ঘটনার পিছে ঘটনা থাকে। যাকে আমরা ইতিহাস বলি। ‘আনন্দ আলো বইমেলা প্রতিদিন’ প্রকাশেরও একটা ইতিহাস আছে। এর একটা অংশ সবাই জানেন। অন্য অংশটা শুধু আমি জানি। আজ সে কথাই বলব ভাবছি। সবাই যেটা জানেন সেটা হলো শুধু একুশে বইমেলাকে ঘিরে একটা দৈনিক পত্রিকা বের হবে, বইমেলাকে যদি আমরা একটি মিনি বাংলাদেশ ভাবি তা হলে এই বাংলাদেশকে ঘিরে প্রতিবছর ফেব্রুয়ারি মাসে শুধু বইমেলাকেন্দ্রিক একটা দৈনিক পত্রিকা তো প্রকাশ হতেই পারে। হ্যাঁ, আনন্দ আলো বইমেলা প্রতিদিন-এর সম্পাদক রেজানুর রহমানকে আমি এই ধারণাই দিয়েছিলাম। একজন সংবাদকর্মী হিসেবে একুশে বইমেলাকে ঘিরে রেজানুরের দীর্ঘ অভিজ্ঞতা আছে। বোধ করি সে কারণেই সে সানন্দে বইমেলার দৈনিক পত্রিকা প্রকাশে রাজি হয়ে গেল। বিপুল উৎসাহ ও উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে একুশে বইমেলার একমাত্র দৈনিক আনন্দ আলো বইমেলা প্রতিদিন প্রকাশ হলো। আমাদের অনেক সৌভাগ্য, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পত্রিকাটির প্রথম সংখ্যা হাতে নিয়ে অভিভূত কণ্ঠে বলেছিলেন- বাহ্ সুন্দর তো…
তারপর তো আনন্দ আলো বইমেলা প্রতিদিন বইমেলার ইতিহাসের অংশ হয়ে গেল। বাংলা একাডেমির সাবেক মহাপরিচালক, প্রয়াত ফোকলোরবিদ শামসুজ্জামান খান স্বয়ং বলেছিলেন, আনন্দ আলো বইমেলা প্রতিদিন একুশে বইমেলার ইতিহাসের নবতর সংযোজন। ভবিষ্যতে কেউ যদি বইমেলার ইতিহাস জানতে চায় তা হলে আনন্দ আলো বইমেলা প্রতিদিন-এর মাসব্যাপী সংখ্যাগুলোর সহায়তা নিতে পারবেন। বইমেলার ইতিহাসের একটি প্রামাণ্য দলিল হয়ে উঠেছে আনন্দ আলো বইমেলা প্রতিদিন। এটা তো সবার জানা ইতিহাস। এবার যে ইতিহাসটা কেউ জানেন না সেটাই বলি।
আমার মা দেশবরেণ্য কথাসাহিত্যিক রাবেয়া খাতুন তার জীবদ্দশায় একুশে বইমেলাকে অনেক আপন করে নিয়েছিলেন। মায়ের আগ্রহের কারণে আমি নিজেও বইমেলার প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠি। তখনকার দিনে বাংলা একাডেমির নাম ছিল বাংলা উন্নয়ন বোর্ড। মূল দায়িত্বে ছিলেন এনামুল হক। আমাদের তেজগাঁওয়ের বাসার পাশেই ছিল তার বাসা। গাড়িতে তিনি বাংলা একাডেমিতে আসা-যাওয়া করতেন। তাকে এলাকার মানুষ বেশ সম্মান করতেন। সেজন্য তার ব্যাপারে আমার কৌতূহল ছিল। আম্মা ১৯৭৩ সালে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার পেলেন। সেই অনুষ্ঠানে আমিও উপস্থিত ছিলাম। মনে পড়ে ’৬৯, ’৭০, ’৭১-এর সেই