পঞ্চগড়

আহমদিয়ার জলসা নিয়ে পঞ্চগড় রণক্ষেত্র, নিহত ২, আহত ৫০

পঞ্চগড়, ০৪ মার্চ – আহমদিয়া সম্প্রদায়ের বার্ষিক সালানা জলসা বন্ধকে কেন্দ্র করে শুক্রবার পুলিশের সঙ্গে মুসল্লিদের সংঘর্ষে রণক্ষেত্রে পরিণত হয় পঞ্চগড় শহর। এ সময় তাদের সঙ্গে পুলিশের ব্যাপক ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া এবং ইটপাটকেল নিক্ষেপের ঘটনা ঘটে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে কয়েকশ রাউন্ড রাবার বুলেট ও টিয়ার গ্যাসের শেল নিক্ষেপ করে পুলিশ। এ ঘটনায় দুই যুবক নিহত হয়েছেন।

এ ছাড়া সাংবাদিক, পুলিশসহ আহত হয়েছেন অর্ধশতাধিক। সংঘর্ষ চলাকালে আহমদিয়া সম্প্রদায়ের ব্যবসায়ীদের কয়েকটি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ এবং ২০টি বাড়িতে আগুন দেয় বিক্ষুব্ধ মুসল্লিরা। পরিস্থিতি বিবেচনায় ১৭ প্লাটুন বিজিবি সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে বলে জানিয়েছে জনসংযোগ দপ্তর।

পুলিশ ও স্থানীয় সূত্র জানায়, শুক্রবার আহমদিয়া সম্প্রদায়ের (কাদিয়ানি) বার্ষিক সালানা জলসা বন্ধ ও তাদের অমুসলিম ঘোষণার দাবিতে বিক্ষোভ করে সম্মিলিত খতমে নবুওয়াত সংরক্ষণ পরিষদ সমর্থক মুসল্লিরা। জুমার নামাজ শেষে খণ্ড খণ্ড মিছিল নিয়ে বিভিন্ন মসজিদের মুসল্লিরা শহরের শেরেবাংলা পার্ক মোড়ে জড়ো হন। বিক্ষুব্ধ মুসল্লিদের সঙ্গে স্থানীয় এবং বহিরাগত কিছু যুবক বিক্ষোভসহ সড়ক অবরোধের চেষ্টা করলে সংঘর্ষের সূত্রপাত ঘটে। এক পর্যায়ে পুলিশের সঙ্গে ব্যাপক ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটেছে। এ সময় বিক্ষুব্ধরা পুলিশের ওপর ব্যাপক ইটপাটকেল ছোড়ে। পুলিশও কয়েকশ রাউন্ড রাবার বুলেট ও টিয়ার গ্যাসের শেল নিক্ষেপ করে। এ ঘটনায় নিহত হন আরিফুর রহমান (২৭) এবং প্রকৌশলী জাহিদ হাসান (২২) নামে দুই যুবক। আরিফুর শহরের ইসলামবাগ এলাকার ফরমান আলীর ছেলে এবং জাহিদ নাটোর জেলার বনপাড়া উপজেলার বাসিন্দা ও আহমদিয়া সম্প্রদায়ের অনুসারী। রাত ৮টার দিকে প্রশাসনের হস্তক্ষেপে বার্ষিক সালানা জলসা বন্ধ ঘোষণা করা হয়।

সূত্র জানায়, মুসল্লিদের বিক্ষোভ ও অবরোধে যানবাহন, যাত্রীসহ পথচারীরাও অবরুদ্ধ হয়ে পড়েন। চরম দুর্ভোগে পড়েন সাধারণ মানুষ। সন্ধ্যার পরও মুসল্লিদের সঙ্গে পুলিশের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া, রাবার বুলেট এবং টিয়ার গ্যাসের শেল নিক্ষেপ চলে। বিক্ষুব্ধ মুসল্লিরা সিনেমা হল রোডের আহমদিয়া সম্প্রদায়ের ব্যবসায়ীদের কয়েকটি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে লুটপাট, অগ্নিসংযোগসহ কমপক্ষে ২০ বাড়িতে আগুন দেন। লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের সময় পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের কাছে যেতে দেখা যায়নি। বিক্ষুব্ধরা ফায়ার সার্ভিসের গাড়িও ঘটনাস্থলে যেতে দেয়নি। এ সময় তারা দোকানের কয়েক লাখ টাকার মালপত্র বাইরে এনে জ্বালিয়ে দেয়। বিক্ষুব্ধরা শহরের রিগ্যাল ফার্নিচার, ভিশন শোরুমসহ প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের একাধিক প্রতিষ্ঠানেও ভাঙচুর চালায়। পঞ্চগড় বাজার এলাকার কয়েকটি দোকানেও ভাঙচুর ও লুটপাট চালায় বিক্ষুব্ধরা। পেশাগত দায়িত্ব পালনের সময় এসএ টিভির পঞ্চগড় প্রতিনিধি কামরুজ্জামান টুটুল এবং ফাহিম নামে এক সংবাদকর্মীকে মারধর করেন বিক্ষুব্ধ মুসল্লিরা। সাংবাদিক টুটুল বলেন, আমার ওপর যাঁরা হামলা করেছেন, তাঁদের কেউ পঞ্চগড়ের না। আমি দীর্ঘদিন সাংবাদিকতা পেশায় থাকলেও তাঁদের কাউকে চিনি না। কমবেশি ২০ জনের মতো যুবক হামলা করেন। তাঁরা বহিরাগত। জেলার বাইরে থেকে আসা।

