জাতীয়

ডলার ক্রয় বিক্রয়ে অননুমোদিত কাজে জড়িয়ে পড়ছে ব্যাংক

হাছান আদনান

ঢাকা, ১৪ ফেব্রুয়ারি – ডলারপ্রতি ১০৯ টাকা দিয়ে গত সপ্তাহে কুয়েতের একটি মানি এক্সচেঞ্জ থেকে রেমিট্যান্স কিনেছে দেশের বেসরকারি খাতের একটি ব্যাংক। ২০ লাখ ডলার রেমিট্যান্সের জন্য ব্যাংকটির অতিরিক্ত ব্যয় হয়েছে ৪০ লাখ টাকা। বাড়তি এ খরচকে রেমিট্যান্স ক্রয় হিসেবে না দেখিয়ে দেখানো হয়েছে ব্যাংকের ব্যবসা সম্প্রসারণ ব্যয় হিসেবে। মানি এক্সচেঞ্জটির কাছে ব্যাংকটি অতিরিক্ত অর্থ পাঠিয়েছিল অননুমোদিত ও অবৈধ পন্থায়।

দ্বিতীয় প্রজন্মের ওই বেসরকারি ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানান, বেশি দাম দিয়ে হলেও রেমিট্যান্সের ওই ডলার কিনতে তারা বাধ্য হয়েছিলেন। ওই দিনই ব্যাংকটিকে প্রায় ৫০ লাখ ডলারের এলসি দায় পরিশোধ করতে হতো। বিদেশী ব্যাংকের কাছে নিজেদের প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে ব্যাংকের কর্মকর্তারা জেনেবুঝেই এ অননুমোদিত কাজে জড়িয়েছেন।

রেমিট্যান্সের ডলার কিনতে গিয়ে ব্যাংকগুলোর এমন অননুমোদিত কাজে লিপ্ত হওয়ার অনেক গল্প এখন শুনতে পাওয়া যাচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে রেমিট্যান্সের ডলারের বিনিময় হার ১০৭ টাকা নির্ধারণ করে দেয়ার পর থেকেই এ ধরনের ঘটনা ঘটছে। তবে বর্তমানে বেশি দরে ডলার কেনার প্রবণতাটি বেশ বেড়েছে। বিশেষ করে দেশের রেমিট্যান্স আয়ের সাম্প্রতিক প্রবৃদ্ধির পেছনে এ প্রবণতার বড় ভূমিকা রয়েছে বলে মনে করছেন ব্যাংক নির্বাহীরা।

শুধু রেমিট্যান্স কেনার ক্ষেত্রেই নয়, রফতানি আয় প্রত্যাবাসন ও আমদানি দায় পরিশোধের ক্ষেত্রেও ব্যাংকগুলো এ ধরনের কার্যক্রমে জড়াচ্ছে বলে জানা গেছে। বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেনের সঙ্গে সম্পৃক্ত ব্যাংকগুলোর সংগঠন ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলারস অ্যাসোসিয়েশনের (বাফেদা) ঘোষিত দর অনুযায়ী, রফতানি আয় নগদায়নের ক্ষেত্রে প্রতি ডলারের সর্বোচ্চ বিনিময় হার হবে ১০৩ টাকা। কিন্তু দেশের অনেক ব্যাংকই এখন রফতানিকারকদের এর চেয়ে বেশি দরে ডলার দিচ্ছে। এক্ষেত্রে বাড়তি দেয়া অর্থ দেখানো হচ্ছে ব্যাংকের বিবিধ খাতের ব্যয় হিসাবে। আবার আমদানির ঋণপত্র (এলসি) খোলার ক্ষেত্রেও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা মানছে না অনেক ব্যাংক। যেকোনো মূল্যে এলসি খুলতে চান, এমন ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে ডলারপ্রতি ১ থেকে ৩ টাকা পর্যন্ত বেশি নেয়া হচ্ছে। দেশের ডজনখানেক ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহী বা সংশ্লিষ্ট বিভাগের কর্মকর্তারা বিষয়টি কাছে স্বীকারও করেছেন। তবে নিয়ন্ত্রক সংস্থার পক্ষ থেকে শাস্তির মুখে পড়ার আশঙ্কায় তাদের কেউই নাম প্রকাশ করে বক্তব্য দিতে রাজি হননি।

এ বিষয়ে ব্যাংক নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) নেতৃস্থানীয় এক ব্যক্তি বলেন, কিছু ব্যাংকের রেমিট্যান্সের প্রবৃদ্ধি ৪০০ শতাংশেরও বেশি। হঠাৎ করে ওই ব্যাংকগুলোর রেমিট্যান্স বেড়ে যাওয়ার বিশেষ কোনো কারণ নেই। ব্যাংকগুলো রেমিট্যান্স হাউজগুলোকে ডলারপ্রতি বাড়তি দর দিচ্ছে। এ কারণে রেমিট্যান্সের প্রবৃদ্ধি হচ্ছে। আবার বাড়তি দর না দেয়ায় অনেক ব্যাংকের রেমিট্যান্স প্রবৃদ্ধি কমে গেছে। রেমিট্যান্স আহরণের ক্ষেত্রে শীর্ষস্থানীয় সব ব্যাংকেরই প্রবৃদ্ধি কমেছে।

