জানা-অজানা

ইউক্রেন যুদ্ধে কোন দেশের অবস্থান কী

এক বছর আগে ইউক্রেনে রুশ আগ্রাসন শুরু হওয়ার পর থেকে বিশ্ব মূলত তিনটি দলে ভাগ হয়ে যায়। একদল ইউক্রেনের পক্ষে, অন্যদল রাশিয়ার। আর একদল নিয়েছে নিরপেক্ষ অবস্থান। যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলো ইউক্রেনকে মোট ১০০ বিলিয়ন ডলারের বেশি সামরিক সহায়তা দিয়েছে। অন্যান্য দেশ রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে বা জাতিসংঘে ভোট দিয়ে তাদের অবস্থান জানিয়েছ। বিভিন্ন দেশের রাজনৈতিক, সামরিক এবং অর্থনৈতিক অবস্থানগুলো তুলে ধরা হলো:

রাজনৈতিক অবস্থান

একটি দেশ রাজনৈতিকভাবে কোথায় আছে তা জানার উপায় হলো জাতিসংঘে তারা কীভাবে ভোট দেয়, তা পর্যবেক্ষণ করা। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ (ইউএনজিএ) ১৯৩টি সদস্য রাষ্ট্র নিয়ে গঠিত। এটি জাতিসংঘ ব্যবস্থার সবচেয়ে প্রতিনিধিত্বকারী সংস্থা। রেজুলেশনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় প্রতিটি সদস্য রাষ্ট্রকে সমান ভোটের অনুমতি দেওয়া হয়।

জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে পাস হওয়া রেজুলেশনগুলো মানা বাধ্যতামূলক নয়, যার মানে এগুলোর কোনও আইনি ক্ষমতা নেই। এগুলোকে বরং একটি নির্দিষ্ট বিষয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ইচ্ছার অভিব্যক্তি হিসেবে দেখা হয়।

ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনের পর জাতিসংঘ ২৫ বছরের মধ্যে প্রথম জরুরি অধিবেশন ডাকে। ১৯৩ সদস্যের পরিষদ তখন থেকে ইউক্রেন সংক্রান্ত বিভিন্ন উদ্বেগ মোকাবিলায় চারটি বিশেষ প্রস্তাবে ভোট দিয়েছে।

জরুরি অধিবেশন-১ (২ মার্চ, ২০২২)

ইউক্রেন থেকে রাশিয়ার সামরিক বাহিনী প্রত্যাহারের দাবি। ১৪১টি দেশ জাতিসংঘের এই প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দেয় যাতে রাশিয়াকে ‘অবিলম্বে, সম্পূর্ণ এবং নিঃশর্তভাবে’ ইউক্রেন থেকে তার সামরিক বাহিনী প্রত্যাহারের দাবি জানানো হয়। প্রস্তাবটি পাসের জন্য হ্যাঁ/না ভোটের দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার প্রয়োজন ছিল।

চীন, ভারত, ইরান এবং সাউথ আফ্রিকা ৩৫টি দেশের মধ্যে ছিল যারা ভোট দেয়নি। বেলারুশ, ইরিত্রিয়া, উত্তর কোরিয়া, সিরিয়া এবং রাশিয়া- এর বিপক্ষে ভোট দিয়েছে।

জরুরি অধিবেশন-২ (২৪ মার্চ, ২০২২)

ইউক্রেনের বিরুদ্ধে আগ্রাসনের মানবিক পরিণতি। মানে, ইউক্রেনে ত্রাণ ঢুকতে দেওয়া এবং বেসামরিক জানমাল রক্ষায় প্রস্তাবটি তোলা হয়।

ইউক্রেন এবং তার মিত্রদের প্রণীত রেজোলিউশনের পক্ষে ১৪০ দেশ ভোট দেয়। বেলারুশ, ইরিত্রিয়া, উত্তর কোরিয়া, রাশিয়া এবং সিরিয়া বিপক্ষে ভোট দেয়। ৩৮টি দেশ বিরত ছিল। আর ১০টি দেশ ভোটে অনুপস্থিত ছিল।

জরুরি অধিবেশন-৩ (৭ এপ্রিল, ২০২২)

