মালয়েশিয়া

মালয়েশিয়ায় স্ব-মহিমায় দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করছেন প্রবাসীরা

আহমাদুল কবির

কুয়ালালামপুর, ০৩ ডিসেম্বর- দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশ মালয়েশিয়ায় স্ব-মহিমায় বাংলাদেশের ব্র্যান্ডিং করে চলেছেন প্রবাসীরা। কর্ম, শিষ্টাচার, মেধা ও প্রজ্ঞায় নিজ দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করছেন তারা। কেউ কেউ পাচ্ছেন কাজের স্বীকৃতিও। মালয়েশিয়ায় রয়েছেন ব্র্যান্ডিং বাংলাদেশের চার সারথি। তারা হলেন- ডা. রাশেদ মোস্তফা সরোয়ার, আবরার এ আনোয়ার, ড. সাইদুর রহমান ও পাভেল সারওয়ার।

ডা. রাশেদ মোস্তফা সরোয়ার
চলতি বছরের জুলাই মাস থেকে ডা. রাশেদ মোস্তফা সরোয়ার ইউনিসেফের মালয়েশিয়া প্রতিনিধি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। ডা. সরোয়ার এর আগে বেলারুশ প্রজাতন্ত্রের ইউনিসেফের প্রতিনিধি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি ইউনিসেফ এবং জাতিসংঘের অন্যান্য সংস্থা আজারবাইজান, রাশিয়া, পূর্ব তিমুর, জর্জিয়া এবং তাজিকিস্তানের অন্যান্য অঞ্চলে ২৫ বছরের অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন।

আবরার এ আনোয়ার
মালয়েশিয়ার স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকে ম্যানেজিং ডিরেক্টর এবং সিইও পদে দায়িত্ব পালন করছেন বাংলাদেশের আবরার আনোয়ার। ২০১৭ সালের ১ নভেম্বর থেকে নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করে আসছেন তিনি। আবরার আনোয়ার ২০১১ সালে স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড, বাংলাদেশ শাখায় যোগ দেন। ২০১৪ সাল পর্যন্ত করপোরেট ক্লায়েন্ট কভারেজ বিজনেসম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালনের পর ২০১৫ সালের জানুয়ারিতে স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড বাংলাদেশের সিইও পদের দায়িত্ব পান। করপোরেট ও ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকিংয়ে বাংলাদেশ, ভারত ও যুক্তরাজ্যে আবরার আনোয়ার কাজ করেছেন।

অধ্যাপক ড. সাঈদুর রহমান
মালয়েশিয়া সানওয়ে ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ড. সাইদুর রহমান যিনি মেকানিকাল সাইন্টিস্ট হিসেবে বিশ্বের ৪৯তম এবং এনার্জিতে ৫০তম স্থান দখল করেছেন। এ ছাড়া বিশ্বসেরা গবেষকের তালিকায় স্থান করে নিয়েছেন বাংলাদেশি অধ্যাপক সাঈদুর। গত ১৮ নভেম্বর ল্যাঙ্কাস্টার জরিপে ২০২০ সালের সেরা চারজন গবেষকের নাম প্রকাশ করা হয়েছে। সেখানে মালয়েশিয়ার সানওয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ন্যানোমেটেরিয়ালস এবং এনার্জি টেকনোলজির অধ্যাপক সাইদুর রহমান রয়েছেন সেরা চারে।

গত বছরের ডিসেম্বরে মালয়েশিয়ার সানওয়ে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গবেষণায় পুরস্কারও পেয়েছেন সাঈদুর। তার কাজের মধ্যে ল্যাঙ্কাস্টারের এনার্জি রিসার্চ গ্রুপের নবায়ণযোগ্য শক্তির জন্য ন্যানোমেটেরিয়ালসের গবেষণা অন্যতম। বিশ্বের পাঁচ শতাধিক জার্নালে তার গবেষণা প্রকাশ হয়েছে। ল্যাঙ্কাস্টারে নিযুক্ত হওয়ার পর থেকে তিনি প্রায় ৫০০টি জার্নালে নিবন্ধ, কার্যপত্রিকা, বইয়ের অধ্যায় এবং একটি ল্যাঙ্কাস্টারের অধিভুক্তির সঙ্গে পর্যালোচনা প্রকাশ করেছেন। সাঈদুর রহমানের গবেষণাপত্র বিশ্বের অন্যান্য গবেষকদের কাছে সব থেকে সমাদৃত। তার গবেষণা কাজগুলো ৩৬ হাজারেরও বেশি উদ্ধৃতি দেয়া হয়েছে। ওয়েব অব সাইন্স ন্যানোফ্লুয়েড গবেষণায় তিনি প্রথম স্থানে রয়েছেন বলে জানা গেছে।

