এক বছর আগে শুরু হওয়া রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে এখনো ধুঁকছে গোটা বিশ্ব। বিশ্ব অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখা এই দুই দেশের মধ্যকার যুদ্ধ বিশ্ববাণিজ্যের ভারসাম্যকে বিশালভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। বাংলাদেশেও ব্যাপকভাবে এর প্রভাব পড়েছে। জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধিসহ এ সময়ে দেশে ডলারের দাম লাগাতার বেড়েছে। টাকার দাম অনেকখানি পড়েছে। কমে গেছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। ব্যাংকগুলোতে দেখা দিয়েছে ডলার সংকট। আমদানির জন্য এলসি (ঋণপত্র) খোলা ব্যাহত হচ্ছে। শিল্প খাতগুলোতে দেখা দিয়েছে কাঁচামালের সংকট। আমদানিসহ সয ক্ষেত্রে কৃচ্ছ্রসাধন প্রক্রিয়া অবলম্বন করতে বাধ্য হয়েছে সরকার। এরই মধ্যে বিদ্যুৎ ও শিল্প গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়েছে, যা উৎপাদন খরচের সঙ্গে বাজারের পণ্যমূল্যও বাড়িয়ে দিয়েছে। সব মিলিয়ে করোনায় বিপর্যস্ত অর্থনীতির সংকট আরও প্রকট হয়েছে। সবকিছুতে খরচ অতিরিক্ত বেড়ে যাওয়ায় সাধারণ মানুষের জীবনযাপন আরও কঠিনতর হয়ে পড়েছে।
আগামীকাল ২৪ ফেব্রুয়ারি এক বছর পার করতে যাচ্ছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। গত বছরের এই দিনে ইউক্রেনে হামলা করে বসে রাশিয়া। যুদ্ধে ইউক্রেনকে সমর্থন দিয়ে রাশিয়ার ওপর নানা ধরনের অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা দেয় যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলো। এসব নিষেধাজ্ঞার প্রভাব পড়তে থাকে বিশ্ববাজারে। যুদ্ধের জেরে বিশ্ববাজারে জ্বালানির দাম বেড়েছে, সরবরাহ ব্যবস্থা বিঘিœত হয়েছে, ব্যয়ও বেড়েছে। মূল্যস্ফীতির আগুনে পুড়ছে দেশগুলো। বিশ্বে খাদ্যপণ্যের দাম বেড়ে তিন দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছাছে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি কর্মসূচির সূচক রেকর্ড উচ্চতায় রয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো বৈশ্বিক মন্দার আশঙ্কার কথা জানিয়েছে। মন্দা না হলেও এ যুদ্ধের ফলে সাধারণ মানুষের জীবনযাপনের খরচ মারাত্মকভাবে বেড়ে গেছে।
দেশে ভোক্তা অধিকার নিয়ে দীর্ঘসময় কাজ করা সংগঠন কনজিউমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) বলছে, ২০২২ সালে জীবনযাত্রার ব্যয় ১০ দশমিক ০৮ শতাংশ বেড়েছে। ২০২১ সালে এ ব্যয় বেড়েছিল ৬ দশমিক ৯২ শতাংশ। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে জীবনযাত্রার ব্যয় ৩ দশমিক ১৬ শতাংশ বেশি বেড়েছে। করোনার অভিঘাত কাটিয়ে ওঠার আগেই যুদ্ধের প্রভাবে সৃষ্ট মূল্যস্ফীতির চাপে চিঁড়েচ্যাপ্টা সবাই।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর আগের মাসেও (জানুয়ারি) দেশে মূল্যস্ফীতি ছিল ৫ দশমিক ৮৭ শতাংশ। কিন্তু যুদ্ধ শুরুর পর মূল্যস্ফীতির পারদ চড়তে চড়তে জুন মাসে সাড়ে ৭ শতাংশ ছাড়িয়ে যায়। সেখানেই থামেনি, আগস্ট মাসে তা সাড়ে ৯ শতাংশে পৌঁছায়। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) প্রতিবেদনের তথ্য এমনটাই বলছে। যদিও দেশের অর্থনীতিবিদরা বলছেন, মূল্যস্ফীতির এই সরকারি হিসাবে ত্রুটি রয়েছে। প্রকৃত মূল্যস্ফীতি আরও বেশি। এ থেকেই বোঝা যায়, সাধারণ মানুষের ওপর এ যুদ্ধের চাপ কতখানি।