ব্যাংকগুলো যে রেমিট্যান্স কেনার ক্ষেত্রে বাড়তি বিনিময় হার পরিশোধ করছে, সেটি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতিনির্ধারকরাও জানেন। এবিবির পক্ষ থেকে কয়েক দফায় বিষয়টি বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদারসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের জানানো হয়েছে। তবে এ মুহূর্তে ডলার সংকটের কারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিষয়টিকে নমনীয়ভাবে দেখছে বলে একাধিক ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহী মন্তব্য করেছেন।

বৈদেশিক বাণিজ্যে অস্বাভাবিক মুনাফা করায় গত বছরের আগস্টে দেশের ছয়টি ব্যাংকের ট্রেজারি প্রধানকে সরিয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত দিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। ওই ছয়টি বেসরকারি ও বিদেশী ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহীকে শাস্তির মুখোমুখি করার উদ্যোগও নেয়া হয়েছিল। এর বাইরে আরো ডজন খানেক ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহীকে সতর্ক বার্তা দেয়া হয়েছিল। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওই উদ্যোগের কারণে বৈদেশিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলো এখন আগের চেয়ে বেশি সতর্ক। বেশি দরে রেমিট্যান্সের ডলার ক্রয় বা আমদানিকারকদের কাছে বেশি দরে বিক্রির কোনো প্রমাণ ব্যাংক কর্মকর্তারা রাখতে চাচ্ছেন না। এজন্য এ খাতের বাড়তি ব্যয় ও আয় ব্যাংকের ব্যালান্স শিটে ভিন্ন খাতে দেখানো হচ্ছে।

এ বিষয়ে প্রথম প্রজন্মের একটি বেসরকারি ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহী বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকই তাদের আয়-ব্যয়ে অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় সম্পৃক্ত হতে বাধ্য করেছে। বেশি দরে রেমিট্যান্স কেনার প্রমাণ পেলে শাস্তির মুখে পড়তে পারেন, এ শঙ্কা থেকে তারা নগদে লেনদেন করছেন। এক খাতের ব্যয় ব্যাংকের নথিপত্রে অন্য খাতে দেখাচ্ছেন। আবার নিজেরা হুন্ডির বিরুদ্ধে বললেও অনেক ক্ষেত্রে অর্থ লেনদেনের জন্য হুন্ডিকে বেছে নিচ্ছেন। অস্বচ্ছ এ প্রক্রিয়ায় কোনো ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহী বা অন্য কর্মকর্তারা ব্যক্তিগতভাবে লাভবানের চিন্তা করলে সেটিরও সুযোগ তৈরি হচ্ছে।

ডলার কেনাবেচার ক্ষেত্রে কেউ আইন না মানলে সেটি তার ব্যক্তিগত বিষয় বলে মন্তব্য করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র মো. মেজবাউল হক। তিনি বলেন, রেমিট্যান্সের ডলার ক্রয় কিংবা বৈদেশিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে কেউ অসততার আশ্রয় নিলে সেটি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির ওপর বর্তাবে। সামগ্রিকভাবে দেশের ব্যাংক খাতের চিত্র এক রকম নয়। কোনো ব্যাংক বা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অপরাধের প্রমাণ পেলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেবে।

মেজবাউল হক জানান, দেশের ব্যাংকগুলোর ডলার ধারণক্ষমতা বেড়েছে। ব্যাংকগুলোর হাতে এখন ৩ দশমিক ১৭ বিলিয়ন ডলার রয়েছে। গত মাসেও পরিস্থিতি এমন ছিল না। তার পরও নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের এলসি দায় মেটানোর জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ডলার বিক্রি করা হচ্ছে। দেশের আমদানির নতুন এলসি উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমে এসেছে। পরিস্থিতি অনুকূলে থাকলে দ্রুতই ডলারের চাহিদা স্বাভাবিক পর্যায়ে নেমে আসবে।

এক বছরের বেশি সময় ধরে দেশে ডলারের তীব্র সংকট চলছে। সংকটের কারণে দেশের প্রায় সব ব্যাংকেরই ডলার ধারণ সক্ষমতা দুর্বল হয়ে গেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের বিদ্যমান নীতিমালা অনুযায়ী, দেশের ব্যাংকগুলো নিজেদের রেগুলেটরি ক্যাপিটালের ১৫ শতাংশের সমপরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা নিজেদের কাছে সংরক্ষণ করতে পারে। কোনো ব্যাংকের কাছে ডলার নির্ধারিত মাত্রার চেয়ে বেশি হয়ে গেলে তা কেন্দ্রীয় ব্যাংক বা দেশের অন্য ব্যাংকগুলোর কাছে বিক্রি করতে হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, প্রায় এক বছর ধরে দেশের বেশির ভাগ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার নেট ওপেন পজিশন (এনওপি) নেতিবাচক ধারায় রয়েছে। নিজেদের নস্ট্রো হিসাবে পর্যাপ্ত ডলার না থাকায় বেশ কয়েকটি ব্যাংকের আমদানির এলসি দায় এক-দুই মাস পর্যন্ত বিলম্ব হচ্ছে বলে বিদেশী ব্যাংকগুলোর কাছ থেকে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

