জানা-অজানা

বেড়েছে যাত্রীদের সুরক্ষা, দায় বেড়েছে এয়ারলাইনস কোম্পানির

গোটা বিশ্বে উড়োজাহাজে আন্তর্জাতিক ফ্লাইট চলাকালে সংঘটিত যেকোনো দুর্ঘটনার ক্ষতি নির্ধারণ ও ক্ষতিপূরণ দেয়া হয় মন্ট্রিল কনভেনশন ১৯৯৯-এর (এমসি৯৯) অধীনে। ইন্টারন্যাশনাল সিভিল এভিয়েশন অর্গানাইজেশনের (আইসিএও) সদস্য প্রায় সব দেশে আগেই চালু হলেও বাংলাদেশে তা কার্যকর হয়েছে গত বছরের নভেম্বরে। এতে ফ্লাইট বাতিল বা বিলম্বিত হলে, ব্যাগেজ বা কার্গো খোয়া গেলে অথবা দুর্ঘটনায় যাত্রীর মৃত্যু বা শারীরিক ক্ষতি হলে সংশ্লিষ্ট এয়ারলাইনসগুলোর প্রদেয় ক্ষতিপূরণের পরিমাণ বেড়েছে কয়েক গুণ। এতে আন্তর্জাতিক ফ্লাইটের যাত্রীদের সুরক্ষার মাত্রাও বেড়েছে। তবে দেশের এয়ারলাইনস খাত এ চাপ নেয়ার সক্ষমতা অর্জন করতে পেরেছে কিনা, সে বিষয়ে এখনো বড় ধরনের সংশয় রয়ে গেছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

তারা বলছেন, এমসি৯৯ কার্যকর হলেও দেশের কোনো কোনো এয়ারলাইনস এখনো এর সঙ্গে সংগতিপূর্ণ সক্ষমতা অর্জন করতে পারেনি। বাংলাদেশ বিমানের মতো এয়ারলাইনসগুলোকে ব্যবসা করতে হচ্ছে আন্তর্জাতিক মেগা ক্যারিয়ারগুলোর সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে। আবার এখন থেকে এয়ারলাইনসগুলোর বীমাসহ ঝুঁকি প্রশমন বাবদ ব্যয়ও অনেকটাই বেড়ে যাবে। আবার অবকাঠামোগত সংকট ও সক্ষমতার অভাবসহ নানা সংকটের মোকাবেলা করেই প্রতিষ্ঠানগুলো টিকে রয়েছে। দেশের এয়ারলাইনস খাতের যাত্রী নিরাপত্তায় এমসি৯৯ কার্যকরের পাশাপাশি প্রতিষ্ঠানগুলোর আর্থিক সক্ষমতা ও দক্ষতা বাড়ানোর দিকেও এখন বিশেষভাবে মনোযোগ দেয়া প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। বিদ্যমান সমস্যাগুলোর দ্রুত সমাধান না হলে সামনের দিনগুলোয় গোটা এয়ারলাইনস খাতে আর্থিক চাপ ও ঝুঁকি ব্যাপক হারে বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

আন্তর্জাতিক বেসামরিক উড়োজাহাজ চলাচল-সংক্রান্ত মন্ট্রিল কনভেনশন ঘোষণা হয় ১৯৯৯ সালে। ওই সময়েই এতে সই করেছিল বাংলাদেশ। তবে বাংলাদেশে তা কার্যকর হয়েছে গত বছরের নভেম্বর থেকে। কনভেনশনের সিদ্ধান্তগুলোকে অনুমোদন দিয়ে তা আইনি কাঠামোর মধ্যে নিয়ে আসতে সময় লেগেছে দুই দশকেরও বেশি। এমসি৯৯ কার্যকরের আগ পর্যন্ত বাংলাদেশের উড়োজাহাজ চলাচল কার্যক্রম হয়েছে ওয়ারশ কনভেনশনের অধীনে। ১৯২৯ সালে গৃহীত ওই ঘোষণা সর্বশেষ সংস্কার হয়েছিল ১৯৭১ সালে।

মন্ট্রিল কনভেনশনে স্বাক্ষরকারী হলেও দেশে তা আইনি কাঠামো না পাওয়ার বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশের বিশেষজ্ঞ মহলে বড় ধরনের আলোচনা দেখা যায় নেপালে ইউএস-বাংলার উড়োজাহাজ বিধ্বস্তের ঘটনার পর। ওই সময় যাত্রীদের ক্ষতিপূরণ নির্ধারণ কীভাবে হবে সে বিষয়ে প্রশ্ন ওঠে। তবে বাংলাদেশে তখনো মন্ট্রিল কনভেনশনের সিদ্ধান্তগুলো আইনি কাঠামোর মধ্যে না আসায় ওয়ারশ কনভেনশনের অধীনেই যাত্রীদের ক্ষতিপূরণ দেয়া হয়। তবে এ নিয়ে নেপালের ক্ষতিগ্রস্তরা আপত্তি তোলে। নেপালে এমসি৯৯ আগে থেকেই অনুমোদিত হওয়ায় তারা এর অধীনে ক্ষতিপূরণ দাবি করে বসেন।

