ডিজিডিপি’র ভুয়া ক্রয়াদেশে মার্কিন ভিসা নেয়ার পাঁয়তারা
ঢাকা, ১০ ফেব্রুয়ারি – ডিরেক্টর জেনারেল ডিফেন্স পারচেজের (ডিজিডিপি) নামে ভুয়া ক্রয়াদেশ দেখিয়ে আমেরিকান সিগন্যাল করপোরেশনকে বিভ্রান্ত করছিল একটি চক্র। চক্রটির মূল উদ্দেশ্য ছিলো সামরিক সরঞ্জাম কেনার নামে ভুয়া ক্রয়াদেশ দেখিয়ে ও প্রশিক্ষণের নামে মার্কিন ভিসা পাওয়া। কিন্তু ঢাকাস্থ মার্কিন দূতাবাস ক্রয়াদেশ যাচাইবাছাই করে তাদের প্রতারণার বিষয়টি জানতে পারে। পরে দূতাবাস বাদি হয়ে গুলশান থানায় মামলা করে। মার্কিন দূতাবাসের অভিযোগ তদন্ত করতে গিয়ে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা বিভাগের (ডিবি) সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগ (উত্তর) সন্ধান পায় এই আন্তর্জাতিক প্রতারক চক্রের। পরে চক্রের মূলহোতাসহ সাত সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়। তারা এর আগেও বহু প্রতারণা করেছে বলে জানিয়েছে ডিবি পুলিশ।
বৃহস্পতিবার রাজধানীর রামপুরা এলাকা থেকে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়। গ্রেপ্তারকৃতরা হলেন- মূলহোতা মো. রেজাউল ইসলাম (৬০), সাইফুল ইসলাম (৪০), মো. আজিজুর রহমান (৪৮), মো. খায়রুল কবির (৩৩), সাদেকুর রহমান (৪১), মো. শাহরিয়ার হোসেন বিক্রম (৩০) ও মুহাম্মদ আবু বক্কর (৪৭)। তাদের কাছ থেকে ২০টি জাল সিল, ২টি সিল প্যাড, ৯টি পাসপোর্ট, ৪টি ভুয়া আইডি কার্ড, ১টি পেনড্রাইভ, ২টি মোবাইল ফোন ও বিভিন্ন ধরনের জাল কাগজপত্র উদ্ধার করা হয়েছে।
ডিবি জানায়, চক্রের মূলহোতাসহ সবাই ব্যবসায়ী। মূলহোতা রেজাউল মাস্টার্স পর্যন্ত লেখাপড়া করেছে। সাইফুল ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং, আজিজুর স্নাতক, খায়রুল বিবিএস, সাদেকুর এসএসসি, শাহরিয়ার এইচএসসি ও আবু বক্কর আলীম পর্যন্ত লেখাপড়া করেছে।
মামলায় এজাহারে বলা হয়, ঢাকাস্থ মার্কিন দূতাবাস ডিজিডিপি’র আদেশ যাচাই-বাছাই করে জানতে পারে নথিতে উল্লিখিত সিলসমূহ জাল, নথিতে স্বাক্ষরকারী ব্যক্তি মেজর মো. বসির আহমেদ আরও পাঁচ বছর আগে ডিজিডিপিতে ছিলেন এবং টেন্ডার ২১১.৩৯৯এফ২২ নথিটি জাল।
সারা এন্টারপ্রাইজের মাধ্যমে বিভিন্ন ব্যক্তি জাল ডিজিডিপি চিঠি তৈরি করে মার্কিন কোম্পানির সঙ্গে কথা বলে প্রতারণা করছে। কোম্পানিটি দাবি করে তারা ১.২ মিলিয়ন ডলারের অধিক মূল্যের সামরিক সরঞ্জাম ক্রয় চুক্তির সঙ্গে জড়িত একটি কোম্পানি। তারা মার্কিন কোম্পানিকে ভিসা অ্যাপয়েন্টমেন্টের জন্য ঢাকাস্থ মার্কিন দূতাবাসের সঙ্গে যোগাযোগ এবং যুক্তরাষ্ট্রে প্রশিক্ষণের জন্য সারা এন্টারপ্রাইজের ৬ জনের ভিসা অনুমোদনের গ্যারান্টি দেয়ার অনুরোধ করে। মূলত তাদের প্রশিক্ষণের কোনো ইচ্ছাই ছিল না। তারা ভিসা অ্যাপয়েন্টমেন্ট পেতে এবং মার্কিন দেশটিতে অবৈধভাবে অভিবাসনের জন্য এটি করেছিল। এ বিষয়ে আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার জন্য মার্কিন দূতাবাস বাদি হয়ে গুলশান থানায় মামলা করে।
প্রাথমিক তদন্তে পাওয়া তথ্যের বরাত দিয়ে তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানান, গ্রেপ্তার রেজাউল ইউএস ভিসা পেতে আমেরিকান কোম্পানির সাথে প্রতারণামূলক কাজের মূলহোতা। ২০১১-১২ সালে নিজ কোম্পানি ডিফেন্স আইকনের মাধ্যমে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে লোকাল টেন্ডারের মাধ্যমে চাল-ডাল ইত্যাদি সরবরাহ করতেন। সরকারি কাজের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে তিনি প্রতারণার এই কৌশল রপ্ত করেন। ডিজিডিপির ক্রয় পদ্ধতির সম্পর্কে বিশেষভাবে পারদর্শী তিনি। এই পারদর্শীতার অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে ২০১৪-১৫ সাল থেকে ১৮ থেকে ২০ লাখ টাকার বিনিময়ে এ ধরনের প্রতারণা করছেন। বিশ্বের বিভিন্ন নামিদামি কোম্পানির সাথে এর আগে এ ধরনের বহু প্রতারণা করেছেন।