জাতিসংঘ মানবাধিকার কাউন্সিল থেকে রাশিয়াকে বাদ দেওয়া। এ প্রশ্নে ৯৩ দেশ পক্ষে ভোট দেয়, বিপক্ষে ছিল ২৪ দেশ। ভোট থেকে বিরত ছিল ৫৮ দেশ। প্রস্তাবটি পাসের জন্য দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রয়োজন ছিল। কিয়েভের কাছে বুচা শহরে বেসামরিক মৃতদেহ আবিষ্কারের পর এই রেজুলেশন আসে।

জরুরি অধিবেশন-৪ (১২ অক্টোবর, ২০২২)

ইউক্রেনের আঞ্চলিক অখণ্ডতা, ইউক্রেনের কিছু অংশ সংযুক্ত করায় রাশিয়ার নিন্দা। এ প্রস্তাবের পক্ষে ১৪৩ এবং বিপক্ষে ৫ দেশ ভোট দেয়। বিরত ছিল ৩৫ দেশ।

সেপ্টেম্বরের শেষের দিকে রাশিয়া আনুষ্ঠানিকভাবে পূর্ব ও দক্ষিণ ইউক্রেনের চারটি আংশিক দখলকৃত প্রদেশকে সংযুক্ত করার ঘোষণা দেয়। জবাবে কিয়েভ এবং তার পশ্চিমা মিত্ররা ভোটকে অর্থহীন এবং অবৈধ বলে প্রত্যাখ্যান করে এই রেজুলেশন তোলে জাতিসংঘে।

১০২টি দেশ সব রেজুলেশনের পক্ষে ভোট দিয়েছে

আফগানিস্তান, আলবেনিয়া, অ্যান্ডোরা, অ্যান্টিগুয়া ও বার্বুডা, আর্জেন্টিনা, অস্ট্রেলিয়া, অস্ট্রিয়া, বেলজিয়াম, বেনিন, বসনিয়া ও হার্জেগোভিনা, বুলগেরিয়া, কানাডা, চাদ, চিলি, কলম্বিয়া, কোমোরোস, কোস্টারিকা, ক্রোয়েশিয়া, সাইপ্রাস, চেক প্রজাতন্ত্র, ডিআরসি, ডেনমার্ক, জিবুতি, ডোমিনিকা, ডোমিনিকান রিপাবলিক, পূর্ব তিমুর, ইকুয়েডর, এস্তোনিয়া, ফেডারেটেড স্টেটস অফ মাইক্রোনেশিয়া, ফিজি, ফিনল্যান্ড, ফ্রান্স, জর্জিয়া, জার্মানি, গ্রীস, গ্রেনাডা, গুয়াতেমালা, হাইতি, হাঙ্গেরি, আইসল্যান্ড, আয়ারল্যান্ড, ইসরায়েল, ইতালি, আইভরি কোস্ট, জ্যামাইকা, জাপান, কিরিবাতি, লাটভিয়া, লেবানন, লাইবেরিয়া, লিবিয়া, লিচেনস্টাইন, লিথুয়ানিয়া, লুক্সেমবার্গ, মালাউই, মাল্টা, মার্শাল দ্বীপপুঞ্জ, মৌরিতানিয়া, মরিশাস, মলদোভা, মোনাকো, মন্টিনিগ্রো, মরক্কো, নেদারল্যান্ডস, নিউজিল্যান্ড, উত্তর মেসিডোনিয়া, নরওয়ে, পালাউ, পানামা, পাপুয়া নিউ গিনি, প্যারাগুয়ে, পেরু, ফিলিপাইন, পোল্যান্ড, পর্তুগাল, রোমানিয়া, রুয়ান্ডা, সেন্ট লুসিয়া, সামোয়া, সান মারিনো, সাও টোমে এবং প্রিন্সিপে, সার্বিয়া, সেশেলস, সিয়েরা লিওন, স্লোভাকিয়া, স্লোভেনিয়া, সলোমন দ্বীপপুঞ্জ, সোমালিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া, স্পেন, সুইডেন, সুইজারল্যান্ড, বাহামা, তুরস্ক, টুভালু, ইউক্রেন, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, উরুগুয়ে এবং জাম্বিয়া।

