দক্ষিণ এশিয়া

ভারতে ‘আপনি-তুই’ সম্বোধন নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শোরগোল

গীতা পাণ্ডে

নয়াদিল্লি, ১৩ ফেব্রুয়ারি – ভারতের কাউকে সম্বোধন করতে কোন সর্বনাম ব্যবহার ব্যবহার করবেন? আপনি কি তাকে সম্মানসূচক “আপনি” বলে সম্বোধন করবেন, অথবা প্রচলিত লৌকিকতার ধার না ধেরে “তুই” ব্যবহার করবেন, অথবা মাঝামাঝি পথ নিয়ে “তুমি” শব্দটি বেছে নেবেন?

গত পাঁচ-ছদিন ধরে ভারতে সোশ্যাল মিডিয়া প্লাটফর্ম টুইটারে বহু মানুষ এ নিয়ে বিতর্কে লিপ্ত হয়েছে। ।

সপ্তাহের শুরুর দিকে এই বিতর্ক শুরু করেন প্রতিভা নামে ৩১ বছরের এক নারী।

দিল্লির এই বাসিন্দা তার এক পোস্টে লেখেন অপরিচিত একজনকে হঠাৎ করে “তুই বলে সম্বোধন করাটা একধরণের রুঢ়তা, অভদ্রতা।

“মুম্বাইয়ের বাসিন্দাদের সাথে কখনই হিন্দিতে কথা বলতে যাবেননা। ঐ ব্যক্তি হয়তো আপনাকে চেনেনই না, কিন্তু নির্দ্বিধায় আপনাকে তুই বলে সম্বোধন করে ফেলবে। অগ্রহণযোগ্য আচরণ।“

এই নিবন্ধে Twitterএর কনটেন্ট রয়েছে। কোন কিছু লোড করার আগে আমরা আপনার অনুমতি চাইছি, কারণ তারা হয়ত কুকি এবং অন্যান্য প্রযুক্তি ব্যবহার করে থাকতে পারে। আপনি সম্মতি দেবার আগে হয়ত Twitter কুকি সম্পর্কিত নীতি এবং ব্যক্তিগত বিষয়ক নীতি প়ড়ে নিতে চাইতে পারেন। এই কনটেন্ট দেখতে হলে ‘সম্মতি দিচ্ছি এবং এগোন’ বেছে নিন।

সম্বোধন নিয়ে তার এই পোস্টটি সাথে সাথে ভাইরাল হয়ে পড়ে। ১০ লাখেরও বেশি মানুষ পোস্টটি দেখেছে। মন্তব্য করেছে এখন পর্যন্ত হাজারেরও বেশি মানুষ।

বিতর্ক শুরু হয়েছে হিন্দি ভাষায় কাউকে সম্বোধন নিয়ে, সর্বনামের প্রয়োগ নিয়ে – কোনটি গ্রহণযোগ্য আর কোনটি নয়।

ভারতে ৪৬ শতাংশ মানুষের প্রধান ভাষা হিন্দি। তবে উত্তর ভারতের বাইরে হিন্দির ব্যবহার সীমিত।

হিন্দি ভাষার আবার একাধিক উপভাষা রয়েছে। অঞ্চল ভেদে একরকম উচ্চারিত হয়, শব্দের প্রয়োগ বদলে যায়।

‘বোম্বাইয়া হিন্দি’ অর্থাৎ মহারাষ্ট্র রাজ্যের মুম্বাই শহরের আদি বাসিন্দাদের হিন্দিতে তু বা তুই শব্দটির ব্যবহার খুবই প্রচলিত। অন্যতম কারণ – মারাঠি ভাষার প্রভাব।

মারাঠি ভাষাতেও তু শব্দটি রয়েছে এবং যে কারো ক্ষেত্রেই শব্দটির প্রয়োগকে অশোভন বলে মনে করা হয়না।

কিন্তু উত্তর ভারতের বিভিন্ন জায়গায় হঠাৎ করে অপরিচিত বা কম পরিচিত কাউকে তু (তুই) বলে সম্মোধন করা অশোভন, অভদ্রতা বলে বিবেচিত হবে।

মারাঠিরা এমনকি হিন্দি দেবতা গণেশ বা ভিতালের বেলাতেও তু শব্দটি ব্যবহার করে। মারাঠি সাহিত্যে, প্রার্থনায় বা ভজন সঙ্গীতেও তু শব্দটির ব্যবহার হয়।

“তু শব্দটি ব্যবহার করে সম্পর্কের ঘনিষ্ঠতা প্রকাশ করা হয়, “ বলেন মারাঠি ভাষা বিভাগের অম্রুতা দারভে। “তু শব্দের প্রয়োগকে কখনই অভদ্রতা হিসাবে ধরা হয়না।“

এই নিবন্ধে Twitterএর কনটেন্ট রয়েছে। কোন কিছু লোড করার আগে আমরা আপনার অনুমতি চাইছি, কারণ তারা হয়ত কুকি এবং অন্যান্য প্রযুক্তি ব্যবহার করে থাকতে পারে। আপনি সম্মতি দেবার আগে হয়ত Twitter কুকি সম্পর্কিত নীতি এবং ব্যক্তিগত বিষয়ক নীতি প়ড়ে নিতে চাইতে পারেন। এই কনটেন্ট দেখতে হলে ‘সম্মতি দিচ্ছি এবং এগোন’ বেছে নিন।

প্রতিভা বলেন তার টুইটটির সূত্র ১০ বছর আগের এক ঘটনা। মুম্বাইতে প্রথমবারের মত এক সহকর্মীর সাথে তিনি একদিন কথা বলছিলেন। ইংরেজিতে কিছুক্ষণ কথা বলার পর ঐ সহকর্মী হঠাৎ হিন্দিতে তাকে প্রশ্ন করেন, “তু হিন্দি মে বাত কার সাকতি হ্যায় (তুই কি হিন্দিতে কথা বলতে পারিস)?”

