ঢাকা, ০৯ ফেব্রুয়ারি – উনিশ শতকে কানাডা উপকূলে আসা ব্রিটিশ বাণিজ্য জাহাজগুলোর অধিকাংশই নোঙর ফেলত ভ্যাঙ্কুভার বন্দরে। জাহাজগুলো বন্দরের কাছাকাছি এলে বা নোঙর ফেললে দেখা যেত খালাসি বা লস্করদের একাংশ জাহাজ থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ছে সাগরে। এরপর সাঁতরে তীরে উঠে পালিয়ে যেত তারা। বাড়তি রোজগার ও পরিবারের সচ্ছলতার আশায় ইউরোপ-আমেরিকার বড় বন্দরগুলোয় জাহাজের খালাসি-লস্করদের মতো কর্মচারীদের এভাবে পালানোর ঘটনা সে সময় অহরহই ঘটত। এ লস্করদের বড় একটি অংশ ছিল বাঙালি। অন্য অনেক স্থানের মতো কানাডায়ও বাঙালি অভিবাসনের সূত্রপাত হয়েছিল তাদের মাধ্যমেই।
ঔপনিবেশিক শাসনামলে ব্রিটিশ বাণিজ্য জাহাজগুলোর লস্করদের মধ্যে বড় একটি অংশ ছিল বাংলা অঞ্চলের বাসিন্দা। এ পেশায় দক্ষতার প্রয়োজন পড়ত কম। ঝুঁকি নিতে হতো অনেক বেশি। ব্রিটিশ শাসনে দারিদ্র্যপীড়িত বাংলায় শ্রম ছিল সস্তা। অভাব ছিল কর্মসংস্থানের। ঝুঁকি থাকলেও এখানে কম পয়সায় অনেক খালাসি-লস্কর পেত ব্রিটিশরা। হতদরিদ্র এসব মানুষের অধিকাংশই ছিল সিলেট, চট্টগ্রাম ও নোয়াখালী অঞ্চলের বাসিন্দা। আবার প্রায় বিনা পয়সায় ‘বিদেশ যাত্রার’ সুযোগ নিতেও এ পেশায় যোগ দিয়েছে অনেক মানুষ।
জাহাজে তাদের পরিচিতি হতো কাজের ভিত্তিতে যেমন—‘কোলওয়ালা’ (কয়লাওয়ালা), ‘তেলওয়ালা’ (ইঞ্জিনে গ্রিজ দেয়ার কাজে ন্যস্ত), ‘ডাঙ্কিওয়ালা’, ‘আগওয়ালা’ (আগুনওয়ালা) ইত্যাদি। ইঞ্জিনরুমের ঝুঁকিপূর্ণ এসব কাজ করতে গিয়ে অকালে প্রাণ খুইয়েছেন অনেক বাঙালি লস্কর। সমসাময়িক ও পরবর্তীকালের অনেক ঔপন্যাসিক-প্রাবন্ধিকের রচনায় এমন অনেক দুর্ভাগ্যজনক মৃত্যুর মর্মান্তিক বিবরণ পাওয়া যায়।
এ ঝুঁকির কথা ছিল সর্বজনবিদিত। তার পরও এ পেশা বেছে নিত সিলেট-চট্টগ্রাম-নোয়াখালী অঞ্চলের দরিদ্র বাঙালিরা। দীর্ঘ কষ্টকর যাত্রায় যারা বেঁচে থাকত, জাহাজ ইংল্যান্ড, আমেরিকা বা কানাডার উপকূলে আসামাত্র তাদের কেউ কেউ জাহাজ থেকে লাফিয়ে পড়ত সমুদ্রে। সাঁতরে তীরে উঠে পড়ত। গন্তব্যে পৌঁছার পর তাদের অনেককেই ধরা পড়ে আবার ফিরে যেতে হয়েছে জাহাজের বন্দিদশায়। আবার কেউ কেউ কর্তৃপক্ষের চোখ ফাঁকি দিয়ে থেকে যেতে সক্ষমও হয়। যারা থেকে যেত, তাদের অধিকাংশই একপর্যায়ে কিছু অর্থ উপার্জনের পর নানা উপায়ে দেশে ফিরে আসত। আবার কেউ কেউ সেখানে থেকেও যেত চিরতরে। মোটা দাগে কানাডায় বাংলাদেশীদের অভিবাসনের ইতিহাসের শুরুটা হয়েছিল এ লস্করদের হাত ধরে।
একপর্যায়ে জাহাজগুলোয় লস্করদের এ পলায়নপ্রবণতা ঠেকাতে কঠোর আইন ও শাস্তিমূলক নিয়ম-কানুন প্রয়োগ করা হয়। বিশেষ করে লন্ডন-নিউইয়র্ক-ভ্যাঙ্কুভারের মতো জায়গাগুলোয় নোঙর ফেলার আগে জাহাজে লস্করদের ওপর নজরদারি বাড়ানো হয়। এসব স্থানে লস্করদের পলায়নও কমে আসে। এর পরিবর্তে লস্কররা জাহাজ থেকে পালানোর জন্য ক্যারিবীয় দ্বীপপুঞ্জসহ ব্রিটিশরাজের অধীন ছোট দ্বীপগুলোকে বেছে নিতে থাকে।