তবে ঘটনার সময় পুলিশ কয়েক যুবককে আটক করে থানায় নিয়ে যায়। এ ঘটনায় শহরের বিভিন্ন পয়েন্টে পুলিশ, র‍্যাব ও বিজিবির সদস্যদের টহল দেখা গেছে।

প্রতিবছরের মতো এবারও জেলা শহরের আহমদনগর এলাকায় শুক্রবার সকাল থেকে তিন দিনব্যাপী বার্ষিক জলসা শুরু হয়। এতে দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে আহমদিয়া সম্প্রদায়ের মানুষ যোগ দেন। এর প্রতিবাদে বৃহস্পতিবার দুপুর ১২টা থেকে চার ঘণ্টা মহাসড়ক অবরোধসহ বিক্ষোভ করেন মুসল্লিরা। এ নিয়ে আহমদিয়া সম্প্রদায় এবং সম্মিলিত খতমে নবুওয়াত সংরক্ষণ পরিষদ সমর্থকদের মধ্যে চরম উত্তেজনা দেখা দিলেও পুলিশ তখন জানায়, পরিস্থিতি স্বাভাবিক রয়েছে। তবে পরিস্থিতি সামাল দিতে রংপুর, দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও ও নীলফামারী থেকেও অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক নিহত আরিফুর রহমানের পরিবারের লোকজনের দাবি, বাড়ির কাছে মসজিদপাড়া মহল্লায় আরিফুর রহমানকে ধাওয়া করেন পুলিশ সদস্যরা। তাঁরা এলোপাতাড়ি রাবার বুলেট ছোড়েন। আরিফের মাথায় বুলেট লাগলে তিনি মারাত্মক আহত হন। রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার পথে তাঁর মৃত্যু হয়। পৌরসভার ২ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর মো. মাজেদুর রহমান চৌধুরী ইরান বলেন, আমাদের মহল্লার আরিফুর রহমান নামে এক যুবক মারা গেছেন।

পঞ্চগড় আধুনিক সদর হাসপাতালের দায়িত্বরত চিকিৎসক মো. রহিমুল ইসলাম বলেন, আরিফুর রহমানের মাথায় সম্ভবত বুলেটের আঘাত ছিল। ময়নাতদন্ত ছাড়া বলা মুশকিল। তবে মাথা থেকে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ হচ্ছিল। উন্নত চিকিৎসার জন্য আমরা তাঁকে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানোর পরামর্শ দিই।

জেলা সম্মিলিত খতমে নবুওয়াত পরিষদের সাধারণ সম্পাদক কারি মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ বলেন, শুক্রবার আমাদের কোনো কর্মসূচি ছিল না। আমরা সালানা জলসা বন্ধসহ তাদের অমুসলিম ঘোষণার দাবিতে বৃহস্পতিবার বিক্ষোভ করেছিলাম। শুক্রবার বিক্ষুব্ধ তৌহিদি জনতা মিছিল বের করলে প্রশাসনের পরামর্শে আমরা শেরেবাংলা পার্ক মোড় থেকে যারা মিছিল করছিল তাদের নিয়ে আসি এবং আমরা বাড়ি চলে যাই। এর পর কে কোথায়, কীভাবে হামলা করল আমরা জানি না।

আহমদিয়া সম্প্রদায়ের সালানা জলসার আহ্বায়ক আহমেদ তফসের চৌধুরী বলেন, হামলাকারীরা জাহিদ হাসানকে পিটিয়ে হত্যা করে। পরে তার লাশ রেখে পালিয়ে যায়।

পুলিশ সুপার এসএম সিরাজুল হুদা বলেন, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের স্বার্থে আহমদিয়া সম্প্রদায়ের নেতৃবৃন্দকে সালানা জলসা বন্ধের আহ্বান করলে তারা তা বন্ধ করতে সম্মত হয়। তবে বিক্ষুব্ধরা শহরের বিভিন্ন পয়েন্টে বিক্ষোভ করছে। আহমদনগর এলাকাসহ শহরের গুরুত্বপূর্ণ স্থানে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন রয়েছে। দুই যুবকের মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করেন তিনি।

জেলা প্রশাসক মো. জহুরুল ইসলাম বলেন, শুক্রবার সকাল থেকে শুরু হওয়া আহমদিয়া সম্প্রদায়ের তিন দিনব্যাপী বার্ষিক সালানা জলসা শুক্রবার রাতেই বন্ধ করা হয়েছে। পরিস্থিতি এখন স্বাভাবিক।

সূত্র: সমকাল
এম ইউ/০৪ মার্চ ২০২৩

Back to top button