প্রতিভার জন্য ঐ কথোপকথন ছিল প্রচণ্ড অস্বস্তিকর, কারণ তিনি এমনকি তার বাবা-বা, বড় ভাইকেও ছোটবেলা থেকেই সম্মান করে আপ বা আপনি বলে সম্বোধন করতে অভ্যস্ত। আর অপরিচিত কেউ হলে তো কোনও প্রশ্নই নেই আপনি ছাড়া অন্য কোনও সম্বোধন । শুধুমাত্র ছোটভাই বা নিজের বন্ধুদের বেলায় তুই ব্যবহার করেন প্রতিভা।

“আমি হতভম্ব হয়ে গিয়েছিলাম। আমি মনে করি অপরিচিত বা নতুন পরিচিত কারো সাথে তুই শব্দটি ব্যবহার করে ঘনিষ্ঠ হওয়ার চেষ্টা অনর্থক। সম্পর্কের একটি পর্যায় পর্যন্ত সম্বোধন মার্জিত হওয়া উচিৎ, সম্মানসূচক একটি দূরত্ব রাখা উচিৎ।”

ঘটনাটি নিয়ে টুইটারের তার পোস্টটি এতটা সাড়া ফেলবে প্রতিভা ভাবতে পারেননি। “টুইটারে আমার ফলোয়ারের সংখ্যা দুই হাজারেরও কম। অমি ভেবেছিলাম দু-চারজন এ নিয়ে কথা বলবে এবং আমি তার উত্তর দেব। কিন্তু এখন দেখছি বিতর্ক আর আমার নিয়ন্ত্রণে নেই।“

প্রতিভা বলেন কিছুটা “মজা করতেই” পোস্টটি তিনি দিয়েছিলেন, , কিন্তু তারপরও অনেক মানুষ তাকে ট্রল করছে। তবে সিংহভাগ প্রতিক্রিয়াই মজার। বিভিন্ন অঞ্চলের সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য নিয়ে নানা মানুষ মজা করে লিখছে।

“অনেকে মজা করে অন্যকে খোঁচা মারছে। মি পোস্ট করছে। বলিউডের গানে তু এর জায়গায় আপ জুড়ে পোস্ট করছে।“

অনেকে আবার লিখছে – দুঃখের বিষয় হলো এমন অনেক মানুষ রয়েছে যারা নিজের বেলায় আপনি শব্দটি আশা করে কিন্তু শ্রমজীবী মানুষ বা প্রান্তিক জাতিগোষ্ঠীর মানুষদের নির্দ্বিধায় তুই বলে সম্বোধন করে।

অনেক মানুষ আবার লিখছে কীভাবে তাদেরকে বিশেষ কায়দায়, বিশেষ ভাষায় কথা বলতে জবরদস্তি করা হচ্ছে।

হিন্দির ব্যবহার ভারতে একটি স্পর্শকাতর বিষয়। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ক্ষমতাসীন বিজেপির কজন মন্ত্রী হিন্দিকে ইংরেজির বিকল্প ভাষা হিসাবে ব্যবহারের কথা ওঠাচ্ছেন। এমনকি তারা দেশজুড়ে স্কুলে হিন্দি ভাষায় পড়াশুনার কথা বলছেন। এ নিয়ে অনেক রাজ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া হয়েছে।

পূর্ব এবং দক্ষিণের রাজ্যগুলোতে নানারকম স্থানীয় ভাষা প্রচলিত। বিজেপি মন্ত্রীদের এসব কথা নিয়ে তারা ব্যাপক প্রতিবাদ করেছে।

প্রতিভা বলেন টুইটারে তার এই পোস্টের সুবাদে তিনি অনেক কিছু শিখেছেন। তিনি এখন বুঝতে পারছেন ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের মধ্যে ভাষাগত এবং সংস্কৃতি-গত অনেক পার্থক্য রয়েছে এবং সেগুলো তাদের নিত্যদিনের ভাষায় প্রভাব ফেলে ।

তবে তার মূল বক্তব্যে তিনি অনড়। তার মতে, কেউ যদি অন্য কোনও ভাষায় কথা বলতে চায় তাহলে তা যথার্থভাবে বলা উচিৎ, এবং সেই ভাষার সাথে সম্পৃক্ত স্পর্শকাতরতাগুলোকে বিবেচনায় নেওয়া উচিৎ।

তবে তার এই পোস্টটি যেভাবে মজাদার বিতর্কের ঢেউ তুলছে. তা নিয়ে প্রতিভা উচ্ছ্বসিত।

“অনেক মজা হয়েছে। এবং আমি খুবই সন্তুষ্ট যে পোস্টটি নিয়ে অন্তত ধর্ম আর রাজনীতি নিয়ে লড়াই শুরু হয়নি।“

সূত্র: বিবিসি বাংলা
এম ইউ/১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৩

Back to top button