জাতীয়

গবেষণায় এক টাকাও খরচ করেনি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট

সাইফ সুজন

ঢাকা, ২১ ফেব্রুয়ারি – শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন পরিচালিত বিশেষায়িত গবেষণা প্রতিষ্ঠান আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট (আমাই)। বিশ্বের বিভিন্ন বিকাশমান ও বিলুপ্তপ্রায় ভাষার ওপর গবেষণার জন্য ২০১০ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় আমাই। ইনস্টিটিউটটির আইনেও বেশ গুরুত্ব দেয়া হয় গবেষণা খাতকে। আমাই আইনে প্রতিষ্ঠানটির যে ২৩টি মৌলিক দায়িত্বের কথা বলা হয়েছে তার মধ্যে ১০টির বেশি প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে গবেষণাসংশ্লিষ্ট। তবে প্রতিষ্ঠার এক যুগ পার করলেও প্রতিষ্ঠার সেই লক্ষ্য থেকে অনেক দূরে অবস্থান আমাইয়ের। সর্বশেষ ২০২১-২২ অর্থবছরে বিশেষায়িত এ ইনস্টিটিউট গবেষণা খাতে একটি টাকাও ব্যয় করেনি।

১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর জাতিসংঘ বাঙালির অমর একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করে। ঠিক এর পর পরই ওই বছরের ৭ ডিসেম্বর পল্টন ময়দানের এক জনসভায় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমাই প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেন। ওই সময় তিনি বলেন, ‘পৃথিবীর বিকাশমান ও বিলুপ্তপ্রায় ভাষাগুলোর মর্যাদা ও অধিকার রক্ষায় গবেষণার জন্য ঢাকায় একটি প্রতিষ্ঠান আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট স্থাপন করা হবে।’ এরপর ২০০১ সালের ১৫ মার্চ ঢাকার সেগুনবাগিচায় জাতিসংঘের তৎকালীন মহাসচিব কফি এ আনানের উপস্থিতিতে ইনস্টিটিউটটির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়। আর ২০১০ সালের অমর একুশে ফেব্রুয়ারি ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে আমাই ভবনের উদ্বোধন করেন শেখ হাসিনা। আইন অনুযায়ী এ ইনস্টিটিউটের প্রধান পৃষ্ঠপোষক প্রধানমন্ত্রী।

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট আইন, ২০১০-এর ৭ ধারায় আমাইয়ের দায়িত্ব বিষয়ে বলা হয়েছে, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ ও ক্ষুদ্র জাতিগুলোর ভাষা সংগ্রহ, সংরক্ষণ, এ-সংক্রান্ত গবেষণা ও প্রশিক্ষণ কার্যক্রম পরিচালনা; বাংলাসহ অন্যান্য ভাষা আন্দোলন বিষয়ে গবেষণা; বাংলা ভাষার উন্নয়নে গবেষণা ও প্রশিক্ষণ কার্যক্রম গ্রহণ ও পরিচালনা; বাংলাসহ পৃথিবীর সব ভাষার বিবর্তনবিষয়ক গবেষণা; ভাষা বিষয়ে গবেষণার জন্য দেশী-বিদেশীদের ফেলোশিপ প্রদান; ভাষা ও ভাষাবিষয়ক গবেষণায় অবদানের জন্য দেশী ও বিদেশীদের পদক ও সম্মাননা প্রদান; ভাষা বিষয়ে শিক্ষা ও গবেষণার জন্য বৃত্তি প্রদান; গবেষণা কেন্দ্র স্থাপন ও পরিচালনা। এছাড়া আরো কিছু দায়িত্ব বাস্তবায়নে গবেষণার প্রাসঙ্গিকতা রয়েছে।

গবেষণা না হওয়ার বিষয়টি সত্য। তবে বর্তমানে এ বিষয়টির ওপর জোর দেয়া হচ্ছে। গবেষণা বৃত্তির জন্য পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেয়া হয়েছে। শিগগিরই বৃত্তি প্রদান করা হবে —ড. হাকিম আরিফ
মহাপরিচালক, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট

যদিও আইনি এসব নির্দেশনা অনুসরণ করছে না আমাই কর্তৃপক্ষ। আমাইয়ের সর্বশেষ বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২১-২২ অর্থবছরে সরকারের কাছ থেকে ৬ কোটি টাকা বরাদ্দ পায় প্রতিষ্ঠানটি। এর মধ্যে ৪ কোটি ২২ লাখ টাকা ব্যয় করেছে ইনস্টিটিউট। ওই অর্থবছরের বাজেটে প্রতিষ্ঠানটির গবেষণা খাতে বরাদ্দ দেয়া হয় ১২ লাখ টাকা। যদিও গবেষণায় বরাদ্দকৃত অর্থের শতভাগই অব্যয়িত ছিল বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

গত বছরের মার্চে আমাইয়ের মহাপরিচালক পদে যোগ দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যোগাযোগ বৈকল্য বিভাগের অধ্যাপক ড. হাকিম আরিফ। ইনস্টিটিউটে গবেষণা না হওয়া প্রসঙ্গে জানতে চাইলে এ অধ্যাপক বলেন, ‘গবেষণা না হওয়ার বিষয়টি সত্য। তবে বর্তমানে গবেষণা খাতকে গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হচ্ছে। গবেষণা বৃত্তির জন্য পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেয়া হয়েছে। যাচাই-বাছাই শেষে আমরা শিগগিরই গবেষণা বৃত্তি প্রদান করব।’ এর বাইরেও নানা ধরনের গবেষণা কার্যক্রম গ্রহণ প্রক্রিয়াধীন রয়েছে বলে জানান তিনি।

আমাইয়ের সর্বশেষ বার্ষিক প্রতিবেদনে ২০২১-২২ অর্থবছরের বিভিন্ন কার্যক্রম তুলে ধরা হয়েছে। এতে দেখা যায়, বিভিন্ন দিবস পালন ও সরকারের গতানুগতিক প্রশিক্ষণ কার্যক্রম পরিচালনেই বছরের সিংহভাগ সময় পার করেছে প্রতিষ্ঠানটি। এর বাইরে ভাষাসংশ্লিষ্ট কয়েকটি প্রশিক্ষণ কর্মশালা, সেমিনার ও সম্মেলনের আয়োজন করা হয়েছে, যা খুবই নগণ্য।

সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষা বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ আসাদুজ্জামান বলেন, ‘ইনস্টিটিউটের ধারণাটি বিশেষায়িত গবেষণা ও সেবার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের লক্ষ্যই ছিল বিশ্বের বিভিন্ন ভাষা, বিশেষ করে দেশের অভ্যন্তরীণ যে ভাষাগুলো হারিয়ে যাচ্ছে সেগুলো নিয়ে গবেষণা করা ও তা সংরক্ষণের উদ্যোগ নেয়া। যদিও এখন পর্যন্ত সে ধরনের দৃশ্যমান কোনো কাজ আমাদের গোচরে আসেনি। প্রতিষ্ঠার দু-তিন বছরের মধ্যে কিছু উদ্যোগ নেয়া হলেও পরবর্তী সময়ে তা মাঝপথে আটকে যায়। আমার মতে, যেহেতু ইনস্টিটিউটটি ইউনেস্কোর (জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতিবিষয়ক সংস্থা) ক্যাটাগরি-২ প্রতিষ্ঠান, এটাকে দেশের বাইরে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নিয়ে যাওয়ার সুযোগ রয়েছে। সেক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা গ্রহণ ও তার বাস্তবায়ন প্রয়োজন হবে। পাশাপাশি সরকারের পক্ষ থেকে পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দ, পৃষ্ঠপোষকতা ও পর্যবেক্ষণ বাড়াতে হবে।’

সূত্র: বণিক বার্তা
এম ইউ/২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৩

Back to top button