৪৭টি দেশ অন্তত একটি রেজুলেশনের পক্ষে ভোট দিয়েছে

অ্যাঙ্গোলা, বাহরাইন, বাংলাদেশ, বার্বাডোস, বেলিজ, ভুটান, বতসোয়ানা, ব্রাজিল, ব্রুনাই, কম্বোডিয়া, কেপ ভার্দে, মিশর, ঘানা, গিনি-বিসাউ, গায়ানা, হন্ডুরাস, ইন্দোনেশিয়া, ইরাক, জর্ডান, কেনিয়া, কুয়েত, লেসোথো, মাদাগাস্কার, মালয়েশিয়া, মালদ্বীপ, মেক্সিকো, নেপাল, নাইজার, নাইজেরিয়া, ওমান, কাতার, সেন্ট কিটস অ্যান্ড নেভিস, সেন্ট ভিনসেন্ট এবং গ্রেনাডাইনস, সৌদি আরব, সেনেগাল, সিঙ্গাপুর, দক্ষিণ সুদান, সুরিনাম, থাইল্যান্ড, গাম্বিয়া, টোগো, টোঙ্গা, ত্রিনিদাদ এবং টোবাগো, তিউনিসিয়া, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ভানুয়াতু এবং ইয়েমেন।

১৬টি দেশ রেজুলেশনের ভোটদানে থেকে বিরত ছিল

আর্মেনিয়া, ক্যামেরুন, এল সালভাদর, নিরক্ষীয় গিনি, ইসোয়াতিনি, গিনি, ভারত, মঙ্গোলিয়া, মোজাম্বিক, নামিবিয়া, পাকিস্তান, সাউথ আফ্রিকা, শ্রীলঙ্কা, সুদান, তানজানিয়া এবং উগান্ডা।

১৯টি দেশ অন্তত একটি রেজুলেশনের বিপক্ষে ভোট দিয়েছে

আলজেরিয়া, বলিভিয়া, বুরুন্ডি, মধ্য আফ্রিকান প্রজাতন্ত্র, কিউবা, ইরিত্রিয়া, ইথিওপিয়া, ইরান, কাজাখস্তান, কিরগিজস্তান, লাওস, মালি, নিকারাগুয়া, চীন, কঙ্গো প্রজাতন্ত্র, তাজিকিস্তান, উজবেকিস্তান, ভিয়েতনাম এবং জিম্বাবুয়ে। ৪টি দেশ সব রেজুলেশনের বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছে বেলারুশ, উত্তর কোরিয়া, রাশিয়া এবং সিরিয়া।

৪টি দেশ কোনও রেজুলেশনেই ভোট দেয়নি

আজারবাইজান, বুরকিনা ফাসো, তুর্কমেনিস্তান এবং ভেনিজুয়েলা। গ্যাবনই একমাত্র দেশ যেটি একটি প্রস্তাবের পক্ষে বা বিপক্ষে ভোট দিয়েছে।

ইউক্রেনকে অস্ত্র দিচ্ছে যারা

জার্মান থিংক ট্যাংক কিয়েল ইনস্টিটিউট ফর দ্য ওয়ার্ল্ড ইকোনমির তথ্য অনুসারে, অন্তত ৩২ দেশ ইউক্রেনকে অস্ত্র, সরঞ্জাম বা সেনাবাহিনীর জন্য আর্থিক সহায়তাসহ সামরিক সহায়তা দিয়েছে।

সামরিক সহায়তা প্রদানকারী ৩২টি দেশের মধ্যে ২৫টি ন্যাটোর সদস্য। এই তালিকায় নেই হাঙ্গেরি। দেশটির প্রধানমন্ত্রী ভিক্টর অরবানের সঙ্গে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে।

যেসব দেশ ইউক্রেনকে অস্ত্র ও সামরিক সরঞ্জাম সরবরাহ করেছে সেগুলোর মধ্যে আছে, অস্ট্রেলিয়া, অস্ট্রিয়া, বেলজিয়াম, বুলগেরিয়া, কানাডা, ক্রোয়েশিয়া, চেক প্রজাতন্ত্র, ডেনমার্ক, এস্তোনিয়া, ফিনল্যান্ড, ফ্রান্স, জার্মানি, গ্রিস, ইতালি, জাপান, লাটভিয়া, লিথুয়ানিয়া, লুক্সেমবার্গ, নেদারল্যান্ডস, নিউ জিল্যান্ড, নরওয়ে, পোল্যান্ড, পর্তুগাল, দক্ষিণ কোরিয়া, রোমানিয়া, স্লোভাকিয়া, স্লোভেনিয়া, স্পেন, সুইডেন, তুরস্ক, যুক্তরাজ্য এবং যুক্তরাষ্ট্র।

