আঙ্কারা, ০৯ ফেব্রুয়ারি – ‘আচকা ভবন কেঁপে উঠল, এর পর ভয়ানক শব্দ। চারদিকে হইহুল্লোড়, চিৎকার, কান্নার রোল। আর কিছু স্মৃতিতে নেই। চেতনা ফিরতেই নিজেকে আবিস্কার করি হাসপাতালে। হাত মুড়ে দেওয়া হয়েছে ব্যান্ডেজে। হাসপাতালে আমার বেডের আশপাশে অগণন ক্ষতবিক্ষত মানুষ। তাঁদের কারও মাথা, কারও পিঠ আবার কারও হাত-পা ব্যান্ডেজে ঢাকা। কিছু প্রাণহীন দেহের ঠাঁই কফিনে। আসলেই মৃত্যুর দরজা খুব কাছ থেকে দেখেছি!’ তুরস্কে ভূমিকম্পের বিধ্বস্ত ভবনের ধ্বংসস্তূপ থেকে ৩৭ ঘণ্টা পর জীবিত উদ্ধার বাংলাদেশি যুবক গোলাম সাঈদ রিংকু (২৮) হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে এভাবেই সেদিনের মর্মন্তুদ ঘটনার বর্ণনা দিচ্ছিলেন।
গতকাল বুধবার বিকেল পৌনে ৫টার দিকে এই প্রতিবেদক হোয়াটসঅ্যাপে যখন রিংকুর সঙ্গে কথা বলছিলেন তখন বারবার বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছিল ইন্টারনেট সংযোগ। ভূমিকম্পের পর সেখানকার নেটওয়ার্ক এখনও স্বাভাবিক না হওয়ায় এমনটা হচ্ছে বলে জানান রিংকু।
রিংকু যতটা না শারীরিক আহত, এর চেয়ে বেশি ভীত। কথা বলার সময় টের পাওয়া গেল, ভয়াবহ ভূমিকম্প তাঁর হৃদয় আঙিনা কাঁপিয়ে দিয়ে গেছে। ভবন ধসে রিংকুর আঘাত লাগে ডান হাতের বাহুতে। শরীরের অন্য কোথাও লাগেনি চোট। জানালেন, হাতের ব্যথা কমছে। তবে মারাত্মক ঠান্ডাজনিত রোগে আক্রান্ত হয়েছেন। এ কারণে ঠিকঠাক স্বরও বের হচ্ছে না।
চিকিৎসকরা বেশি কথা বলতে নিষেধ করায় অল্পতেই থামেন রিংকু। আস্তে আস্তে বলেন, ‘মৃত্যুর মুখ থেকে বেঁচে ফিরেছি, যেন নতুন জীবন পেলাম। মা-বাবার দোয়ায় হয়তো সৃষ্টিকর্তা আমার প্রাণ নেননি।’
রিংকু তুরস্কের কাহরামানমারাসের যে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েন, সেই সুতচু ইমাম বিশ্ববিদ্যালয়ের হাসপাতালেই তাঁকে ভর্তি করা হয়েছে। গতকাল সকালে সহপাঠী শাওনের মাধ্যমে মা-বাবাসহ স্বজনদের সঙ্গে মোবাইল ফোনে প্রায় আধা ঘণ্টা কথা বলেন রিংকু।
রিংকুর বন্ধু শাওন বলেন, রিংকু মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। চিকিৎসকরা উন্নত চিকিৎসার জন্য তাঁকে ইস্তাম্বুল হাসপাতালে নিয়ে যেতে বলেছেন। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সেই উদ্যোগ নিচ্ছে। আজকেই (গতকাল) ইস্তাম্বুলে নেওয়া হবে। শাওন আরও বলেন, পরিবারের সঙ্গে কথা বলে রিংকু স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টায় আছে। তবু মনের ভেতরে লুকানো ভীতি কাটছে না। প্রায় ৩৭ ঘণ্টা ধ্বংসস্তূপে আটকে থাকা রিংকুকে জীবিত বের করতে উদ্ধারকর্মীরা ছয় ঘণ্টা চেষ্টা চালিয়ে সফল হন।