তবে সাম্প্রতিক সময়ে ব্যাংকগুলোর এনওপি পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে বলে বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ফরেক্স রিজার্ভ অ্যান্ড ট্রেজারি ম্যানেজমেন্ট বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, গত ১ ফেব্রুয়ারি দেশের ব্যাংকগুলোর ধারণকৃত ডলারের পরিমাণ ছিল প্রায় ২৫০ কোটি ডলার। গতকাল ব্যাংকগুলোর ধারণকৃত ডলারের পরিমাণ বেড়ে ৩১৭ কোটি ডলারে উন্নীত হয়েছে। ব্যাংক খাত বৈদেশিক মুদ্রার সামগ্রিক এনওপি ঘাটতি কাটিয়ে উঠেছে। গতকাল এনওপিতে ১ কোটি ৮০ লাখ ডলার উদ্বৃত্ত ছিল। তবে বেশকিছু ব্যাংকের এনওপিতে এখনো বড় ধরনের ঘাটতি রয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।

গত অর্থবছরে রেকর্ড ৮৯ বিলিয়ন ডলারের আমদানির ধাক্কায় দেশের বৈদেশিক মুদ্রাবাজারে অস্থিরতা তৈরি হয়। প্রতি ডলারের বিনিময় হার ৮৫ টাকা থেকে বেড়ে ১১৪ টাকা পর্যন্ত ওঠে। আর খুচরা বাজারে তা উঠে যায় ১২০ টাকা পর্যন্ত। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কঠোর অবস্থানের কারণে ডলারের দাম বর্তমানে কিছুটা কমে এসেছে। ব্যাংক খাতে গতকাল প্রতি ডলারের সর্বোচ্চ বিনিময় মূল্য ছিল ১০৭ টাকা।

আমদানি দায়ের পাশাপাশি সরকারি-বেসরকারি খাতের বিদেশী ঋণের কিস্তি পরিশোধের জন্য অব্যাহতভাবে রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করে বাংলাদেশ ব্যাংক। রিজার্ভ থেকে গত অর্থবছরে প্রায় সাড়ে ৭ বিলিয়ন ডলার বিক্রি করা হয়। চলতি অর্থবছরে গতকাল পর্যন্ত (১ জুলাই থেকে ১৩ ফেব্রুয়ারি) রিজার্ভ থেকে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর কাছে বিক্রি করা হয়েছে ৯ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার। ব্যাংকগুলোর কাছে গতকালও ৬ কোটি ৪০ লাখ ডলার বিক্রি করা হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংককে গত এক মাসে প্রতি কর্মদিবসে গড়ে ৬ কোটি ডলার করে বিক্রি করতে হয়েছে। সে হিসাবে এক মাসেই রিজার্ভ থেকে ১২০ কোটি ডলারের বেশি বের হয়ে গেছে। এতে চাপের মুখে পড়ে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। ২০২১ সালের আগস্টে ৪৮ বিলিয়নে উন্নীত হওয়া রিজার্ভের পরিমাণ এখন ৩২ বিলিয়ন ডলারের ঘরে নেমে এসেছে।

দেশে মোট রিজার্ভের পরিমাণ গতকাল দিন শেষে ছিল ৩২ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলার। তবে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) শর্ত অনুযায়ী হিসাবায়ন করলে নিট রিজার্ভের পরিমাণ নেমে আসে ২৪ বিলিয়ন ডলারে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, আইএমফের ঋণসহায়তা হিসাবে চলতি মাসে রিজার্ভে ৪৭ কোটি ৬২ লাখ ডলার যুক্ত হয়েছে। কিন্তু এ সময়ের মধ্যে আইএমএফের ঋণের চেয়ে অনেক বেশি অর্থ রিজার্ভ থেকে বের হয়ে গেছে। এ কারণে রিজার্ভের ক্ষয় রোধ করা সম্ভব হচ্ছে না। প্রতি কর্মদিবসেই ৬০ থেকে ৭০ মিলিয়ন ডলার রিজার্ভ থেকে বের হয়ে গেলে মাস শেষে সেটির পরিমাণ ১২০ কোটি ডলার ছাড়িয়ে যায়। মার্চের প্রথম সপ্তাহে এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) এক বিলিয়ন ডলারের বেশি দায় পরিশোধ করতে হবে। আকুর দায় পরিশোধ সম্পন্ন হলে রিজার্ভের পরিমাণ ৩১ বিলিয়ন ডলারের ঘরে নেমে আসবে।

সূত্র: বণিক বার্তা
এম ইউ/১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৩

Back to top button