৫২ বছর পর স্মৃতিচিহ্ন খুঁজে পেয়ে আবেগ-আপ্লুত স্বজনরা
সিলেট, ০৫ মার্চ – একাত্তরের নির্মমতার সাক্ষি সিলেট ক্যাডেট কলেজ (তৎকালীন রেসিডেন্সিয়াল কলেজ)। সিলেট অঞ্চলে পাকিস্তানী সৈনাদের সবচেয়ে বড় বন্দিশালা ছিল এটি। এখানে নির্বিচারে গুলি করে অসংখ্য মুক্তিকামী বাঙালিকে হত্যা করা হয়েছে। কেবল হত্যা করেই তারা শান্ত হয়নি। গণকবরে মাটি চাপা দেওয়া হয়েছে নিরীহ বাঙালিদের।
মুক্তিযুদ্ধের এমন ভয়াল স্মৃতি বিজড়িত সালুটিকর বধ্যভূমিটি স্বাধীনতার ৫২ বছর পরও স্বীকৃতি পায়নি। এমনকি কতজন বাঙালি এ বধ্যভূমিতে শহিদ হয়েছেন তার কোনো হিসেবও নেই। মিলেনি তাদের পরিচয়ও। এ নিয়ে এ পর্যন্ত কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি।
স্বচক্ষে দেখা সেই বধ্যভূমির ভয়াল স্মৃতি আজও ভুলতে পারেননি সিলেটের বীর মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ আব্দুস সালাম বীর প্রতীক ও বীর মুক্তিযোদ্ধা অধ্যাপক ডা. জিয়াউদ্দিন আহমদ। নিজ উদ্যোগে বেসরকারিভাবে ফান্ড তৈরি করে এ বধ্যভূমিতে নির্মাণ করেছেন ‘শহিদ স্মৃতি উদ্যান’। শুধু তাই নয়, এ বধ্যভূমিতে শহিদ হওয়া ৬৬ জন বীর শহিদের পরিচয় সনাক্ত করেছেন। তাদের নামে আলাদা স্মৃতিফলক নির্মাণ করা হয়েছে এ শহিদ উদ্যানে।
শনিবার এটি উদ্বোধন করা হয়েছে। গণকবর দেওয়া বাকি শহিদদেরও চিহ্নিত করে তাদেরও স্মৃতিফলক নির্মাণ করা হবে বলে জানিয়েছেন উদ্যোক্তারা। এই দুজন ছাড়া স্বাধীনতার শহিদ স্মৃতিস্তম্ভ বাস্তবায়ন কমিটিতে রয়েছেন মুক্তিযুদ্ধ গবেষক অপূর্ব শর্মা।
শনিবার বিকেলে ‘শহিদ স্মৃতি উদ্যান’ টি উদ্বোধন করেন গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে. চৌধুরী। উদ্বোধনের পর শহিদদের কবরে ফুল দিয়ে গভীর শ্রদ্ধা জানান তারা। এসময় শহিদ স্মৃতি উদ্যানের উদ্বোধনে এসে কান্নায় ভেঙে পড়েন শহিদদের স্বজনরা। ৫২ বছর পর দেশের জন্য জীবন দেওয়া নিজের স্বজনের স্মৃতিচিহ্ন খুঁজে পেয়ে আবেগ-আপ্লুত হয়ে পড়েন তারা।
এসময় শহিদ স্মৃতি উদ্যানের উদ্যোক্তা বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুস সালাম বীর প্রতীক জানান, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসজুড়ে যেখানে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ক্যাম্প ছিল সেখানে এখন রয়েছে সিলেট ক্যাডেট কলেজ। কলেজের পেছনে