সরকারি হিসাবে গত সেপ্টেম্বর থেকে মূল্যস্ফীতি কমতে শুরু করেছে। যদিও তা সামান্য হারে। বিবিএসের সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী, ডিসেম্বরে দেশের মূল্যস্ফীতি ছিল ৮ দশমিক ৭১ শতাংশ। বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এ হার ৬ থেকে ৭ শতাংশ পর্যন্ত সহনীয়। অর্থাৎ সরকারি হিসাবেই মূল্যস্ফীতি অসহনীয় পর্যায়ে রয়েছে।
বাংলাদেশের অর্থনীতির পাঁচটি ক্ষেত্রে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের অভিঘাত পড়েছে বলে জানান বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান। তিনি বলেন, প্রথমত, এ যুদ্ধের ফলে বৈশ্বিক যে মূল্যবৃদ্ধি হয়েছে তাতে আমদানীকৃত মূল্যস্ফীতি বেড়েছে, রিজার্ভে চাপ পড়েছে, টাকার অবমূল্যায়ন হয়েছে যা মূল্যস্ফীতিকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। দ্বিতীয়ত, সরবরাহ ব্যবস্থার স্বাভাবিক অবস্থা বিঘ্নিত হয়েছে তাতে আমদানিও ব্যাহত হয়েছে। জ্বালানি ও খাদ্য নিরাপত্তায় এর প্রভাব পড়েছে। তৃতীয়ত, ভূ-রাজনৈতিক পরিবর্তন হওয়ায় বাংলাদেশকে বিভিন্ন চাপে পড়তে হচ্ছে।
মোস্তাফিজুর রহমান আরও বলেন, সাহায্যদাতা দেশগুলোর বাজেটের বড় একটি অংশ যুদ্ধের দিকে সরে গিয়েছে। পরিশেষে, বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে ভূ-রাজনীতি এবং বিশ্ব অর্থনীতিতে এখন যে অস্থিরতা সৃষ্টি হয়েছে তা আমাদের মতো ছোট দেশের জন্য ভালো নয়। কারণ এমন একটি পরিবেশে আমাদের মতো দেশগুলোর অর্থনীতিতে মন্দা হবে নাকি মূল্যস্ফীতি আরও বাড়বে- এ নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দেয়। সংকট মোকাবিলায় সরকার যেসব পদক্ষেপ নিয়েছে সেগুলো ভালো। তবে এ ধরনের অনিশ্চয়তা ও ঝুঁকি মোকাবিলায় রাজস্ব আহরণসহ আমাদের অভ্যন্তরীণ শক্তিসামর্থ্যগুলোকে আরও জোরদার করার দিকে নজর দিতে হবে।
দুই দেশের এ সংঘাতের ফলে বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম এক ধাক্কায় ব্যারেলপ্রতি ১০০ ডলার ছাড়িয়ে যায়। সেই সঙ্গে বেড়ে যায় মার্কিন ডলারের বিনিময় মূল্য। ফলে একই পরিমাণ পণ্য আমদানি করতে আগের চেয়ে বেশি ব্যয় করতে হয় দেশগুলোকে। এতে ডলার-সংকটে প্রায় সব দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমতে শুরু করে। বাংলাদেশের রিজার্ভও এ সময় কমেছে। গত বছর জানুয়ারিতে ৪৫ বিলিয়নের কাছাকাছি থাকা রিজার্ভ কমে বর্তমানে সাড়ে ৩২ বিলিয়নে দাঁড়িয়েছে। এর আগে ২০২১ সালে আগস্টে রেকর্ড পরিমাণ ৪৮ বিলিয়ন ডলার রিজার্ভ ছিল বাংলাদেশের।
এই এক বছরে ডলারের বাজার সামাল দিতে হিমশিম খেতে হয়েছে। দেশে গত বছর জানুয়ারি মাসে আন্তঃব্যাংকে প্রতি ডলারের বিক্রয় মূল্য ছিল ৮৫ টাকা। বর্তমানে তা বেড়ে ১০৭ টাকা হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যে এমনটাই বলছে। তবে এ সময় কাব বাজারে ডলারের দাম সর্বোচ্চ ১২২ টাকায়ও বিক্রি হয়। বর্তমানে যা ১১২ টাকা। ডলারের দাম আকস্মিক বেড়ে যাওয়ার প্রভাব পড়েছে অত্যাবশ্যকীয় ছাড়াও প্রায় সব ধরনের ভোগ্য ও ব্যবহার্য পণ্য, জ্বালানি তেল ও শিল্পের মূলধনী যন্ত্র আমদানিতেও।