কানাডার অভিবাসন ইতিহাসে এর পরও কয়েকবার বাংলার নাম উচ্চারিত হয়েছে। যদিও সেখানে নিযুক্ত বাংলাদেশী হাইকমিশনের তথ্য অনুযায়ী, এখান থেকে কানাডায় আনুষ্ঠানিক অভিবাসনের শুরু গত শতকের ষাটের দশকে। সে সময় তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান থেকে অনেকেই উচ্চশিক্ষা ও প্রাতিষ্ঠানিক প্রশিক্ষণের জন্য কানাডায় গিয়ে থেকে গিয়েছিলেন। পরের দশকগুলোয় সেখানে দক্ষ কর্মী বা উচ্চশিক্ষিতদের অভিবাসনের সংখ্যা ক্রমেই বাড়তে থাকে।
তবে গত এক-দেড় দশকে কানাডায় বাঙালিদের অভিবাসনের গল্পটিতে নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে। এ সময় বাংলাদেশ থেকে অবৈধভাবে অর্থ স্থানান্তর করে বিনিয়োগকারী কোটায় কানাডায় স্থায়ীভাবে বসবাসের অনুমতি (পিআর) বা নাগরিকত্ব নিয়েছেন অনেক বাংলাদেশী। অভিযোগ রয়েছে, তাদের বড় একটি অংশ দেশে বিপুল পরিমাণ অর্থ উপার্জন করেছিলেন দুর্নীতি, ব্যাংকের ঋণ খেলাপ ও সরকারি সম্পদ আত্মসাতের মাধ্যমে। অনেকে আবার ক্যারিবীয় দ্বীপপুঞ্জসহ ব্রিটিশরাজের অধীন ছোট দ্বীপগুলোয় বেনামি অফশোর কোম্পানি খোলার মাধ্যমেও বড় অংকের অর্থ পাচার করছেন। আবার পণ্য বাণিজ্যের আড়ালে তৃতীয় কোনো দেশের মাধ্যমে কানাডায় অর্থ পাচারের গল্পও শুনতে পাওয়া যায়।
পাচারকৃত অর্থ কাজে লাগিয়ে কানাডায় বিলাসী জীবন যাপন করছেন অভিযুক্তরা। কেউ কেউ এখনো দেশে থেকে গেলেও স্ত্রী-সন্তানসহ পরিবারের সদস্যদের পাঠিয়ে দিয়েছেন কানাডায়। তাদের বিলাসবহুল বাড়ি নিয়ে গড়ে ওঠা এলাকাগুলো মুখে মুখে পরিচিতি পেয়েছে ‘বেগমপাড়া’ হিসেবে।
বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচার করে কানাডায় স্থায়ী নিবাস গড়া এমন অনেক বাংলাদেশীর তথ্য বিভিন্ন মাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে বারবার। এ তালিকায় ব্যাংক ও আর্থিক খাতের শীর্ষ নির্বাহী, জাহাজ ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে খাতুনগঞ্জ-নিতাইগঞ্জের ভোগ্যপণ্যের ব্যবসায়ীর নামও রয়েছে।
লস্করদের জাহাজে করে কানাডা যাত্রার শুরু হতো চট্টগ্রাম বন্দর থেকে। তাদের বড় একটি অংশ ছিল এখানকারই বাসিন্দা। পারিপার্শ্বিকতা এবং নিজেকে ও পরিবারকে টিকিয়ে রাখার তাগিদ তাদের বাধ্য করত প্রাণের ঝুঁকি নিতে। প্রায় দেড় শতক পর অভিবাসনের নামে কানাডা পলায়নের গল্পগুলোয় এখন এ চট্টগ্রামেরই অনেক ব্যবসায়ীদের নাম উঠে আসছে। তবে তাদের প্রেক্ষাপট ও পরিস্থিতি একেবারেই ভিন্ন। অভিযোগ রয়েছে, মূলত ব্যাংক বা রাষ্ট্রের সম্পদ আত্মসাৎ করে বিলাসী জীবনযাপনের খোঁজেই কানাডায় পাড়ি জমাচ্ছেন তারা।
এমনই এক ব্যবসায়ী চট্টগ্রামের বাদশা গ্রুপের স্বত্বাধিকারী মোহাম্মদ ইসা। কানাডায় পাড়ি জমানো এ ব্যবসায়ীর কাছে কয়েকটি ব্যাংকের পাওনা আছে ৬০০ কোটি টাকারও বেশি। ভাই মোহাম্মদ মুসাও তার সঙ্গে দেশটিতে অভিবাসন নিয়েছেন।