ইউক্রেনে পাঠানো সামরিক সহায়তার মধ্যে প্রচলিত অস্ত্রের পাশাপাশি উন্নত সরঞ্জাম এবং আধুনিক অস্ত্র যেমন আর্টিলারি, অ্যান্টি-এয়ারক্রাফ্ট ওয়েপন, অ্যান্টি-ট্যাঙ্ক ওয়েপন, সাঁজোয়া যান, রিকনেসান্স অ্যান্ড অ্যাটাক ড্রোন, হেলিকপ্টার, ছোট অস্ত্র, গোলাবারুদ এবং বডি আর্মার।

জানুয়ারিতে ইউক্রেনে আধুনিক ট্যাঙ্ক পাঠানোর প্রতিশ্রুতি দেয় যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য এবং জার্মানি। যুক্তরাজ্য বলেছে, তারা ১৪টি চ্যালেঞ্জার-২ ট্যাঙ্ক সরবরাহ করবে, জার্মানি ৮৮টি লেপার্ড ট্যাঙ্ক পাঠাতে সম্মত হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র বলছে, যুদ্ধ প্রচেষ্টাকে শক্তিশালী করতে তারা কয়েক ডজন এম১ আব্রাম ট্যাঙ্ক পাঠাবে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, রাশিয়ার প্রতিরক্ষা ফ্রণ্টকে আঘাত এবং মস্কোর দখল নেয়া অঞ্চল পুনরুদ্ধারে সর্বশেষ প্রজন্মের যুদ্ধ ট্যাঙ্কগুলো ইউক্রেনের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ন্যাটো এবং তার মিত্ররা বিশেষ বাহিনীসহ কয়েক হাজার ইউক্রেনীয় সেনাকে প্রশিক্ষণও দিয়েছে।

ইউক্রেনকে সাহায্য প্রদানকারী দেশগুলো

কিয়েল ইনস্টিটিউট অনুসারে, ৪০টি দেশ ২০২২ সালের ২৪ জানুয়ারি থেকে ২০ নভেম্বর পর্যন্ত ইউক্রেনকে আর্থিক, মানবিক এবং সামরিক সহায়তায় কমপক্ষে ১১৫ বিলিয়ন ডলার দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র একাই দেবে ৫১.২ বিলিয়ন ডলার।

ইইউ কমিশন, ইইউ কাউন্সিল এবং ইউরোপীয় বিনিয়োগ ব্যাংকসহ ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিষ্ঠানগুলো ইউক্রেনকে ৩৭.৩ বিলিয়ন ডলার দেওয়ায় প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। যেখানে যুক্তরাজ্য ৭.৬ বিলিয়ন ডলার নিয়ে তৃতীয় স্থানে রয়েছে। এ ছাড়া ২০ নভেম্বর থেকে যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্যান্য দেশগুলো ইউক্রেনকে অতিরিক্ত সামরিক প্যাকেজ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।

যে দেশগুলো রাশিয়াকে নিষেধাজ্ঞা দিচ্ছে

অন্তত ৪৬টি দেশ বা অঞ্চল রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। ২২ ফেব্রুয়ারি থেকে মস্কোর ওপর ১১ হাজার ৩০৭টিরও বেশি নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে; যা রাশিয়াকে বিশ্বের সবচেয়ে নিষেধাজ্ঞাপ্রাপ্ত দেশ হিসেবে পরিণত করেছে। এসব নিষেধাজ্ঞার ৮০ শতাংশ ব্যক্তিকে লক্ষ্য করে; যেখানে ১৮ শতাংশ প্রতিষ্ঠানকে ঘিরে। অবশিষ্ট ২ শতাংশ জাহাজ এবং বিমানকে লক্ষ্য করে।

যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়ার ওপর সর্বাধিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। তারা দিয়েছে ১ হাজার ৯৪৮টি নিষেধাজ্ঞা। এক হাজার ৭৭৭টি সুইজারল্যান্ড, এক হাজার ৫৯০টি কানাডা, এক হাজার ৪১৪টি যুক্তরাজ্য এবং ইইউ এক হাজার ৩৯০টি নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে।

আইএ/ ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৩

Back to top button