শাস্তি হতে পারে ‘দানব’ এমপিদের
ঢাকা, ০৪ মার্চ – সাম্প্রতিক সময়ে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য, জ্বালানি তেল ও গ্যাস-বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি মানুষের দুর্দশা বাড়িয়েছে। ডলার সংকটে অর্থনীতিও বেকায়দায়। অন্যদিকে দুর্নীতি, অর্থ পাচারের অভিযোগ সব মিলে জাতীয় নির্বাচনের আগে ভাবমূর্তির সংকট দেখছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও সরকার।
এ অবস্থায় সরকার ও দলের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করতে চলতি বছর কঠোর কিছু সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছেন সরকারপ্রধান শেখ হাসিনা। প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি মনে করেন, আগামী দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন ঘিরে সরকার ও দলের ভাবমূর্তি আরও পরিচ্ছন্ন করে তুলতে হবে। সে কারণে মানুষকে খুশি করতে হবে। আর সে জন্যই কঠোর সিদ্ধান্ত নিয়ে ভোটের মাঠে মানুষকে চমক দিতে চান সরকারপ্রধান। তার এমন সিদ্ধান্তে দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত কয়েকজনকে শাস্তির মুখোমুখি পড়তে হতে পারে।
চলতি বছর জনস্বার্থ বিবেচনায় রেখে আরও কিছু কাজ করতে চায় সরকার; বিশেষ করে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রীর মূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখা বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছে। তেল-গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি সরকারকে যে বেকায়দায় ফেলেছে, তা পুষিয়ে নিতে চায় নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের লাগাম টানার মধ্য দিয়ে। এ ছাড়া সর্বজনীন পেনশন সুবিধা দেওয়ার যে পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে, সেটা এবারের বাজেটে স্বল্প পরিসরে হলেও বাস্তবায়ন করার সর্বোচ্চ চেষ্টা রয়েছে সরকারের। আওয়ামী লীগ ও সরকারের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বলে এমন তথ্য জানা গেছে।
দলের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের কয়েকজন নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগের পরিচ্ছন্ন ভাবমূর্তি নিশ্চিত করতে কী কী পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে, তা নিয়ে ঘনিষ্ঠজনদের সঙ্গে নিবিড়ভাবে আলোচনা করেছেন। কোন বিষয়কে গুরুত্ব দিয়ে কঠোর অবস্থান গ্রহণ করতে হবে, সে জন্য পরামর্শও চেয়েছেন।
একাধিক সূত্রে জানা গেছে, এ সময়ের সবচেয়ে আলোচিত ইস্যু দেশের টাকা বিদেশে পাচার। পাচার রোধ করতে সরকার গুরুত্বপূর্ণ কিছু সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেও অপরাধীদের চিহ্নিত করা ও আইনের আওতায় আনার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে।
ওই সূত্রগুলো আরও জানায়, এপ্রিল থেকে নির্বাচনের আগ পর্যন্ত দেশের টাকা বিদেশে পাচারকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার পদক্ষেপ দৃশ্যমান হবে।
আওয়ামী লীগ ও সরকারের মধ্যে এমন আলোচনা আছে যে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে আবারও ক্ষমতায় আসতে গেলে নির্মোহভাবে কিছু সিদ্ধান্ত নিতে হবে এবং সেটা কার্যকর করতে হবে। করা গেলে ভোটে তার সুফল মিলবে।
আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের দুজন নেতা বলেন, দুর্নীতিবাজ ধরতে আবারও অভিযান পরিচালনা করা হবে। এ লক্ষ্যে দুর্নীতি দমন কমিশনকে (দুদক) আরও কার্যকর করে তোলা হচ্ছে; বিশেষ করে বিভিন্ন সরকারি দপ্তর ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে ঘাপটি মেরে বসে থাকা দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ আরও জোরদার ও দৃশ্যমান হবে নির্বাচনী বছরে। আওয়ামী লীগের ইশতেহারে ঘোষিত দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো ট্রলারেন্স নীতি আরও দৃশ্যমান হয়ে উঠবে।
এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কাজী জাফরউল্ল্যাহ বলেন, ‘বিদেশে টাকা পাচারকারীরা দেশের শত্রু। অন্যায়, অনিয়ম ও অপরাধীর বিরুদ্ধে শেখ হাসিনার সরকার সব সময় আপসহীন। অর্থ পাচারকারী ও দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত যারাই রয়েছেন, তাদের বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ব্যবস্থা গ্রহণের সিদ্ধান্ত জানিয়েছেন। অন্যায়-অনিয়মের সঙ্গে আপস করা শেখ হাসিনার নীতি নয়।’
