জাতীয়

বিদেশিদের কাছে ধরনা নালিশ আর নালিশ

মসিউর রহমান খান ও তাসনিম মহসিন

ঢাকা, ২৪ মার্চ – দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক সংকট নিয়ে কূটনীতিকপাড়া ফের সরগরম। জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে আবারও শুরু হয়েছে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি নেতাদের দৌড়ঝাঁপ। বিদেশি শক্তির কাছে একে অপরের বিরুদ্ধে ‘নালিশ’ করে আসছেন দুই দলের নেতারা। নিজেরা বিদেশিদের কাছে ছুটলেও বিরোধী পক্ষের বিরুদ্ধে ‘ধরনা দিয়ে ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন’ করার অভিযোগ আনছেন।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, এ কার্যক্রমে প্রধান দু’দলের কেউই পিছিয়ে নেই। অতীতেও জাতিসংঘসহ নানা বিদেশি শক্তির মধ্যস্থতায় আওয়ামী লীগ ও বিএনপিকে বসানো হয় আলোচনার টেবিলে। তবে তাতে দেখা মেলেনি আলোর রেখার। নিজেদের মধ্যে সন্দেহ ও অবিশ্বাস দূর করতে না পারলে বিদেশিরা কোনো উপায় বাতলে দিতে পারবেন না। এতে বহির্বিশ্বে উল্টো দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হতেই থাকবে।

কখনও ভোজসভা, আবার কখনও বৈঠকের মাধ্যমে সাম্প্রতিক সময়ে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি নেতাদের খুব কাছাকাছি পান কূটনীতিকরা। এসব বৈঠকে বিদেশিরা আগামী সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে রাজনৈতিক নেতাদের কাছে দেশের বর্তমান পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করেন। কূটনীতিকদের ভাষ্য, বাংলাদেশের স্থিতিশীলতা, জবাবদিহিতা, আইনের শাসন, মানবাধিকার, গণতন্ত্র এবং রাজনৈতিক পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করে ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিয়োগের সিদ্ধান্তগুলো প্রস্তুত করা হয়। ফলে ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিয়োগের সিদ্ধান্তের আগে দেশের আগামী ভবিষ্যৎ কী হতে পারে, এর একটি বিশ্লেষণ করা হয়। তাই বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি জানাটা বন্ধু রাষ্ট্রগুলোর জন্য জরুরি।

তবে বাংলাদেশের স্থিতিশীলতা, জবাবদিহি, আইনের শাসন, মানবাধিকার, গণতন্ত্র এবং রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে কূটনীতিকরা জানতে চাইলে বৈঠকে অংশ নেওয়া দলগুলো একে অপরের বিরুদ্ধে নালিশ করে আসে। বর্তমান সংকট কাটিয়ে দেশ কীভাবে এগিয়ে যাবে, সে পরিকল্পনা জানানোর বদলে কোন দল কীভাবে দেশের গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রাকে টেনে ধরেছে, কোন দল নির্বাচনের নামে প্রহসন করেছে, কোন দল কতটা গণতান্ত্রিক, এক দল অন্য দলের ওপর কীভাবে নির্যাতন ও নিপীড়ন করেছে, কোন দল কতটা সন্ত্রাসে জড়িত– এমন তথ্য বিদেশিদের জানিয়ে আসে বাংলাদেশে দীর্ঘ সময় সরকারে থাকা দল দুটি।

গত বুধবার আওয়ামী লীগ নেতাদের সম্মানে রাজধানীর গুলশানে মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার ডি হাসের বাসভবনে মধ্যাহ্নভোজের আয়োজন করা হয়। এতে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের নেতৃত্বে অংশ নেন দলের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ফারুক খান, আন্তর্জাতিক সম্পাদক ড. শাম্মী আহমেদ, তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক ড. সেলিম মাহমুদ, দপ্তর সম্পাদক ব্যারিস্টার বিপ্লব বড়ুয়া এবং কার্যনির্বাহী সংসদের সদস্য অধ্যাপক মোহাম্মদ আলী আরাফাত।

এর আগে ১৬ মার্চ ঢাকার ভারতীয় হাইকমিশনার প্রণয় কুমার ভার্মার আমন্ত্রণে তাঁর বাসায় নৈশভোজে অংশ নেয় বিএনপির উচ্চ পর্যায়ের একটি প্রতিনিধি দল। এ দলে ছিলেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল আউয়াল মিন্টু ও সাংগঠনিক সম্পাদক শামা ওবায়েদ।

১৩ মার্চ ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) রাষ্ট্রদূতদের সঙ্গে রুদ্ধদ্বার বৈঠকে অংশ নেন বিএনপি নেতারা। গুলশানের এবিসি হাউসে অনুষ্ঠিত ওই বৈঠকে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, সাংগঠনিক সম্পাদক শামা ওবায়েদ ও মানবাধিকার বিষয়ক সম্পাদক অ্যাডভোকেট আসাদুজ্জামান উপস্থিত ছিলেন।

আর গত ১৬ ফেব্রুয়ারি আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল রাজধানীর গুলশানে ইইউভুক্ত দেশগুলোর রাষ্ট্রদূতদের সঙ্গে বৈঠক করে। বৈঠকে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কাজী জাফরউল্লাহ, তথ্য ও গবেষণাবিষয়ক সম্পাদক ড. সেলিম মাহমুদ, দপ্তর সম্পাদক ব্যারিস্টার বিপ্লব বড়ুয়া এবং কার্যনির্বাহী সংসদের সদস্য অধ্যাপক মোহাম্মদ আলী আরাফাত উপস্থিত ছিলেন।