বিভিন্ন ব্যাংকের পাওনা টাকা পরিশোধ না করেই কানাডায় অবস্থান করছেন মিজানুর রহমান শাহীন ও হুমায়ুন কবির। মুজিবুর রহমান মিলন নামে আরেক ভাইকে সঙ্গে করে ২০১০ সালে মিশম্যাক গ্রুপ নামে একটি শিল্প গ্রুপ খুলেছিলেন তারা। নাম লিখিয়েছিলেন ইস্পাত, শিপব্রেকিং ও আবাসন ব্যবসায়। এজন্য গড়ে তোলা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামে ব্যাংক থেকে ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছিলেন তারা।
শিপব্রেকিং ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ম্যাক ইন্টারন্যাশনালের কর্ণধার জয়নাল আবেদিনের কাছে ১২টি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পাওনা ৮০০ কোটি টাকার বেশি। তিনিও এখন সপরিবারে কানাডায় বসবাস করছেন।
চট্টগ্রামের গিয়াস উদ্দিন কুসুম নামে আরেক ব্যবসায়ীর তথ্য পাওয়া যায়, যিনি বিভিন্ন ব্যাংকের প্রায় ৬০০ কোটি টাকা পাওনা পরিশোধ না করেই ২০১৫ সালে সপরিবারে পাড়ি জমিয়েছিলেন কানাডায়। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান ছাড়াও জাহাজ ভাঙা শিল্পের সঙ্গে জড়িত ছোট-বড় শতাধিক ব্যবসায়ীর কাছ থেকে কমপক্ষে শত কোটি টাকা ঋণ নিয়েছিলেন তিনি।
খাতুনগঞ্জের ভোগ্যপণ্যের বড় ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান মেসার্স ইয়াছির এন্টারপ্রাইজ। ২০০৯ সালে প্রতিষ্ঠানটি বড় পরিসরে ভোগ্যপণ্য আমদানি শুরু করে। ২০১২-১৩ সালে ভোগ্যপণ্য আমদানিতে বড় লোকসান হলে ব্যাংকের দায় না মিটিয়েই ২০১৪ সালের শুরুর দিকে সপরিবারে কানাডা পাড়ি দেন প্রতিষ্ঠানটির স্বত্বাধিকারী মোহাম্মদ মোজাহের হোসেন।
ব্যাংকের পাওনা পরিশোধ না করেই কানাডায় স্থায়ী আবাস গড়েছেন চট্টগ্রামের ব্যবসায়ী দিদারুল আলম। দেশে থাকাকালীন নিজের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ইফফাত ইন্টারন্যাশনালের নামে বিভিন্ন ব্যাংক ও ব্যবসায়ীর কাছ থেকে প্রায় ২০০ কোটি টাকা ঋণ নেন তিনি। টাকার সিংহভাগই তিনি বিদেশে পাচার করেন এবং পরবর্তী সময়ে নিজেও সপরিবারে কানাডায় পালিয়ে যান।
এসব ঘটনা চট্টগ্রামের প্রকৃত ব্যবসায়ীদের জন্য অনেক বিব্রতকর পরিস্থিতি তৈরি করেছে উল্লেখ করে চিটাগং চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির প্রেসিডেন্ট মাহবুবুল আলম বলেন, ‘যে বা যারা দেশ থেকে টাকা পাচার করে বিদেশে আয়েশি জীবন যাপন করছেন, তারা তা সম্পূর্ণ নীতিবিবর্জিতভাবেই করছেন। বিষয়টি কোনোভাবেই কাম্য হতে পারে না। কতিপয় ব্যক্তি বিলাসবহুল জীবন যাপন করতে গিয়ে দেশের বাইরে অর্থ পাচার করলেও সার্বিকভাবে চট্টগ্রাম অঞ্চলের খেটে খাওয়া মানুষ এখন দেশের অর্থনীতিতে ইতিবাচক ভূমিকা রাখছেন। মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে যে খেটে খাওয়া মানুষ বাংলাদেশে রেমিট্যান্স পাঠাচ্ছেন, তাদের বড় একটি অংশ চট্টগ্রাম অঞ্চলের বাসিন্দা।’
চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহার করে পণ্য আমদানি-রফতানির আড়ালে অর্থ পাচারের অভিযোগও রয়েছে অনেক। ২০২০ সালের শুরুর দিকে কানাডা থেকে শস্য আমদানির পরিমাণ প্রথমবারের মতো শত কোটি ডলারের মাইলফলক পার করে। স্ট্যাটিস্টিকস কানাডা ও কানাডিয়ান ইন্টারন্যাশনাল মার্চেন্ডাইজ ট্রেড ডাটাবেজের উদ্ধৃতি দিয়ে সেখানকার স্থানীয় সংবাদমাধ্যমগুলো জানায়, ২০১৯ সালে বাংলাদেশে কানাডা থেকে খাদ্যশস্য (গম, ডালশস্য ও তেলবীজ) আমদানি আগের বছরের তুলনায় দ্বিগুণের বেশি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১০৮ থেকে ১১২ কোটি ডলারে। যদিও সে সময় খাতুনগঞ্জসহ দেশের আমদানীকৃত ভোগ্যপণ্যের বড় পাইকারি বাজারগুলোয় খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, বাজারে কানাডা থেকে আমদানীকৃত খাদ্যশস্যের পরিমাণ সেভাবে বাড়েনি।
বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচারের সিংহভাগই হয় আমদানি-রফতানি বাণিজ্যের আড়ালে। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের (বিআইবিএম) গবেষণা ও গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটির তথ্যেও বিএফআইইউর এ পর্যবেক্ষণের সমর্থন পাওয়া যায়।
বিআইবিএমের গবেষণায় উঠে এসেছে, বাংলাদেশ থেকে প্রচুর অর্থ বাইরে পাচার হচ্ছে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের আড়ালে। আমদানীকৃত পণ্যের বিবরণ বা মূল্য পরিবর্তন, মিথ্যা ঘোষণায় শুল্কায়ন, এলসিতে কারসাজিসহ নানা কায়দায় এসব অর্থ পাচার হয়। গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটির তালিকায়ও বাণিজ্যের আড়ালে অর্থ পাচারের উৎস হিসেবে বাংলাদেশের নাম রয়েছে সামনের সারিতে।
শুধু চট্টগ্রাম অঞ্চল নয়, রাজধানী ঢাকাসহ দেশের অন্যান্য স্থানের ধনাঢ্যদের কানাডায় অর্থ পাচারের অভিযোগ উঠেছে বারবার। এ তালিকায় ব্যবসায়ীদের পাশাপাশি আছেন ব্যাংক ও আর্থিক খাতের শীর্ষ নির্বাহী, রাজনীতিবিদ ও সরকারি কর্মকর্তাদের নামও। বর্তমানে দেশে কারাভোগকারী ‘আর্থিক খাতের তস্কর’ হিসেবে পরিচিতি পাওয়া বহুল আলোচিত পিকে হালদারও বাংলাদেশ থেকে ভারত হয়ে পালিয়ে গিয়েছিলেন কানাডায়।
খাতুনগঞ্জের মতোই বৃহৎ এক ভোগ্যপণ্যের বাজার নারায়ণগঞ্জের নিতাইগঞ্জ। এখানকার আব্দুর রাজ্জাক নামের ব্যবসায়ীর কাছে খাতুনগঞ্জ ও নিতাইগঞ্জের ব্যবসায়ীদের পাওনা টাকার পরিমাণ প্রায় ২০০ কোটি। পাওনা পরিশোধ না করে এ ব্যবসায়ীও কানাডায় পালিয়ে গেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
কানাডায় অভিবাসনের ক্ষেত্রে এসব ব্যক্তি মূলত বিনিয়োগকারী কোটার সুবিধা নিয়ে থাকেন। দেশটিতে মাত্র দেড় লাখ কানাডীয় ডলার (প্রায় ১ কোটি ১৯ লাখ টাকার সমপরিমাণ) জমা দিলেই নাগরিকত্ব পাওয়া যায়। এছাড়া মুদ্রা পাচার প্রতিরোধে দেশটির আইন-কানুনও খুব একটা কঠোর নয়। এরই সুযোগ নিয়ে দেশ থেকে কানাডায় পাড়ি জমাচ্ছেন ঋণখেলাপি ও দুর্নীতিবাজরা।
