সেন্ট্রাল এসি থাকায় আগুন দ্রুত ছড়ায়
ঢাকা, ২১ ফেব্রুয়ারি – রাজধানীর গুলশানে যে ভবনটিতে আগুন লাগে সেখানে সেন্ট্রাল এসি (কেন্দ্রীয় শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা) ছিল। অর্থাৎ বাড়িটির একটি নির্দিষ্ট স্থান থেকে সবগুলো ফ্ল্যাটে এসির সংযোগ দেওয়া হয়। আগুন লাগার পর এসির লাইন দিয়ে প্রত্যেক ফ্লোরে ধোঁয়া বের হয়। এতে আগুন এবং বাসিন্দাদের মধ্যে আতঙ্ক উভয়ই দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। ব্যয়বহুল ভবনটির সব ফ্ল্যাটেই ছিল আধুনিক সুযোগ-সুবিধা। প্রশিক্ষিত ফায়ার ফাইটারও ছিল সার্বক্ষণিক। ভবন নির্মাণের সময় প্রকৌশলীর দায়িত্বে থাকা মাহফুজুল হাসান এসব তথ্য দেন। তিনি জানান, এলার্ম বাজার পরও ভবন থেকে নামতে দেরি করেছেন অনেকে। সচেতনতার অভাবে হতাহতের ঘটনা ঘটেছে। তবে ফায়ার সার্ভিসের পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটির প্রধান লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম চৌধুরী বলছেন, ভবনটি অত্যাধুনিক হলেও এতে অনেক সমস্যা ছিল। এর কোনো ফায়ার সেফটি লাইসেন্সও ছিল না।
এদিকে অগ্নিকাণ্ডের সময় লাফিয়ে পড়ে আহত রাজু (৩৮) নামে আরও একজনের মৃত্যু হয়েছে। এছাড়া আহত ১০ জনের মধ্যে জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে একমি গ্রুপের পরিচালক ফাহিম সিনহার স্ত্রী সায়মা রহমান সিনহা।
সোমবার ক্ষতিগ্রস্ত ভবনটি ঘুরে এসে লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম চৌধুরী সাংবাদিকদের বলেন, ভবন মালিক কর্তৃপক্ষ ফায়ার সার্ভিসের কাছ থেকে একটা এনওসি নিয়েছিল। এরপর তাদের যথাযথ পরিদর্শন সাপেক্ষে ফায়ার সেফটি লাইসেন্স নেওয়ার কথা ছিল। যা তারা নেননি। ভবনের বাসিন্দাদের অগ্নিনির্বাপণী প্রশিক্ষণ এবং মহড়ার অভিজ্ঞতাও ছিল না। মহড়া না হওয়ায় ওপর থেকে লাফিয়ে পড়ে দুটি মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে বলে মনে করেন লেফটেন্যান্ট কর্নেল তাজুল।
তিনি বলেন, আমরা তাদের বারবারই বলছিলাম, লাফ দেবেন না, আমরা আসছি। কিন্তু ঘটনার আকস্মিকতায় তারা হয়তো বুঝে উঠতে পারেননি, কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েছিলেন। এরপর আপনারা দেখেছেন আমাদের লোকরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ভেতরে গিয়ে আটকে পড়া লোকদের উদ্ধার করেছে। নবজাতক শিশুদেরও পরম মমতায় আগলে নিচে নামিয়ে এনেছে ফায়ার সদস্যরা। অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন নিউএজ গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আরিফ ইব্রাহিম। ১০ ও ১১ তলার ডুপ্লেক্স ফ্লোরের বাসিন্দা তিনি। ওই দুটি ফ্লোরের সবকিছু পুড়ে ছাই হয়ে গেছে।
এদিকে অগ্নিকাণ্ডের সময় লাফিয়ে পড়ে আহত রাজু নামে আরও একজনের মৃত্যু হয়েছে। তিনি ওই ভবনের ১২ তলায় একমি কোম্পানির এক কর্মকর্তার বাসায় বাবুর্চির কাজ করতেন। রোববার রাতে ভবনটিতে আগুন লাগার পর রাজু নিচে লাফিয়ে পড়ে আহত হন। পরে তাকে পার্শ্ববর্তী জেড. এইচ. শিকদার উইমেন্স মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সিসিইউতে ভর্তি করা হয়। সেখানে রাত ৩টার দিকে রাজু মারা যান। সোমবার ভোরে রাজুর লাশ গাজীপুরের কালীগঞ্জে গ্রামের বাড়িতে নিয়ে যায় তার পরিবার। সেখানে তাকে সমাহিত করা হয়। রাজুর স্ত্রীর নাম সুমি। তাদের দুই সন্তান। বড় মেয়ের বয়স ১৩ ও ছোট ছেলের বয়স ৯ বছর। এ নিয়ে গুলশানের আগুনের ঘটনায় দুজনের মৃত্যু হলো। আরেকজনের নাম আনোয়ার হোসেন। তিনিও লাফিয়ে পড়ে মারা যান। আনোয়ার বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) পরিচালক ফাহিম সিনহার বাসায় বাবুর্চি হিসাবে কাজ করতেন। এ ঘটনায় আহত হয়েছেন অন্তত ১০ জন, যাদের মধ্যে তিনজনকে ভর্তি করা হয়েছে শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে। মুসা শিকদার এবং রওশন আলী নামে দুজন প্রচণ্ড ধোঁয়ায় অসুস্থ হয়েছেন। তাদের বার্ন ইনস্টিটিউটের জরুরি বিভাগে চিকিৎসা দিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।