এমসি৯৯-এ ক্ষতিপূরণ নির্ধারণ হয় আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) নির্ধারিত বিশেষ মুদ্রা স্পেশাল ড্রয়িং রাইটসের (এসডিআর) মাধ্যমে। এমসি৯৯-এ যাত্রীর মৃত্যু বা অঙ্গহানির ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ক্ষতিপূরণ নির্ধারণ করা হয়েছিল মাথাপিছু ১ লাখ এসডিআর। পরে ২০১৯ সালে তা সংশোধন করে নির্ধারণ করা হয় ১ লাখ ২৮ হাজার ৮২১ এসডিআর, বর্তমান বিনিময় হার অনুযায়ী যা ১ লাখ ৭০ হাজার ডলারেরও বেশি (প্রায় ১ কোটি ৮২ লাখ টাকা)। ক্ষতির মাত্রা এর বেশি হলে এয়ারলাইনসগুলোর পক্ষে তা এড়ানোর সুযোগ রয়েছে। তবে এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট সংস্থাকে প্রমাণ করতে হয় দুর্ঘটনার পেছনে প্রতিষ্ঠানটির অবহেলা কোনোভাবে দায়ী নয় বা তৃতীয় কোনো পক্ষের অবহেলায় এ ঘটনা ঘটেছে। তবে দাবীকৃত ক্ষতিপূরণের পরিমাণ ১ লাখ ২৮ হাজার ৮২১ এসডিআরের কম হলে সংশ্লিষ্ট এয়ারলাইনসের পক্ষে এটি এড়ানোর সুযোগ কম। আগে ওয়ারশ কনভেনশনের অধীনে ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য সংশ্লিষ্ট আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারের সদর দপ্তর অন্য দেশে হলে সেখানে গিয়ে মামলা করার সুযোগ ছিল না। এমসি৯৯-এ বাধা দূর করা হয়। একই সঙ্গে এ দায় বহন ও ঝুঁকি প্রশমনের জন্য সংশ্লিষ্ট সব এয়ারলাইনসের ওপর বীমা করানোটাও বাধ্যতামূলক বলে ঘোষণা করা হয়।

বিষয়টি নিয়ে এখনো ধোঁয়াশার মধ্যে রয়েছেন দেশের এয়ারলাইনস অপারেটররা। এভিয়েশন অপারেটর অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (এওএবি) মহাসচিব ও নভোএয়ারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মফিজুর রহমান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘শুনেছি বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) প্রতিনিধিরা বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে বিদেশ গেছেন। তবে এ নিয়ে বেবিচকের পক্ষ থেকে আমাদের এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো হয়নি। আগে দেখি সেখানে কী আছে। এরপর আমরা সেটি নিয়ে সংগঠনের মধ্যে আলাপ করব।’

এমসি৯৯-এ ফ্লাইট বিলম্বিত বা বাতিলের জন্য সর্বোচ্চ ক্ষতিপূরণ নির্ধারণ করা হয়েছিল ৪ হাজার ১৫০ এসডিআর। সংশোধনের পর এর পরিমাণ দাঁড়ায় মাথাপিছু ৫ হাজার ৩৪৬ এসডিআরে। ডলারে এর পরিমাণ এখন ৭ হাজার ১০০, যা বাংলাদেশী মুদ্রায় সাড়ে ৭ লাখ টাকারও বেশি। প্রসঙ্গত, মন্ট্রিল কনভেনশনের বিধিমালায় কতক্ষণ বিলম্বের জন্য কতটুকু ক্ষতিপূরণ দাবি করা যাবে, তা নির্দিষ্ট করে বলা নেই। এখানে শুধু যাত্রীর ফ্লাইট বিলম্বিত হওয়ার কারণে সংঘটিত আর্থিক ক্ষতির ক্ষতিপূরণ দাবি করার অধিকার সংরক্ষণ করা রয়েছে। বিষয়টি প্রধানত সংশ্লিষ্ট দেশের বেসামরিক উড়োজাহাজ চলাচল কর্তৃপক্ষের নিয়মের ভিত্তিতেই নির্ধারণ করে থাকে। যেমন যুক্তরাজ্যে কোনো যাত্রী কখন ফ্লাইট বিলম্ব বা বাতিলের জন্য ক্ষতিপূরণ দাবি করতে পারবেন, তা নির্ধারণ হয় ফ্লাইটের দূরত্ব ও বিলম্বের মাত্রার ওপর।

