সৈয়দ হামজা আলমগীর, ইশরাত আলমগীর, সৈয়দা শেহরীন হুসাইন, সৈয়দ আলমগীর ফারুক চৌধুরী, মাহিদ হক, তারেক মাসুদ খান, আলিয়া হক আলমগীর, মোহাম্মদ জাকির হোসেন, সৈয়দা মেহরীন রহমান, মোহাম্মদ উম্মে সালমা সোহানা, ইউএফএস পপুলার লাইফ ইউনিট ফান্ড, ইউএফএস ব্যাংক এশিয়া ইউনিট ফান্ড এবং ইউএফএস পদ্মা লাইফ ইসলামিক ফান্ড।

বিএসইসির তদন্ত রিপোর্টের আলোকে কমিশন সভায় বৃহস্পতিবার বেশকিছু সিদ্ধান্ত হয়। এরমধ্যে-ইউএফএসের লাইসেন্স বাতিলের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এছাড়াও ফান্ডের ট্রাস্টি হিসাবে ইনভেসটমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশ (আইসিবি), সম্পদ ব্যবস্থাপনা কোম্পানির পরিচালক, কর্মকর্তা, প্রতিষ্ঠান হতে পাচারকৃত তহবিল, অপরাধলব্ধ আয়, অবৈধ ব্যয় অনাদায়কৃত অর্থ পুনরুদ্ধার করে বিশেষ নিরীক্ষামূলক ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এদের বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিং আইনে ব্যবস্থা নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। একইসঙ্গে ফান্ডের ট্রাস্টি এবং কাস্টডিয়ান হিসাবে দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতার দায়ে আইসিবির ট্রাস্টি এবং কাস্টডিয়ান বিভাগে তৎকালীন কর্মরত কর্মকর্তাদের কেন শাস্তি আরোপ করা হবে না এ মর্মে নোটিশ জারি হচ্ছে। অনিয়মে সহায়তা করায় নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠান আহমেদ জাকের অ্যান্ড কোং ও রহমান মোস্তফা আলম অ্যান্ড কোং শেয়ারবাজারে নিষিদ্ধ করা হয়েছে।

জানতে চাইলে বিএসইসি’র নির্বাহী পরিচালক মোহাম্মদ রেজাউল করিম বৃহস্পতিবার বলেন, তদন্তের আলোকেই সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছে কমিশন। আগামীতে বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ রক্ষায়, যে কোনো কঠোর পদক্ষেপ নেবে বিএসইসি।

সূত্র: যুগান্তর
এম ইউ/২৪ মার্চ ২০২৩

Back to top button