আন্দোলনমুখর সময়ে আব্বা-আম্মা দুজনই প্রায় প্রতিদিন নানা কাজে বাংলা একাডেমিতে যেতেন। আমিও তাদের সঙ্গে যেতাম। জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের উদ্যোগে একটি বইমেলা হতো। সেখানে স্বেচ্ছাসেবকের দায়িত্ব পালন করতাম। বই ও বইমেলার প্রতি দিনে দিনে আমার আগ্রহ বৃদ্ধি পেতে থাকল। একটা সময় বাংলা একাডেমি আমার দ্বিতীয় ঘর হয়ে উঠেছিল।
বইমেলাকে ঘিরে আম্মার অনেক ব্যস্ততা দেখতাম। হঠাৎ আম্মা শারীরিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়লেন। আগের মতো একুশে বইমেলায় যেতে পারেন না। বুঝতে শুরু করলাম এজন্য আম্মার মানসিক কষ্ট হচ্ছে। বইমেলায় যেতে না পারার কষ্ট। যখন সুস্থ ছিলেন প্রায়দিনই বইমেলায় যেতেন। তার লেখক বন্ধুদের সঙ্গে দেখা হতো। আড্ডা হতো। পাঠকের মুখোমুখি হতেন। রাতে বাসায় ফিরে সেই গল্প আমাদের শোনাতেন। কিন্তু শারীরিকভাবে অসুস্থ হওয়ার পর মেলায় যাওয়া বন্ধ হয়ে গেল। এজন্য প্রতিদিনই ছটফট করতেন। তখনই আমার মাথায় এলো আনন্দ আলো বইমেলা প্রতিদিনের আইডিয়া। বইমেলার একটি দৈনিক পত্রিকা। প্রতিদিন যদি আম্মার হাতে তুলে দেওয়া যায় তা হলে মেলায় না যাওয়ার কষ্ট হয়তো ভুলে যাবেন আম্মা।
আনন্দ আলো বইমেলা প্রতিদিন প্রকাশ হলো। আম্মার হাতে তুলে দিলাম। তিনি দারুণ খুশি হলেন। নির্দেশ দিলেন প্রতিদিন যেন তার কাছে পত্রিকাটি আসে। আজ আরও একটি গোপন কথা বলি। আম্মা বেঁচে থাকতে সম্পাদক রেজানুর রহমান নিজ দায়িত্বে আনন্দ আলো বইমেলা প্রতিদিনের নতুন সংখ্যা আমার গাড়িতে তুলে দিত। বাসায় ফেরার পর আমি নিজে আম্মার হাতে পত্রিকা তুলে দিতাম। আম্মা কী যে আনন্দিত হতেন। আম্মার এই আনন্দমাখা মুখ চেয়ে চেয়ে দেখতাম। কোনো কারণে পত্রিকা পৌঁছাতে দেরি হলে আম্মা বেশ ছটফট করতেন। সম্পাদক রেজানুরকে ফোনও দিতেন।
এ বছর ষোলোতে পড়ল আনন্দ আলো বইমেলা প্রতিদিন। বিষয় বৈচিত্র্যে, গুণে-মানে আনন্দ আলো বইমেলা প্রতিদিন অনেক দূর এগিয়েছে। বইমেলার পাঠকদের প্রিয় পত্রিকায় পরিণত হয়েছে। এখনো প্রতিদিন আমার গাড়িতে পত্রিকাটি তুলে দেয় রেজানুর। কিন্তু পত্রিকাটি আমি বাসায় নিই না।
কারণ বাসায় ফিরলে আম্মা আর বলবেন না সাগর পত্রিকাটি এনেছ? অথবা রেজানুরকে ফোন করে বলবেন না সাগর পত্রিকা আনতে ভুলে গেছে। কিছুই থেমে থাকে না। সবকিছুই বহমান এটাই বোধকরি কঠিন সত্য।
আইএ/ ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৩