ফ্লাইট বিলম্ব বা বাতিলের ক্ষেত্রে বিশ্বের অধিকাংশ দেশে যাত্রীদের মূল্য ফেরত বা বিকল্প ফ্লাইটে গমনের সুযোগ দেয়া হয়। বিলম্ব দীর্ঘায়িত হলে যাত্রীর থাকা-খাওয়া ও বিনোদনের ব্যবস্থা করারও নিয়ম রয়েছে। প্রতিবেশী ভারতে ফ্লাইট বাতিল হলে যাত্রীকে তা ফ্লাইট ছাড়ার নির্ধারিত সময়ের অন্তত দুই সপ্তাহ আগে জানাতে হয়। এক্ষেত্রে এয়ারলাইনসগুলোকে যাত্রীর জন্য বিকল্প ফ্লাইটের ব্যবস্থা করা বা অর্থ ফেরত দেয়ার ব্যবস্থা করতে বলা হয়েছে। এছাড়া এমসি৯৯-এর সঙ্গে সংগতি রেখে যাত্রীকে আর্থিক ক্ষতিপূরণ দেয়ারও নিয়ম রয়েছে। তবে এজন্য টিকিট বুকিংয়ের সময় যাত্রীর দেয়া তথ্য পর্যাপ্ত হতে হয়।

সংশোধিত ক্ষতিপূরণ বিধিতে ব্যাগেজ-সংক্রান্ত ক্ষতির পরিমাণ ধরা হয়েছে মাথাপিছু ১ হাজার ২৮৮ এসডিআর (১ হাজার ৭১০ ডলার বা প্রায় ১ লাখ ৮২ হাজার টাকা)। পণ্য পরিবহনের ক্ষেত্রে সংশোধিত বিধিতে ক্ষতির পরিমাণ প্রতি কেজিতে ২২ এসডিআর (২৯ ডলার বা ৩ হাজার ৮০ টাকা)।

এমসি৯৯ কার্যকর হওয়ার পর থেকে দেশে বেসামরিক উড়োজাহাজ চলাচল খাতের দায় এখন বহুলাংশে বেড়েছে। তবে বাড়তি এ দায় বহনের সক্ষমতা খাতসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর তৈরি হয়েছে কিনা সে বিষয়ে প্রশ্ন তুলছেন বিশেষজ্ঞরা। এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ কাজী ওয়াহিদুল আলম এ প্রসঙ্গে বলেন, নিঃসন্দেহে বিষয়টি দেশের এয়ারলাইনস খাতের যাত্রীদের জন্য সুখবর। কিন্তু এটি কার্যকর হওয়ার পর দেশের এয়ারলাইনস প্রতিষ্ঠানগুলো বড় ধরনের সমস্যায় পড়বে। এমনিতেই প্রতিষ্ঠানগুলোকে টিকে থাকতে হচ্ছে মেগা ক্যারিয়ারগুলোর সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে। এর মধ্যে বিশাল আর্থিক ঝুঁকিকে প্রশমন করতে গিয়ে অতিরিক্ত বীমা ব্যয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে আরো সমস্যায় ফেলবে।

বিশেষ করে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের আর্থিক চাপ সামনের দিনগুলোয় আরো বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। ২০২২ সালের সমাপ্ত হিসাব বছরে প্রতিষ্ঠানটির পুঞ্জীভূত লোকসান দাঁড়িয়েছে ৬৪০ কোটি টাকার বেশিতে। প্রতিষ্ঠানটির আর্থিক সক্ষমতা ও পরিচালন দক্ষতা এখনো অনেকটাই প্রশ্নবিদ্ধ। এ অবস্থায় বাড়তি আর্থিক দায় ও বীমা ব্যয় বাংলাদেশ বিমানের জন্য বড় ধরনের চাপ হয়ে দাঁড়াতে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

তবে এমসি৯৯ দেশের এভিয়েশন খাতে ঝুঁকি বাড়ানোর পাশাপাশি নতুন সম্ভাবনাও তৈরি করেছে বলে মনে করছেন অনেকে। বিধিমালাটি কার্যকর না হওয়ায় ফ্লাইট নিরাপত্তা সূচকে বাংলাদেশের অবস্থানকে এগিয়ে নেয়া অনেকাংশেই কঠিন হয়ে পড়েছিল। ফ্লাইট নিরাপত্তায় দুর্বলতার কারণ দেখিয়ে ২০০৯ সালে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষকে (বেবিচক) দ্বিতীয় ক্যাটাগরির নিয়ন্ত্রণ সংস্থা হিসেবে চিহ্নিত করে যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল এভিয়েশন অথরিটি (এফএএ)। ওই সময় ক্যাটাগরি-১-এ উন্নীত হতে কিছু শর্ত দেয়া হয়। এর অন্যতম ছিল এমসি৯৯ কার্যকর করা। এফএএর ক্যাটাগরি-১ ছাড়পত্র না থাকায় ঢাকা-নিউইয়র্ক রুটে পুনরায় ফ্লাইট চালু করতে পারছিল না বিমান।

এম ইউ/২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৩

Back to top button