পূর্বদিকের টিলার পাশে মুক্তিকামী বাঙালিদের ধরে নিয়ে পাকহানাদাররা নির্যাতন চালিয়ে হত্যাযজ্ঞ ঘটিয়েছে, ওই জায়গাটিই বধ্যভূমি। বধ্যভূমি সংরক্ষণ প্রকল্পের আওতায় গত বছর এখানে শহিদদের স্মরণে ‘স্মৃতিসৌধ’ নির্মাণ করে সিলেটের গণপূর্ত বিভাগ। আজ নতুনভাবে পরিচিতি পেলো এই বধ্যভূমি। ভয়াল একাত্তরে এখানে যাদের কবর দেওয়া হয়েছিলো তাদের নামে (যাদের নাম পাওয়া গেছে) নামফলক স্থাপন করা হয়েছে।
আব্দুস সালাম বলেন, শহীদ ডা. শামসুদ্দিন আহমদের ছেলে ডা. জিয়াউদ্দিন আহমদ ও আমার পরিবারের অর্থায়নে এবং সবার সহযোগিতায় শহিদ স্মৃতি উদ্যান নির্মাণ করা হয়েছে।
একাত্তরে পাকিস্তানি বাহিনী গকুলানন্দ চক্রবর্তীকে যখন হত্যা করে মেয়ে রীনা চক্রবর্তী তখন মায়ের গর্ভে। বাবার মৃত্যুর কয়েক মাস পর জন্ম হয় তার। এতোদিন কেবল গল্প শুনেছেন বাবা মুক্তিযুদ্ধে শহিদ হয়েছেন। কিন্তু কোথাও বাবার কোন স্মৃতিচিহ্ন ছিলো না। অবশেষে ৫২ বছর পর শনিবার বাবার স্মৃতিচিহ্ন খুঁজে পেলেন রীনা। কখনো না দেখে বাবার স্পর্শ পেলেন যেনো।
সিলেটের সালুটিকর বধ্যভূমিতে শহিদ গকুলানন্দ চক্রবর্তীর স্মৃতিফলকে হাত বোলাতে বোলাতে কান্নাজড়িত কণ্ঠে রীনা চক্রবর্তী বলেন, বাবাকে আমি কখনো দেখিনি। কোথাও তার স্মৃতিচিহ্নও ছিলো না। ৫২ বছর পর আজকে এই বধ্যভূমিতে তার একটি স্মৃতিফলক লাগানো হলো। এই প্রথম যেনো আমি বাবার স্পর্শ পেলাম। রীনা চক্রবর্তীর মতো ৬৬ টি পরিবার শনিবার প্রথমবারের মতো দেশের জন্য আত্মাত্যাগকারী তাদের শহিদ স্বজনদের স্মৃতিচিহ্নের সন্ধান পান এই বধ্যভূমিতে।
একাত্তরে সালুটিকর এলাকার সিলেট ক্যাডটে কলেজে ক্যাম্প গড়েছিলো পাকিস্তানি সেনাবাহিনী। মুক্তিযোদ্ধাসহ বাঙালিদের ধরে এনে হত্যা ও নির্যাতন করা হতো এখানে। হত্যার পর ক্যাডটে কলেজের পেছনেই গণকবর দেওয়া হয় তাদের। সালুটিকরের এই গণকবরটি সবার কাছেই বধ্যভূমি হিসেবে পরিচিত থাকলেও এতোদিন এটি পড়েছিলো পরিত্যক্ত অবস্থায়। ঘন জঙ্গলে পূর্ণ ছিলো এই টিলা ভূমি। ছিলো না কোন স্মৃতিচিহ্নও। সেনানিবাসের সংরক্ষিত এলাকায় এই বধ্যভূমির অবস্থান হওয়ায় সাধারণের প্রবেশাধিকারও ছিলো না।
অবশেষে স্বাধীনতার ৫২ বছর পর দুই মুক্তিযোদ্ধার উদ্যোগে এই বধ্যভূমি সংরক্ষণের উদ্যোগ নেয়া হয়। তাদের উদ্যোগেই এখানে নির্মাণ করা হয়েছে নান্দনিক শহিদ স্মৃতি উদ্যান।
সূত্র : ডেইলি বাংলাদেশ