তিনি বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী ইতিমধ্যেই প্রকাশ্যে বলেছেন, “টাকা পাচারকারীদের তালিকা দেন, ব্যবস্থা নেব।” আমি মনে করি টাকা পাচারকারীদের বিরুদ্ধে শিগগিরই আইনি পদক্ষেপ নেওয়া শুরু হবে।’
সরকারের নীতিনির্ধারকরা বলছেন, নির্বাচনের আগে এমন কিছু অন্যায়-অনিয়মের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা শুরু হবে, যা ভোটের মাঠে সরকার ও আওয়ামী লীগকে আলোচনায় রাখবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থা-বিশ্বাস আরও মজবুত করে তুলবে। তার নেতৃত্বাধীন সরকার প্রশংসিত হবে তেমন কিছু আলোচিত সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়নের নীতি অনুসরণ করা হবে।
সরকারের এ পরিকল্পনার কথা সর্বশেষ দলীয় এক কর্মসূচিতে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের নিজেও জানিয়েছেন। ওই কর্মসূচিতে তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কঠোর হচ্ছেন! কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না। সবাই সাবধান ও সতর্ক হয়ে যান। কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছেন শেখ হাসিনা তারই ইঙ্গিত ওবায়দুল কাদেরের এই বক্তব্য, এমনই দাবি করেন আওয়ামী লীগের গুরুত্বপূর্ণ নেতারাও।
কঠোর কী সিদ্ধান্ত নিতে পারেন দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনা সেই প্রশ্নে আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সম্পাদকমণ্ডলীর একাধিক সদস্য বলেন, দেশের টাকা বিদেশে পাচার যারা করেছেন, প্রথমেই তাদের বিরুদ্ধে ‘অ্যাকশনে’ যাবেন সরকারপ্রধান। তারা বলেন, অপরাধীরা দলের হোক আর যত বড় প্রভাবশালীই হোক, তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পিছপা হবেন না টানা তিনবারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
কেন্দ্রীয় ওই নেতারা আরও বলেন, অর্থ পাচারের বিষয়টি এই মুহূর্তে দেশে-বিদেশে সবচেয়ে আলোচিত ঘটনা। এর বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে পারলে সরকারের স্বচ্ছ ভাবমূর্তি ঊর্ধ্বমুখী হবে। মাদক কারবারি ও এর সঙ্গে যুক্ত সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে সাঁড়াশি অভিযান জোরদার করা হবে। কক্সবাজার ও চট্টগ্রাম এ দুটি জেলাকে মাদকপ্রবণ এলাকা ঘোষণার সিদ্ধান্ত হয়েছে। রূপরেখা তৈরির কাজও হয়েছে। অভিযান শুরু হবে সেখান থেকেই। এর সঙ্গে যুক্ত বা আশ্রয়-প্রশ্রয়দাতারাও শাস্তির আওতায় আসবেন। এ ক্ষেত্রে কে দলীয় বা দলীয় নয়, সে বিবেচনা করা হবে না।
আওয়ামী লীগের পদপদবি ব্যবহার করে ক্ষমতা প্রদর্শন করে যাচ্ছেন দলের এই অংশকেও শাস্তির আওতায় আনার সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের দিকে হাঁটবে সরকার। গত এক যুগে ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে এলাকায় আওয়ামী লীগের রাজনীতিকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন, জনপ্রিয়তার রাস টেনে ধরেছেন সেসব আগাছা-পরগাছা উপড়ে ফেলার পরিকল্পনাও রয়েছে। এ ক্ষেত্রে ‘দানব’ বনে যাওয়া কিছু সংসদ সদস্যের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হতে পারে এমন আভাসও পাওয়া গেছে। তবে ‘দানব’ বনে যাওয়া সংসদ সদস্যদের সবচেয়ে বড় শাস্তি হবে মনোনয়ন না দেওয়া।
আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী সিদ্ধান্তের সঙ্গে যুক্ত থাকা একাধিক নেতা বলেন, নির্বাচনী প্রচারে সর্বাধিক গুরুত্ব দেবে তিন মেয়াদে ক্ষমতায় থেকে যেসব উন্নয়ন শেখ হাসিনার সরকার করেছে সেসব। পাশাপাশি কঠোর সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের বিষয়টি চমক সৃষ্টি করবে ভোটের মাঠে। তারা বলেন, ভোটের আগে ভোটের মাঠে অনেক চমকের মধ্যে এটিও অন্যতম। অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে এগিয়ে রাখবে তেমন পরিকল্পনা থেকে সরকার এমন সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে।
জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও সংসদ উপনেতা মতিয়া চৌধুরী বলেন, ‘অন্যায়-অনিয়মকে কখনো প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রশ্রয় দেননি। এ ক্ষেত্রে নিজের দল ও অন্য দল এ বিবেচনাবোধ নেত্রী (শেখ হাসিনা) করেন না।’ তিনি বলেন, অপরাধীর পরিচয় তার কাছে অপরাধীই।
সূত্র: দেশ রূপান্তর
এম ইউ/০৪ মার্চ ২০২৩