ইংরেজরা মুসলমানদের হাত থেকে ভারতের শাসন ক্ষমতা নিয়েছিল তাই মুসলমানরা সহজে ইংরেজ শাসন মেনে নিতে পারেননি। মুসলমানদের শিক্ষিত শ্রেণি ছিলেন তখন আলেমরা। তারাই বিভিন্নভাবে ইংরেজকে প্রতিরোধ করার চেষ্টা করেছিলেন। ১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহ পর্যন্ত আলেমরাই বিভিন্নভাবে বিদ্রোহ করেছিলেন। ফকিরদের বিদ্রোহ, বালাকোটে সৈয়দ আহম্মদ বেরেলভীর যুদ্ধ, হাজী শরিয়তুল্লাহর ফরাজী আন্দোলন, তিতুমীরের বাঁশের কেল্লা- সবই ছিল মুসলমানদের বিদ্রোহী মননের বহিঃপ্রকাশ। এই বিদ্রোহ চলমান ছিল।
ব্রিটিশরা সে সময় ৫০ হাজার আলেমকে ফাঁসিতে ঝুলিয়েছিল। আলেমের অভাবে দাফন কাফনের কাজ চালানো তখন মুশকিল হয়ে পড়েছিল। এমন পরিস্থিতিতে আত্মগোপনে থাকা আলেমরা অস্ত্রের পথ পরিহার করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিলেন। আত্মগোপন থেকে বের হয়ে আসার পর মওলানা কাসেম নানুতুবি প্রথম মাদরাসা করার পরিকল্পনা গ্রহণ করেন এবং মওলানা জুলফিকার আলী, মওলানা এয়াকুব, নানুতুবি, মওলানা ফজলুর রহমান, মওলানা রফিউদ্দীন এবং হাজী আবেদ হোসেনকে নিয়ে ১৮৬৬ সালে দেওবন্দে মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেন।
দেওবন্দ মাদরাসা থেকে কওমি মাদরাসার মূলত গোড়াপত্তন। বাংলাদেশে দেওবন্দের ছাত্ররাই ১৯০৫ সালে হাটহাজারী মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এ মাদরাসাই এখন বাংলাদেশে কওমি ঘরানার প্রধান মাদরাসা। অথচ আজ যখন আমরা রাস্তায় এই দেওবন্দ অনুসারীদের দেখি কেউ কি বলবে এরা উপমহাদেশের সেই শিক্ষিত শ্রেণির প্রতিনিধিত্ব করছে? এরা বার বার নিজেদের একটা গোঁড়া অন্ধ শ্রেণি প্রমাণ তো করছেই তৈরি করছে আরও কিছু অন্ধ শ্রেণির অনুসারী। সোশ্যাল মিডিয়ায় এরা কিলবিল করছে অন্যের ঈমান-আমলের পরীক্ষা নেওয়ার জন্য। কথায় কথায় অন্যদের নাস্তিক বলছে, দোজখে পাঠিয়ে দিচ্ছে।
এদের কারণে আলেম-ওলামারা অবজ্ঞার শিকার হচ্ছেন- কাঠমোল্লা নামে। সব অন্ধত্ব যেন এদের ভর করছে কয়েক যুগ ধরে। সাধারণ মানুষের কাছে ইসলামের মহান বাণী পৌঁছানোর, ইসলামকে সঠিকভাবে সবার সামনে রিপ্রেজেন্ট করার পরিবর্তে এরা মেতে আছে ঠুনকো সব ইস্যু নিয়ে। আর আছে উদ্ভট সব ফতোয়াদানের কাজে। এদের চোখে ইংরেজি পড়া হারাম, বিজ্ঞান পড়া হারাম, ছবি তোলা হারাম, টিভি দেখা হারাম। এদের হারামের লিস্টের সীমা ছিল না, যেটা আবার তারা ভুল ছিল বলে হালাল করে নিতে বাধ্য হয়েছে। এক সময় বলেছে মাইক হারাম। এখন নিজেদের সুন্দর কণ্ঠকে ফুল ভলিউমে কর্কশ বানিয়ে মানুষের কানে দিচ্ছে। ছবি তোলা, সিনেমা দেখা হারাম বলে নিজেরা ইউটিউব দখল করেছে। কয়েকজন তো অবলীয়ায় মিথ্যা কথা বলে। গণতন্ত্রকে হারাম বলেছিল, নারী নেতৃত্বকে হারাম বলেছিল- সবই মেনে নিচ্ছে এখন।
আখেরি জামানায় এই সবকিছু মেনে নেওয়া তাদের গুনাহ না। আমি অভিনন্দন জানাই তাদের, সুবুদ্ধির উদয় হওয়ায়। দীর্ঘদিন তারা পণ করেছিল কওমি মাদরাসার শিক্ষার সিলেবাস ও সার্টিফিকেটের ক্ষেত্রে সরকারের অনুমোদন নেবেন না। আল্লামা আহমদ শফীর নেতৃত্বে সে চিন্তা থেকে বের হয়ে এসেছেন। যদিও এর আগে ঘটে গেছে অনেক ঘটনা। ইসলাম এবং তার নবী হজরত মুহাম্মদ (স.)-কে অবমাননা করা যাবে না—এই দাবিতে ৬ এপ্রিল ২০১৩ সালে কওমি মাদরাসার অনুসারীদের দ্বারা গঠিত হেফাজতে ইসলাম ঢাকা অভিমুখী ‘লংমার্চ’ কর্মসূচি করেছে।