কোভিডপরবর্তী পরিস্থিতিতে এই যুদ্ধের কারণে সরবরাহ ব্যবস্থা বিঘিœত হওয়ায় বাংলাদেশ বেশি চাপের মুখে পড়ে যায়। সেই সঙ্গে রাজস্ব ঘাটতি, বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হারে হস্তক্ষেপ, ব্যাংকিং খাতে নানা অনিয়মসহ নিজস্ব কিছু দুর্বলতার কারণেও সংকট প্রকট হয়েছে বলে মনে করেন পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর। এসব বিষয়গুলো গুরুত্ব না পাওয়ায় সংকট তীব্র হয়েছে বলে জানান তিনি। তিনি বলেন, ‘বৈশ্বিক সংকট মোকাবিলা করার আগে নিজেদের অভ্যন্তরীণ সমস্যাগুলোর সমাধান করতে হবে। আমাদের অভ্যন্তরীণ নীতিগত সংস্কার প্রয়োজন। আইএমএফের ঋণের ইস্যুতে অনেকগুলো সংস্কারের বিষয় সামনে এসেছে। আগেও এসব সংস্কার নিয়ে আলোচনা হয়েছে। কিন্তু এগুলোর বাস্তবায়ন হচ্ছে না। আমাদের এখন ডলারের প্রয়োজন। সুতরাং এর জন্য প্রয়োজনীয় নীতিগত পরিবর্তন ঘটাতে হবে।’
বিশ্ববাজারে ভুট্টা, গমসহ বেশ কয়েকটি পণ্যের বড় অংশ সরবরাহ করে থাকে ইউক্রেন। একই ধরনের শস্য বড় আকারে সরবরাহ করে রাশিয়াও। তাই দেশ দুটির যুদ্ধের উত্তাপে তেতে ওঠে আন্তর্জাতিক পণ্য বাজার। বাংলাদেশের চাহিদার ৮০ শতাংশ আমদানীকৃত গমের অর্ধেকই আসে ইউক্রেন ও রাশিয়া থেকে। কিন্তু যুদ্ধের কারণে সরবরাহ বাধাগ্রস্ত হওয়ায় দেশের বাজারে আটার দাম বেড়ে যায়। সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্যই বলছে, এক বছরে আটার দাম ৬৫ দশমিক ৭১ শতাংশ বেড়েছে।
অপরদিকে পোল্ট্রি ফিড উৎপাদনের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হচ্ছে ভুট্টা। বিশ্ববাজারের চাহিদার ১৬ শতাংশ ভুট্টা সরবরাহ করে ইউক্রেন। যুদ্ধের ফলে সারাবিশ্বে পোল্ট্রি ফিডের দামও বেড়ে যায়। দেশের বাজারেই দাম প্রায় দ্বিগুণ হয়ে গেছে। ফলে মুরগি ও ডিমের দামও বেড়েছে। টিসিবির হিসাবে এক বছরে ব্রয়লার মুরগির দাম ৩৭ দশমিক ৫ শতাংশ এবং ফর্মের ডিমের দাম ২৭ দশমিক ৬৩ শতাংশ বেড়েছে।
একইভাবে অন্যান্য ভোগ্যপণ্যের দামও এক বছরে অনেক বেড়েছে। টিসিবির হিসাবে, এই সময় সয়াবিন তেলের দাম ১১ দশমিক ২৮ শতাংশ, চিনি ৪৮ দশমিক ৩৯ শতাংশ বেড়েছে। গরিবের অ্যাংকর ডাল ৪০ দশমিক ৭৮, ছোলা ২৩ দশমিক ৩৩ শতাংশ বেড়েছে। এছাড়া আমদানীকৃত রসুন ৫৪ দশমিক ৫৫, শুকনা মরিচ ৬৯ দশমিক ৬৪, আদা ১৬২ দশমিক ৫, জিরা ৮২ দশমিক ৪৩ এবং হলুদের দাম ২৫ শতাংশ বেড়েছে। লেখার কাগজের দাম ২৭ দশমিক ৯১ এবং এসএস রডের দাম ১৯ দশমিক ৬১ শতাংশ বেড়েছে।
কেবল আমদানীকৃত পণ্যই নয়, দেশে উৎপাদিত পণ্যের উৎপাদন খরচও বাড়িয়ে দিয়েছে এ যুদ্ধ। ফলে সেগুলোর বাজারদরও বেড়েছে। টিসিবির প্রতিবেদনে চাল, আটা, ডাল, তেল, চিনি, মসলা, ব্রয়লার ও ডিমের মূল্যবৃদ্ধি পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, এক বছরে এই আটটি প্রয়োজনীয় ভোগ্য পণ্যের দাম গড়ে ৩৯ দশমিক ০২ শতাংশ বেড়েছে। নিত্যপণ্যের দাম ও সার্বিক খরচ বাড়ায় বেকারি পণ্যসহ সব ধরনের খাবারের দামই বেড়েছে। খরচ বেড়ে যাওয়ায় হোটেল-রেস্তোরাঁগুলোতেও খাবারের দাম ৫ শতাংশেরও বেশি বেড়েছে; কমেছে গ্রাহক।
কেবল পণ্যমূল্যের ওপরেই নয়, দেশের মানুষের জীবনমানের ওপরেও এই যুদ্ধের বিরূপ প্রভাব পড়েছে বলে মনে করেন ক্যাব সভাপতি গোলাম রহমান। তিনি বলেন, এই যুদ্ধের অভিঘাতে এক বছরে মানুষের জীবনমান কমেছে। করোনায় বিপর্যস্ত মানুষ এখন মূল্যস্ফীতির সঙ্গে লড়াই করে পেরে উঠছে না। জিনিসপত্রের দাম অত্যাধিক বেড়ে যাওয়ায় টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়েছে। করোনার পর তাদের জীবন আরও সংকটাপন্ন হয়ে পড়েছে। তাদের কিছুটা স্বস্তি দিতে সরবরাহ স্বাভাবিক পর্যায়ে ধরে রাখা এবং দাম সহনীয় পর্যায়ে রাখার সর্বাত্মক চেষ্টা করতে হবে। বাজারে অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি ঠেকাতে হবে।
আইএ/ ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৩