এদিকে রিংকুর ছোট ভাই গোলাম রসুল রিফাত বলেন, ‘ভাইয়া সুস্থ ও স্বাভাবিক আছেন। আজ সকালে তাঁর সঙ্গে মোবাইল ফোনে এবং ভিডিও কলে প্রায় আধা ঘণ্টা কথা হয়েছে। মা-বাবাসহ পরিবারের সবার সঙ্গে তিনি স্বাভাবিক কথা বলেছেন। বারবার বলেছেন, আমি ভালো আছি, সুস্থ আছি। শিগগির দেশে ফিরছি।’ তিনি আরও বলেন, ‘ভাইয়াকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, বিধ্বস্ত ভবনের কোথায় তিনি আটকা পড়েছিলেন? ওই ভবনে আর কারা ছিল? জবাবে ভাইয়া জানান, হঠাৎ বিকট শব্দ। হুড়মুড়িয়ে ভবন ধসের পর আর কিছু তাঁর মনে নেই।’
এর আগে রিংকুকে ধ্বংসস্তূপ থেকে জীবিত উদ্ধারের বিষয়টি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে জানান তুরস্কে বাংলাদেশ দূতাবাসের চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স রফিকুল ইসলাম। তাঁর থেকে নিশ্চিত হয়ে মঙ্গলবার রাতে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম এ বিষয়ে ফেসবুকে পোস্ট দেন।
ক্ষণ গুনছেন মা :রিংকুর মা সালমা বেগম সন্তানের অপেক্ষায় প্রহর গুনছেন। তিনি বলেন, ‘আমার বাবাকে আল্লাহ ভিক্ষা দিয়েছেন। এখন অপেক্ষায় আছি বাবা কবে ফিরবে।’
বগুড়ার গাবতলীর দেওনাই গ্রামের কৃষক গোলাম রব্বানীর ছেলে রিংকু বগুড়া শহরের আর্মড পুলিশ পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে এইচএসসি পাসের পর ২০১৫ সালে উচ্চ শিক্ষার জন্য তুরস্কে যান। তিন ভাইবোনের মধ্যে রিংকু মেজো। রিংকুর বড় বোন জান্নাতুল ফেরদৌসীর বিয়ে হয়েছে। রিংকুর জন্য পাত্রী দেখছিলেন তাঁর বাবা।
তুরস্কের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে গত সোমবার স্থানীয় সময় ভোর ৪টা ১৭ মিনিটে ৭ দশমিক ৮ মাত্রার শক্তিশালী ভূমিকম্প আঘাত হানে। ভূমিকম্পটির কেন্দ্রস্থলের কাছে কাহরামানমারাস শহরের একটি ভবনে থাকতেন রিংকু। ভূমিকম্পের পর ভবনটি ধ্বংসস্তূপে পরিণত হলে ভেতরে আটকা পড়েন রিংকুসহ কয়েকজন। এর পর থেকে রিংকুর সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছিলেন না পরিবারের লোকজন। এক পর্যায়ে সোমবার সন্ধ্যায় তুরস্কের আঙ্কারা থেকে এক বাংলাদেশি ও রিংকুর বন্ধু মাহবুব আলম ফোন করে বিষয়টি রিংকুর পরিবারকে জানান। এ খবর পেয়ে পরিবারে শুরু হয় মাতম। রাত পৌনে ১০টার দিকে হঠাৎ বন্ধু শাওনের মাধ্যমে প্রথম জানা যায়, রিংকুকে জীবিত উদ্ধার করা হয়েছে। এ খবরে রিংকুর পরিবারে স্বস্তি ফেরে।
সূত্র: সমকাল
এম ইউ/০৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৩