পরের মাসে ৫ মে শাপলা চত্বরে অবস্থানের কর্মসূচি দিয়ে সরকার পতনের স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন তারা সরকার বিরোধীদের। বিএনপি-জামায়াত এবং এরশাদের জাতীয় পার্টিও হেফাজতের কর্মসূচিকে সমর্থন দেয় এবং হেফাজতকে ঘুঁটি হিসেবে নিয়ে সরকার পতনের স্বপ্ন দেখেন তারা। শেষ পর্যন্ত জাতি দেখল নগরীতে কুরআন পোড়ানোসহ হেফাজত-তাণ্ডব। সেদিন সারাদেশেই ছড়িয়ে পড়েছিল চরম উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠা। দিনভর আস্ফালন আর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দৃঢ় পদক্ষেপ গভীর রাতে কানে ধরে বিদায়ের দৃশ্য স্বস্তি এনে দিয়েছিল নগরবাসীকে। ৫ মে’র সেই অভিযান নিয়ে আজও তারা গল্প বলেন, সেই রাতে হাজার হাজার মানুষকে লাশ করা হয়েছে, গুম করা হয়েছে। কিন্তু মৃত লোকদের একজন আত্মীয়স্বজন আজ পর্যন্ত দাবি করেনি যে তাদের প্রিয়জনকে খুঁজে পায়নি।
অবশ্য দিনবদল হতে সময় নেয়নি। বছর ঘুরতেই তারা সরকারের সঙ্গে সুসম্পর্ক স্থাপন করে কওমি মাদরাসার শিক্ষার্থীদের সনদের স্বীকৃতি আদায় করলেন, কওমি মাদরাসার শিক্ষার্থীদের রাষ্ট্রের মূলস্রোতের শিক্ষার সঙ্গে সংযুক্ত করার পদক্ষেপ নিলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের জনসভায় সংবর্ধনা দিয়ে কওমি জননী খেতাব দিলেন তখন আওয়ামী-কওমি পরস্পর বন্ধু হয়ে গেলেন! মানুষ এসব কিছুকে ইতিবাচক হিসেবে নিয়েছিল।
কিন্তু আল্লামা আহমদ শফীর মৃত্যুর পর দেখছি আবার পুরোনো ভূত মাথায় চড়েছে। তারা এবার মাঠে এসেছেন ভাস্কর্য নিয়ে, যদিও এই দেশে যুগের পর যুগ ভাস্কর্য অথবা মূর্তি ছিল। এটা নতুন কিছু করছে না সরকার। মনে হচ্ছে দেশে ইসলামের বড় শত্রু এই ভাস্কর্য নির্মাণ। বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য নির্মাণ নিয়ে যেহেতু তারা প্রশ্ন তুলেছেন তাদের উদ্দেশ্য নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। শুনেছি আগামী শনিবার এ নিয়ে তারা ব্যাখ্যা দেবেন, ফতোয়া দেবেন।
অথচ দেশে এখন ইসলামের জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি আলেম-ওলামারাই। কয়েক বছর ধরে কওমি মাদরাসায় শিশু-কিশোরদের ওপর শিক্ষক এবং সিনিয়র ছাত্রদের দ্বারা যৌন নির্যাতনের অভিযোগ আসছে। প্রায় প্রতি সপ্তাহে কোনো না কোনো মাদরাসার শিক্ষক বলাৎকারের ঘটনায় গ্রেফতার হচ্ছেন। ইসলামের অবমাননার নানা ছুতায় তারা রাজপথে মাদরাসার শিক্ষার্থীদের ডেকে আনছেন। তাদের বাধ্য করছেন তাদের রাজনৈতিক কর্মসূচিতে যেতে। অথচ নিজেদের চারিত্রিক ত্রুটি সংশোধনের কোনো কথা বলেন না। ইউটিউব মাওলানাদের ওয়াজ করতে দেখলাম না। এজন্য বড় কোন আলেম এটা নিয়ে কথা বলেছেন আমি দেখিনি।
সম্মিলিতভাবে এসব অনাচার ঠেকানোর কোনো পদক্ষেপ না নিয়ে আলেম ওলামারা আছেন ভাস্কর্য ঠেকাতে, ইসলাম অবমাননার অভিযোগ এনে আস্তিক-নাস্তিক ইস্যু বানিয়ে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ঠেকাতে। আছেন ফ্রান্স নিয়ে, ইসরায়েল নিয়ে, ভারত নিয়ে। অথচ এই মুহূর্তে বাংলাদেশে ইসলামের সবচেয়ে বেশি বদনাম হচ্ছে মাদরাসার অভ্যন্তরের ঘটনাবলিতে, হুজুরদের কার্যাবলিতে। মাদরাসায় এসব হয়তো আগেও ছিল কিন্তু মিডিয়ার ব্যাপক উপস্থিতি আর মানুষের সচেতনতায় এসব আর ঢেকে রাখার জিনিস নয়। সাধারণ লোকদের অপরাধকে যে চোখে দেখে আলেম-ওলামার অপরাধকে সমান পাল্লায় দেখে না। আলেম ওলামার কাছে মানুষের প্রত্যাশা অনেক বেশি। তাই আলেম ওলামাদের অনুরোধ করবো- ভাস্কর্য-মূর্তিসহ রাষ্ট্রীয় আইনে যা কিছু অবৈধ নয় সেসব নিয়ে বাড়াবাড়ি করার দরকার নেই। আপনারা বরং এসব ফেলে আত্মশুদ্ধিতে যান। আপনাদের আত্মশুদ্ধি না হলে আলেম-ওলামার প্রতি, ইসলামের প্রতি মানুষের অভক্তি এসে যাবে।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট, ইরাক ও আফগান যুদ্ধ-সংবাদ সংগ্রহের জন্য খ্যাত।
আডি/ ০৪ ডিসেম্বর