আহত সায়মা রহমান সিনহাকে শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউট হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যাকেন্দ্রে ভর্তি করা হয়েছে। তিনি কোমর থেকে শরীরের নিচের অংশে গুরুতর আঘাত পেয়েছেন। লাফিয়ে পড়ার আগে ধোঁয়ায় তার শ্বাসনালিও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ৩৭ বছর বয়সি সায়মা একমি গ্রুপের পরিচালক ফাহিম সিনহার স্ত্রী। ফাহিম বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড এবং আবাহনী ক্রিকেট একামেডির সঙ্গেও জড়িত।
শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের একজন চিকিৎসক বলেন, সায়মা রহমান সিনহা প্রথমে লিফটে আটকে পড়েছিলেন। পরে তিনি ভবনের ওপর থেকে সুইমিংপুলে লাফ দেন।
শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের সমন্বয়ক ডা. সামন্ত লাল সেন জানিয়েছেন, অগ্নিকাণ্ডে আহতদের চিকিৎসায় সোমবার দুপুরে মেডিকেল বোর্ড গঠন করা হয়েছে। তিনি বলেন, আমরা একটা মেডিকেল বোর্ড করেছি। আমরা বসব। সেখানে সব বিষয়ে সিদ্ধান্ত হবে। মেডিকেল বোর্ডে আর কারা আছেন সে বিষয়ে তাৎক্ষণিকভাবে কিছু বলেননি তিনি।
সোমবার ঘটনাস্থলে উপস্থিত ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা জানান, ভেতরে কোনো লাশ রয়েছে কিনা, কোথাও আগুনের কুণ্ডলী কিংবা এখনো ধোঁয়া উড়ছে কিনা তা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছেন তারা। বেলা ১১টার দিকে ভবন থেকে বের হওয়া একজন ফায়ার ফাইটার বলেন, আগুন নিভলেও ভবনটির সপ্তম তলায় ভোর সাড়ে ৫টার দিকে ধোঁয়া উড়তে দেখা যায়। সেখানে নতুন করে পানি দেওয়া হয়েছে। আগুনের সম্ভাব্য কারণ অনুসন্ধান করা হচ্ছে।
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের ঢাকা জোন-৩ এর উপসহকারী পরিচালক মো. সফিকুল ইসলাম বলেন, ভবনটির সিঁড়ির পাশেই ঘটনা ঘটেছিল। বের হতে ঝুঁকি থাকায় অনেকেই আটকা পড়েন। অত্যন্ত ঝুঁকি নিয়ে আগুন নির্বাপণসহ অনেক লোককে উদ্ধার করতে সক্ষম হয় ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা।
ভবনটির এক বাসিন্দা বলেন, আধুনিক এ ভবনে ফায়ার ফাইটিংয়ের সব ব্যবস্থাই ছিল। কিন্তু কোনোটাই কাজ করেনি।
যা বললেন ভবনের প্রকৌশলী : সোমবার ঘটনাস্থলে আসেন ভবনটির প্রকৌশলী মাহফুজুল হাসান। এ সময় তিনি সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন। মাহফুজুল হাসান বলেন, আগুন লাগার সঙ্গে সঙ্গে এলার্ম বেজেছে।
যারা নিচের দিকে ছিলেন তারা নেমে নিরাপদ স্থানে চলে গেছেন। আগুন লাগার পর প্রত্যেকেই যদি সিঁড়ি দিয়ে বের হয়ে যেতেন তাহলে সবাই নিরাপদে বের হয়ে যেতে পারতেন। তিনি বলেন, অনেক সময় ভুল এলার্ম হয়। যারা বাসায় ছিলেন তারা মনে করেছিলেন ভুল এলার্ম হয়েছে। যখন তারা দেখেছে আগুন এবং নিচ থেকে বলছিল ‘আগুন লেগেছে, সবাই নেমে যান’, তখন যে যতটুকু সময় পেয়েছে তার মধ্যেই নেমে এসেছে।
মাহফুজুল হাসান আরও বলেন, অগ্নিদুর্ঘটনা থেকে বাঁচার জন্য সব ব্যবস্থাই ছিল। ভবনে অগ্নিনির্বাপণ প্রশিক্ষণের একটি টিমও ছিল, তারা তাৎক্ষণিক ব্যবস্থাও নিয়েছে। তিনি বলেন, ভবনটিতে নিজস্ব ফায়ার হাইড্রেন্ট ও ডিটেকশন সিস্টেম ফাংশনাল ছিল। ফায়ার এক্সিট পয়েন্ট বা ডোরও ছিল। রাজউক থেকে যে সার্টিফিকেট দেওয়া হয়, ওটাও নেওয়া আছে।
রোববার সন্ধ্যা ৭টার দিকে গুলশান-২ নম্বরের ১০৪ নম্বর রোডের ১২ তলা ভবনটির ৭ম তলায় আগুন লাগে। খবর পেয়ে প্রথমে ফায়ার সার্ভিসের ৭টি ইউনিট আগুন নিয়ন্ত্রণে কাজ শুরু করে। কিন্তু আগুনের তীব্রতা বেড়ে যাওয়ায় পরে ১৯টি ইউনিট আগুন নেভানোর কাজে যুক্ত হয়।
সূত্র: যুগান্তর
এম ইউ/২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৩