এক্ষেত্রে গন্তব্য দেশেরও কিছু দায় থেকে যায় বলে মনে করছেন অভিবাসন বিশেষজ্ঞরা। তাদের ভাষ্যমতে, এসব দেশ অবাধে উৎস প্রদর্শন ছাড়াই বিনিয়োগের সুবিধা করে দেয় বলেই ব্যাংক বা রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুটপাট করে দেশগুলোয় অর্থ পাচার করতে পারে অভিযুক্তরা। রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্ট রিসার্চ ইউনিটের (রামরু) নির্বাহী পরিচালক ড. সিআর আবরার বলেন, ‘আমাদের জনগণের টাকা ওইখানে বেপথে নিয়ে যাওয়ার সুযোগ আছে বলেই এরা এভাবে যেতে পারছে। আন্তর্জাতিক ন্যায় কাঠামো বিবেচনায় বলা যায়, এমনটি হওয়া উচিত নয়। অর্থ পাচার করে চলে যাওয়া ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে এখানকার ফৌজদারি আইনে তদন্ত শুরু হলে যাতে কানাডার সহযোগিতা পাওয়া যায় সে বিষয়ে আমাদের জোর দাবি করা উচিত। শুরুর দিকে যারা জাহাজে জীবনবাজি রেখে যেত আর এখন যারা অর্থ পাচার করে কানাডায় পাড়ি দিচ্ছে, তাদের মধ্যে বড় ধরনের মৌলিক পার্থক্য আছে। তখন যারা যেত, তারা ছিল খেটে খাওয়া মানুষ। তারা সেখানে যেত নিজেকে দারিদ্র্যমুক্ত হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার প্রত্যয় থেকে। আর এখনকার অর্থ পাচারকারীরা হলো উচ্চবিত্ত। তারা এখানে রাষ্ট্রের কাছ থেকে নানা সুযোগ-সুবিধা কবজা করে অনেকটা পরজীবীর মতো অন্যের পুঁজি মেরে দিয়ে, লুটপাট করে চলে যাচ্ছে।’
একই কথা বলছেন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামানও। তিনি বলেন, ‘এক্ষেত্রে দায়টা কানাডা সরকারেরও আছে। তাদের ওখানে চাহিদা আছে বলেই এখান থেকে অর্থ পাচারের সুযোগটাও আছে। বিষয়টি সরকারের জন্যও অজানা ঘটনা না। একসময় অর্থ পাচার ছিল সম্পূর্ণ ধরাছোঁয়ার বাইরে। এটি বন্ধ করা বা প্রতিরোধের সুযোগ ছিল না বা বিষয়টি খুব জটিল এবং কঠিন ছিল। এখন বিশ্বে এবং দেশেও আইনগত পরিবর্তন হয়েছে। পাচার রোধের প্রক্রিয়াটির সুনির্দিষ্ট একটি পথরেখাও আছে। সে পথরেখা অনুসরণ করে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষগুলো যদি তাদের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করতে পারত, তাহলে একদিক থেকে প্রতিরোধ করা সম্ভব ছিল। অন্যদিকে যারা বৈধ করতে সহযোগিতা করছে তাদেরও নিজ নিজ দেশে চিহ্নিত করা যেত। সংশ্লিষ্ট দেশের সঙ্গে পারস্পরিক আইনি সহযোগিতার মাধ্যমে পাচারকারীদের চিহ্নিত করে ফেরত আনা এবং তাদের সম্পদের তিন গুণ অর্থ জরিমানা করার বিধান আমাদের দেশে রয়েছে। এ পথরেখা যথাযথভাবে অনুসরণ করা হচ্ছে না। এ কারণে চাহিদা ও সরবরাহ—এ দুইয়ের সংমিশ্রণে অর্থ পাচার বেড়েছে।’