বিদেশিদের কাছে একে অপরের নামে নালিশ করাটাকে রাজনীতিবিদদের বাক স্বাধীনতা বলে উল্লেখ করেন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ ও বিএনপির বাক স্বাধীনতার বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে চাই না। তবে বড় দু’দলের এমন দ্বিমুখী আচরণ অগ্রহণযোগ্য। দেশের বড় দু’দলের মধ্যে সন্দেহ ও অবিশ্বাস এতটাই বেড়েছে, একে অপরের অস্তিত্বকে স্বীকার করতে চাইছে না। এমন পরিস্থিতিতে বিদেশি বন্ধু রাষ্ট্রের কেউই এ সমস্যার সমাধান দিতে পারবে না। তাঁর মতে, রাজনীতির দীর্ঘ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই বর্তমান এই অসহিষ্ণু পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। যদিও রাজনৈতিক নেতারা দাবি করেন, তাঁরা জনগণের জন্য রাজনীতি করছেন। এ দাবি সত্য হলে জনগণের প্রত্যাশা পূরণে তাঁদের সমঝোতায় আসতে হবে। পরস্পরের মধ্যে ভিন্ন মত থাকবে, তবে অন্যের মতকে মেনে নেওয়ার সংস্কৃতি গড়ে না উঠলে এ সমস্যার সমাধান হবে না।

পাল্টাপাল্টি দোষারোপের রাজনীতি নিয়ে জানতে চাইলে বিএনপির কূটনৈতিক উইংয়ের চেয়ারম্যান ও দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ক্ষমতাসীন দল সব সময় বিএনপিকে নালিশ পার্টি বলে কটাক্ষ করলেও তারাই নালিশ পার্টিতে পরিণত হয়েছে।
দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে বিদেশিদের কাছে যাওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, পুরো বিশ্ব এখন এক কেন্দ্রবিন্দুতে। এ কারণে গণতন্ত্রহীনতা, মানবাধিকার, আইনের শাসন, জনগণের ভোটাধিকার, বাক স্বাধীনতার মতো বিষয়গুলো কোনো রাষ্ট্রের একক বিষয় নয়। সবাই সবার ওপর নির্ভরশীল। এসব বিষয়ে উন্নয়ন সহযোগী কিংবা বন্ধুরাষ্ট্র তাদের মত তুলে ধরে। যেটাকে জনগণের পক্ষের অবস্থান হিসেবে ধরা হয়। যে মত সরকারের পক্ষে যায়, সেটাকে তারা গ্রহণ করলেও বিপক্ষে গেলে বিরুদ্ধাচরণ করে।

মার্কিন রাষ্ট্রদূতের বাসায় যাওয়াকে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হিসেবে দেখছেন কিনা– এর উত্তরে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল-আলম হানিফ বলেন, একজন ভদ্রলোকের বাসায় মধ্যাহ্নভোজের আমন্ত্রণে যাওয়াটা দোষের কিছু নয়। আওয়ামী লীগ কারও কাছে ধরনা দিতে যায়নি।

বিদ্যমান সংকট কাটানোর উপায় নিয়ে ঢাকার যুক্তরাজ্যের হাইকমিশনার রবার্ট সি ডিকসন বলেন, আন্তর্জাতিক নির্বাচনী পর্যবেক্ষক আসা এবং দলগুলোর মধ্যকার সংলাপের মধ্য দিয়ে শুরু হতে পারে যথাযথ নির্বাচনী সহায়ক পরিবেশ তৈরির কার্যক্রম, যাতে সব দল অংশ নিতে পারে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, বিদেশিরা আমাদের বিভাজনের রাজনীতির সুযোগ নেয়। বিদেশি কূটনীতিকদের তৎপরতায় এই দু’দলের বিভাজন মোটেই কমে না, বরং বিভিন্ন সময়ে তাদের নানা প্রতিবেদন প্রকাশের কারণে তা আরও বাড়ে। কূটনীতিকদের ঘিরে এই তৎপরতা আগেও হয়েছে। তাই অবাক হওয়ার কিছু নেই। তাদের তৎপরতায় কোনো ফল আসবে– এটা আশা করা যায় না।

অধ্যাপক ইমতিয়াজ আরও বলেন, এ দেশে পরিবর্তনের একমাত্র পথ হচ্ছে, যখন লাখ লাখ মানুষ রাস্তায় নামে। এ ছাড়া পরিবর্তনের কোনো সম্ভাবনা নেই। মানুষ রাস্তায় না নামলে আগের দুই নির্বাচনের মতোই আরেকটা নির্বাচন হয়ে যাবে। তিনি বলেন, এ দেশের মানুষ গণতন্ত্র বলতে বোঝে খাদ্য, বস্ত্র ও বাসস্থান। এগুলো না পেলেই তারা আন্দোলনমুখী হয়। জিনিসপত্রের দাম মানুষের নাগালের বাইরে গেলে তারা রাস্তায় নামতে পারে।

সূত্র: সমকাল
এম ইউ/২৪ মার্চ ২০২৩

Back to top button