সাঈদুর রহমান ল্যাঙ্কাস্টার এবং সানওয়ের মধ্যে সহযোগী সংযোগগুলো প্রচার করেন এবং এমএক্সেনে ন্যানোফ্লুয়েড এবং ঘন সৌরবিদ্যুতের ক্ষেত্রে মালয়েশিয়ার সরকার তার গবেষণাকে গ্রহণ ও প্রয়োগ করে। তিনি ল্যাঙ্কাস্টারের রাসায়নিক প্রকৌশল এবং শক্তি গবেষণা দলগুলোর সঙ্গে কাজ করেছেন। মেন্ডেলি ডাটাবেস দ্বারা প্রকাশিত বৈশ্বিক বিজ্ঞানীদের মধ্যে তিনি যান্ত্রিক প্রকৌশল ক্ষেত্রে ৪৯ এবং শক্তি ক্ষেত্রে ৫০তম স্থান অর্জন করেছেন।

বাংলাদেশি শিক্ষার্থী, শিক্ষাবিদ, গবেষকদের উদ্দেশ্যে অধ্যাপক সাঈদুর রহমান বলেছেন, আমার গবেষণার অভিজ্ঞতাটি ভাগ করে নেয়ার জন্য প্রস্তুত আছি। আমি, আমরা সবাই মিলে বাংলাদেশকে বিশ্বে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যেতে সক্ষম হব। তিনি তার মেধা বাংলাদেশে কাজে লাগাতে প্রস্তুত আছেন বলে জানিয়েছেন।

একটা সময় ছিল যখন বাংলাদেশকে দরিদ্রপীড়িত দেশ হিসেবে বিশ্ব চিনত। এরপর কায়িক পরিশ্রম করা কর্মীদের দেখেছে বিশ্ব। কিন্তু এর সঙ্গে সঙ্গে যে মেধা ও কৃতিত্বের প্রমাণ বাংলার মেধাবী সন্তানরা দেখাচ্ছে তা সত্যিই প্রশংসনীয়। এ প্রসঙ্গে অধ্যাপক সাঈদুর বলেন, এনার্জি এখন বিশ্বের অন্যতম অনুষঙ্গ, উন্নয়নের বা ভোগের অন্যতম চালিকাশক্তি। অল্প বিনিয়োগে অধিক এনার্জি উৎপাদন, টেকসই উন্নয়ন এ গবেষণা এবং এর প্রয়োগের বিকল্প নেই। বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সঙ্গে গবেষণা সহযোগিতা হতে পারে। বাংলাদেশি গবেষকদের জন্য অনলাইন গবেষণা সেমিনার সময়ে সময়ে আয়োজন করা যেতে পারে।

পাভেল সারওয়ার
পাভেল সারওয়ার একজন তথ্যপ্রযুক্তি উদ্যোক্তা। তিনি দীর্ঘদিন ধরে মালয়েশিয়ায় বসবাস করছেন। তিনি আট বছরের বেশি সময় ধরে নাগরিক সেবায় উদ্ভাবন, তথ্য-প্রযুক্তি শিক্ষা ও কমিউনিটি ডেভেলপমেন্টে সক্রিয়ভাবে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক এবং জাতীয় সংস্থায় কাজ করছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় ২০১২ সালে তিনি প্রতিষ্ঠিত করেন কোডেক্স সফটওয়্যার সলিউশন। মূলত প্রযুক্তির ব্যবহার করে নাগরিক সমস্যার সমাধান ও উদ্ভাবন নিয়ে কাজ করে প্রতিষ্ঠানটি। বর্তমানে বাংলাদেশ ছাড়াও নেপাল এবং মালয়েশিয়াতে কাজ করছে কোডেক্স।

২০১৭ সালে মালয়েশিয়াতে যান এই তরুণ প্রযুক্তি উদ্যোক্তা। প্রতিষ্ঠা করেন তথ্য-প্রযুক্তিভিত্তিক সংগঠন ইয়ুথ হাব। ইয়ুথ হাব স্কুল পর্যায়ে উদ্ভাবন, তথ্য -প্রযুক্তি ও নতুন উদ্যোক্তা তৈরি নিয়ে কাজ করছে। বিশেষ করে মেয়ে শিক্ষার্থীদের মাঝে তথ্য-প্রযুক্তি শিক্ষাকে প্রাধান্য দিচ্ছে প্রতিষ্ঠনটি। মালয়েশিয়ার বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি সংগঠনের সহযোগিতায় দেশটির বিভিন্ন রাজ্যের স্কুল পর্যায়ে তথ্য-প্রযুক্তির শিক্ষা নিয়ে কাজ করছেন পাভেল। এছাড়া বিশ্বের ১৭টি দেশে এখন ইয়ুথ হাবের ধারণা নিয়ে কাজ হচ্ছে।