বিভিন্ন উৎসে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, অনেকেই এখন তৃতীয় কোনো দেশ হয়ে কানাডায় অর্থ পাচারের সুবিধা নিচ্ছে। বহুল আলোচিত পানামা পেপার্স, প্যান্ডোরা পেপার্স, প্যারাডাইস পেপার্স, বাহামাস লিকস ও অফশোর লিকস কেলেঙ্কারির সময়েও ক্যারিবীয় দ্বীপপুঞ্জ বা ব্রিটিশরাজের অধীন ছোট দ্বীপগুলোর অখ্যাত অফশোর কোম্পানিকে কাজে লাগিয়ে বিভিন্ন দেশ থেকে অর্থ পাচারের তথ্য উঠে এসেছে। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের আড়ালেও তৃতীয় কোনো দেশের মাধ্যমে অর্থ পাচারের তথ্য পাওয়া যায়। এমনকি বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বাণিজ্য অংশীদার চীনও এখন অর্থ পাচারের রুট হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে বলে সন্দেহ করা হচ্ছে। বিশেষ করে বাংলাদেশ ও চীনের বাণিজ্য তথ্যে বিপুল পরিমাণ ব্যবধানের বিষয়টি এখন অস্বস্তি বাড়াচ্ছে বেশি।
কানাডার ভ্যাঙ্কুভার শহরটি এখন অজ্ঞাত উৎস থেকে আসা বিদেশী অর্থ জমা রাখা, কর ফাঁকি ও অবৈধ অর্থের স্বর্গরাজ্য হয়ে উঠেছে। সেখানকার ক্যাসিনোগুলোয় ওড়ানো হচ্ছে স্যুটকেস ভর্তি মিলিয়ন মিলিয়ন ডলারের নগদ অর্থ। বিলাসবহুল গাড়ি আমদানির আড়ালে চীন থেকেও ভ্যাঙ্কুভারে পাচার হচ্ছে বিপুল পরিমাণ অর্থ। ব্রিটিশ কলাম্বিয়াসহ কানাডার অন্যান্য এলাকায়ও ক্যাসিনোর আড়ালে অর্থ পাচারের প্রকৃত অংক এখন বিভিন্ন সংস্থার প্রাক্কলনকেও ছাড়িয়েছে বলে জানা গেছে।
পাচারকৃত অর্থের বিপুল পরিমাণ প্রবাহ কানাডার রিয়েল এস্টেট খাতে বড় অংকের মূল্যস্ফীতির কারণ হয়ে উঠেছে। পরিস্থিতি সামাল দিতে গিয়ে খাতটিতে গত ১ জানুয়ারি থেকে বিদেশীদের প্রপার্টি ক্রয়ের ওপর দুই বছরের নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে।
বিদেশে পুঁজি পাচারের এ ধরনের ঘটনাগুলোকে দেশের অর্থনীতির চলমান সংকটগুলোর প্রধান কারণ হিসেবে দেখছেন অর্থনীতিবিদরা। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ড. মইনুল ইসলাম এ বিষয়ে বলেন, ‘একসময় অভিবাসনের অন্যতম বড় মাধ্যম ছিল জাহাজে চাকরি নিয়ে বিদেশ যাওয়া। সে সময় যারা গিয়েছেন, তাদের চেষ্টা ছিল বিদেশ থেকে আয় করে দেশে টাকা নিয়ে আসা। ৫০-৬০ বছর আগেও এমন ঘটনা শোনা যেত। তারা সে সময় দেশের অর্থনীতিতেও অবদান রেখেছেন। কিন্তু এখন অভিবাসন আলোচনার কেন্দ্রে উঠে এসেছেন ধনাঢ্যরা। ব্যবসায়ী পুঁঁজিপতিরা ব্যাংকের তথা জনগণের আমানতের ঋণ নিয়ে আর ফেরত দিচ্ছেন না। তা পাচার করছেন বিদেশে। হুন্ডিসহ অবৈধ উপায়ে পাচার করে কানাডার মতো উন্নত দেশে বসত গড়ছেন। পার্থক্য হলো একসময় বিদেশে মানুষ যেত দেশের অর্থনীতিকে শক্তিশালী করার জন্য। এখন দেশের সম্পদ ও সাধারণ মানুষের জমানো পুঁজি চুরি করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। ডলারের ঘাটতিসহ দেশের বর্তমান অর্থনৈতিক সংকটের জন্য এ পুঁজি পাচার দায়ী।’
কানাডায় অর্থ পাচারের বিষয়টি সরকারের জন্যও বিভিন্ন সময়ে বিড়ম্বনার কারণ হয়ে উঠেছে। ২০২০ সালের নভেম্বরে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন উপস্থিত সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, বাংলাদেশ থেকে কানাডায় টাকা পাচারের যে গুঞ্জন রয়েছে, প্রাথমিকভাবে তার কিছু সত্যতা পাওয়া গেছে।