ডিবি জানায়, চক্রটি প্রথমে আমেরিকান সিগন্যাল করপোরেশনের কাছে নিজেদের বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সরবরাহকারী হিসেবে পরিচয় দেয়। সারা এন্টারপ্রাইজ পরিচয়ে তারা ১.২ মিলিয়ন ডলারের সামরিক ভুয়া ক্রয় চুক্তি দেখিয়ে মার্কিন কোম্পানিকে ই-মেইল করে। পরে আমেরিকান কোম্পানিটি চক্রের সদস্যদের এবং মার্কিন দূতাবাসে ইনভাইটেশন লেটার পাঠায়। মার্কিন কোম্পানিটির ইনভাইটেশনের চিঠি ও সারা এন্টারপ্রাইজ সামরিক ভুয়া ক্রয় চুক্তি দেখিয়ে মার্কিন দূতাবাসে ভিসার জন্য আবেদন করে। মূলত সারা এন্টারপ্রাইজের মালিক রেজাউল ইসলাম নিজেকে সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর পরিচয় দিয়ে মানুষকে মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে আমেরিকা যাওয়ার জন্য প্রলুব্ধ করে। ভিসা পাওয়ার জন্য তারা পরস্পর যোগসাজশে বিভিন্ন প্রকার জাল সিল ও নকল কাগজপত্র তৈরি করে।
গ্রেপ্তারকৃতের জিজ্ঞাসাবাদে ডিবি পুলিশ জানতে পেরেছে, রেজাউল করিম নিজেকে সারা এন্টারপ্রাইজের মালিক সবুজ আলম পরিচয়ে আমেরিকা, ইতালি, পোল্যান্ড, চেক রিপাবলিকসহ বিভিন্ন দেশের নামিদামি কোম্পানির কাছে বাংলাদেশ আর্মিতে পণ্য সরবরাহের জন্য ক্রয় চুক্তি করেন। কিন্তু তাদের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে অবৈধপন্থায় মানুষকে বিদেশে পাঠানো। তারা মার্কিন ভিসা প্রত্যাশীদের সঙ্গে ১৮ থেকে ২০ লাখ টাকায় চুক্তি করে। এভাবে তারা গত ৮ বছরে কয়েক কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে।
ডিবি সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগের (উত্তর) এডিসি জুনায়েদ আলম সরকার বলেন, রেজাউল ইসলাম সেনাবাহিনীতে সরবরাহকারী হিসেবে কাজ করায় ক্রয় পদ্ধতি সম্পর্কে তার অভিজ্ঞতা ছিল। সামরিক সরঞ্জামি বিক্রি করে এ রকম অনেক বিদেশি কোম্পানিকে চিনতো। তাই তিনি ডিজিডিপি’র ভুয়া ক্রয়াদেশ তৈরি করে ওই কোম্পানিগুলোতে মেইল করতেন। পণ্য ক্রয় সংক্রান্ত মেইল আদান-প্রদানের কাগজপত্রসহ আরও কিছু ভুয়া কাগজ সংযুক্ত করে বিভিন্ন জনের নামের ভিসার আবেদন করতেন। এভাবেই মার্কিন ভিসা পাওয়ার জন্য অনেকের নামে আবেদন করে।
তিনি বলেন, ইউএস তথা উন্নত দেশের ভিসা পাওয়ার জন্য অনেকেই সঠিক তথ্য এবং কাগজপত্র অ্যাম্বাসিতে প্রদর্শন করেন না। কিন্তু জাল কাগজপত্র জমা দিলে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হতে পারে। এ ছাড়া আবেদনকারীরা ভিসা প্রাপ্তির জন্য অযোগ্য বলে বিবেচিত হবেন। জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে ভুয়া নথিপত্র তৈরি করা ও জাল সিল ব্যবহার করা বাংলাদেশের প্রচলিত আইনে অপরাধ। ভুয়া ইনভাইটেশন লেটার মার্কিন ভিসা পাওয়ার নিশ্চয়তা প্রদান করে না।
জুনায়েদ আলম সরকার আরও বলেন, এর আগেও মার্কিন দূতাবাসের অভিযোগের ভিত্তিতে ভিসা জালিয়াতির একটি চক্রকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। যে সকল ব্যক্তি প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন দেশের ভিসা প্রাপ্তির জন্য জাল কাগজপত্র তৈরি এবং ব্যবহার করছে ডিবি তাদের ওপর নজর রাখছে এবং তথ্য সংগ্রহ করছে। এ সকল প্রতারক চক্রের বিরুদ্ধে ডিবি’র অভিযান অব্যাহত থাকবে।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার মো. হারুন অর রশিদ বলেন, রেজাউলের ব্যবসা হলো বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে মক্কেল সংগ্রহ করে, তাদের কাছ থেকে ১৫-২০ লাখ টাকা নিয়ে ভুয়া প্রসেস করে প্রতারণার মাধ্যমে উন্নত দেশগুলোতে পাঠানোর চেষ্টা করা।
সূত্র: বাংলাদেশ জার্নাল
এম ইউ/১০ ফেব্রুয়ারি ২০২৩