মেয়ে ও নারীদের মাঝে তথ্য-প্রযুক্তি শিক্ষা নিয়ে কাজের জন্য সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী গর্ডন ব্রাউনের সংগঠন দেয়ারওয়ার্ল্ডের আমন্ত্রণে ২০১৯ সালের জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে যোগ দিয়ে বিশ্ব নেতাদের সামনে বক্তব্য দেন পাভেল। তিনি মনে করেন মানসম্মত শিক্ষা কোনো কিছুর জন্য আটকে থাকতে পারে না। তাই সবার মাঝে মানসম্মত শিক্ষা পৌঁছানোর লক্ষ্যে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন ডেমরা আইডিয়াল কলেজ। এছাড়া তিনি কমনওয়েলথ ইয়ুথ ইনোভেশন হাবের একজন তথ্য-প্রযুক্তি বিষয়ক পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।

পাভেল গুগলের বিভিন্ন পরিষেবা ও কমিউনিটির সঙ্গে যুক্ত আছেন দির্ঘদন ধরে। তিনি একজন গুগল ম্যাপ এক্সপার্ট, গুগল প্রত্যয়িত শিক্ষাদাতা, গুগল স্ট্রিট ভিউ ট্রাস্টেড ও গুগল ক্রাউডসোর্সের প্রতিনিধি। ২০১৭ সালে গুগলের আমন্ত্রণে যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ার মাউন্টেন ভিউতে গুগলের প্রধান কার্যালয়ে যান তিনি। এছাড়া গুগল কমিউনিটির হয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করেন। গুগলের অফিসিয়াল ব্লগ, লোকাল গাইডস কানেক্টে ‘মিট দ্য কাপল দ্যাট গাইডস টুগেদার’ শিরোনামে ফিচার হন তিনি। এছাড়া ২০১৮ সালে গুগল ক্রাউডসোরাস থেকে সেরা কমিনিটি লিডারের অ্যাওয়ার্ড পান পাভেল। উদ্ভাবনী নানবিধ উদ্যোগের জন্য মালয়েশিয়া প্রবাসীদের মাঝে একজন পরিচিত মুখ হয়ে উঠেছেন তিনি। সম্প্রতি মালয়েশিয়া প্রবাসীদের পাসপোর্ট রি-ইস্যুর সেবা সহজ করার জন্য তার তৈরি সফটওয়্যার অনেক জনপ্রিয়তা পেয়েছে।

এছাড়া তিনি ২০১৫ সালে বিডিওএসএন থেকে নবীন উদ্যোক্তা পদক ও ২০১৬ সালে সেরা উদ্ভাবনী মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন নির্মাণের জন্য সম্মাননা পেয়েছেন। পাভেল বলেন, বিদেশের মাটিতে আমরা প্রত্যকেই এক একটি লাল সবুজের পতাকা। তিনি বিশ্বের দরবারে বাংলাদেশকে আরও সম্মানের সঙ্গে তুলে ধরতে চান।

মালয়েশিয়ার ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে বাংলাদেশিদের অবদান
কুয়ালালামপুরের টুইন টাওয়ার, এম আরটি, তুনরাজ্জাক এক্সচেঞ্জ, কে এল টাওয়ার, সানওয়ে পিরামিড, সাইবার জায়া, পোর্টক্লাং, পেনাংয়ের বাতুফিরিঙ্গি সৈকত, তেরেঙ্গানুর মসজিদ, মেলাকার মালয় রেস্তোরাঁ, পাহাঙ্গের চা বাগান, পেরাকের রাবার বাগান, লংকাউই দ্বীপ, পাম অয়েল সর্বত্র রয়েছে বাংলাদেশিদের শ্রম ও ঘাম। স্বপ্নের মতো দেশটির এই চাকচিক্যময় রূপের পেছনে সবচেয়ে বেশি অবদান রেখেছেন বাংলাদেশি শ্রমিকরাই।

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার এই দেশটির প্রশস্ত রাস্তা, উঁচু দালান-কোঠা সর্বত্রই রয়েছে বাংলাদেশিদের হাতের ছোঁয়া। নিজেদের অক্লান্ত শ্রম ও মেধায় এদেশকে সেই ‘বাংলাদেশির’রাই গড়েছেন। বিদেশের মাটিতে প্রত্যেকেই যেন একেকজন অনন্য বাংলাদেশ।

আডি/ ০৩ ডিসেম্বর

Back to top button