ওই সময় তিনি বলেন, ‘প্রাথমিকভাবে কিছু সত্যতা পেয়েছি। মনে করেছিলাম রাজনীতিবিদদের সংখ্যা বেশি হবে। কিন্তু দেখা গেল রাজনীতিবিদ চারজন। সরকারি কর্মচারীর সংখ্যা বেশি। এছাড়া কিছু ব্যবসায়ী রয়েছেন।’
তবে কানাডায় স্থায়ী-অস্থায়ীভাবে বসবাসকারী বাংলাদেশীদের বেশির ভাগই সেখানে প্রবেশ করেছেন হয় শিক্ষার্থী ভিসায়, নয় দক্ষ কর্মী হিসেবে এক্সপ্রেস এন্ট্রির মাধ্যমে। মেধা ও দক্ষতা দিয়ে স্থানীয় পরিমণ্ডলে নিজেদের সম্মানজনক অবস্থান তৈরি করে নিয়েছেন তারা। দেশ থেকে অর্থ পাচার করে কানাডায় বিলাসবহুল জীবনযাপনকারীদের বিরুদ্ধে সেখানে সামাজিক আন্দোলনও চালু রয়েছে।
বিভিন্ন মাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে কানাডায় বাংলাদেশী আছে লাখেরও বেশি। অন্টারিও, ব্রিটিশ কলাম্বিয়া, কুইবেক, সাসকাচুয়ান ও অ্যালবার্টার মতো প্রদেশগুলোয় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে তারা। প্রদেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশীদের সবচেয়ে বেশি দেখতে পাওয়া যায় টরন্টো, মন্ট্রিয়ল, ভ্যাঙ্কুভার, ক্যালগারি, এডমন্টন, রেজিনা ও অটোয়ার মতো শহরগুলোয়।
এসব শহরের বাংলাদেশী কমিউনিটির সদস্যদের মধ্যে অর্থ পাচারকারীদের বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন চলমান রয়েছে। তাদের অনেকেই জানিয়েছেন, কানাডীয় সরকারের পক্ষ থেকে অভিবাসীদের আর্থিক তথ্য গোপন রাখা হয় বলে অনেককেই সেভাবে চিহ্নিত করা যায় না। কিন্তু যাদের কথা জানা যায়, তারা কমিউনিটি থেকে এক প্রকার বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। এমনকি তাদের মালিকানার রেস্তোরাঁ-ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানও এড়িয়ে চলে। কমিউনিটিতে তাদের প্রভাব বিস্তারের সুযোগ নেই।
পেশায় চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট জাহিদুল হাসান এখন বসবাস করছেন কানাডার টরন্টোয়। তিনি বলেন, ‘দেশ থেকে অর্থ পাচারের এসব তথ্য আমাদের জন্য অনেক বড় মর্মপীড়ার কারণ। দেশের বর্তমান পরিস্থিতির জন্য প্রবাসী বাঙালিরা এ অর্থ পাচারকারীদের অনেকাংশেই দায়ী করে থাকেন। কিন্তু সমস্যা হলো আর্থিক তথ্যের গোপনীয়তার কারণে তাদের তথ্য আমাদের সামনে খুব কমই আসে। সামনে এলে আমরা তাদের এড়িয়ে চলি।’
দেশটির সর্বশেষ জনশুমারির তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সাল পর্যন্ত কানাডায় স্থায়ীভাবে বসবাসের অনুমতি (পিআর) পেয়েছে ৭০ হাজার বাংলাদেশী। তাদের মধ্যে প্রায় সাড়ে ২৫ হাজার পিআর পেয়েছে ২০১১ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে।
সূত্র: বণিক বার্তা
এম ইউ/০৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৩