শিক্ষা

সার্বিক ফলে বিষয় বৃদ্ধির ধাক্কা

সাব্বির নেওয়াজ

ঢাকা, ০৯ ফেব্রুয়ারি – এবারের উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় (এইচএসসি) পাসের হার ও সর্বোচ্চ ফল জিপিএ ৫ কমার ঘটনা বেশ নজরে পড়ার মতোই। আগের বছরের চেয়ে পাসের হার কমেছে ৯ দশমিক ৩১ শতাংশ। আর জিপিএ ৫ কম পেয়েছেন ১২ হাজার ৮৮৭ জন। গতবারের চেয়ে ফলের গুরুত্বপূর্ণ এই দুই সূচক কমে যাওয়ার কারণ খুঁজতে গিয়ে জানা গেছে, বিষয় বৃদ্ধির ধাক্কা লেগেছে এবারের উচ্চ মাধ্যমিকের সার্বিক ফলে। যদিও ২০২১ ও ২০২২ সালের এইচএসসি পরীক্ষার্থী সবাই সংক্ষিপ্ত সিলেবাসে পরীক্ষায় অংশ নিয়েছেন। তবে গত বছরের পরীক্ষার্থীরা মাত্র তিনটি নৈর্বাচনিক বিষয়ে পরীক্ষা দিলেও এবার ৬টি বিষয়ে পরীক্ষা দিতে হয়েছে। এর ধাক্কা গিয়ে লেগেছে সব বোর্ডের গড় পাসের হারেও।
শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি বলেন, প্রতিবছর মেধাবীর সংখ্যা সমান নয়। কোনো বছর বেশি, কোনো বছর কম। তবে ২০২২ সালের উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার্থীদের পুনর্বিন্যাসকৃত সিলেবাসে দুটি আবশ্যিক, তিনটি নৈর্বাচনিক, একটি চতুর্থ বিষয়সহ ৬টি বিষয়ের মোট ১২টি পত্রে পরীক্ষা দিতে হয়েছে। আগেরবারের চেয়ে বিষয় বেড়ে যাওয়ায় স্বাভাবিকভাবেই পাসের হার কিছুটা কমেছে। কমেছে জিপিএ ৫। তবে এই ফল কোনোভাবেই মন্দ নয়। খুবই উৎসাহব্যঞ্জক ফল করেছে আমাদের ছেলেমেয়েরা।

পরীক্ষার্থী, শিক্ষক ও শিক্ষা বোর্ডগুলোর চেয়ারম্যানদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পাবলিক পরীক্ষায় পাস-ফেলের অন্যতম নিয়ামক সব সময়ই ইংরেজি ও গণিত। ২০২১ সালের উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার্থীদের ‘কঠিন’ এ দুটি বিষয়ে পরীক্ষায় বসতে হয়নি। অথচ এবার বাংলা ও ইংরেজির পাশাপাশি বিজ্ঞানের শিক্ষার্থীদের উচ্চতর গণিতে অবতীর্ণ হতে হয়েছে। এ বছর তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) ছাড়া সব বিষয়েই পরীক্ষা দিয়ে ছাত্রছাত্রীদের পাস করতে হয়েছে। গতবার দেড় ঘণ্টার পরীক্ষা নেওয়া হলেও এবার প্রতিটি বিষয়ে দুই ঘণ্টার পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। ১২টি প্রশ্নের স্থলে এবার ১৫টি প্রশ্ন ছিল। কেবল আইসিটি বিষয়ের নম্বর এই শিক্ষাবর্ষের পরীক্ষার্থীদের বিগত এসএসসি ও জেএসসি থেকে সাবজেক্ট ম্যাপিংয়ের মাধ্যমে নির্ধারণ করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে জেএসসি থেকে ২৫ শতাংশ আর এসএসসি থেকে ৭৫ শতাংশ নম্বর বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে।

আন্তঃশিক্ষা বোর্ড সমন্বয় কমিটির আহ্বায়ক ও ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক তপন কুমার সরকার বলেন, পাসের হার ও জিপিএ ৫ প্রাপ্তি বিবেচনায় মনে হতে পারে, ফল খারাপ হয়েছে। আসলে তা নয়, বরং ফল অনেক ভালো হয়েছে। আমাদের এই ফল তুলনা করতে হবে ২০১৮ ও ২০১৯ সালের সঙ্গে। তখন আমরা ৭০, ৭৫ শতাংশের ওপরে উচ্চ মাধ্যমিকে পাস করতে দেখতাম না। এবার সেখানে ৮৫ দশমিক ৯৫ শতাংশ পাস করেছে। তাই আমি বলব, ছাত্রছাত্রীরা অভূতপূর্ব ফল করেছে।

তিনি আরও বলেন, গতবারের ফলের সঙ্গে তুলনা করা যাবে না এ কারণে যে, গতবার মাত্র তিনটি বিষয়ে ৬ পত্রে সংক্ষিপ্ত সিলেবাসে পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়েছে। এবারও সংক্ষিপ্ত সিলেবাসে পরীক্ষা নেওয়া হলেও ৬টি বিষয়ে ১২টি পত্রে পরীক্ষা নেওয়া হয়। গত পরীক্ষায় ইংরেজি, গণিত ছিল না। তাই ৯৫ শতাংশ ফল পাওয়া গেছে। বেশিরভাগ বিষয়ে সাবজেক্ট ম্যাপিংয়ের কারণে গতবার জিপিএ ৫ বেড়ে গিয়েছিল।

সিলেট শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. রমা বিজয় সরকার বলেন, ৫৭ দিনের মাথায় ফল দিতে পেরে আমরা খুশি। আরও খুশি এ কারণে যে, করোনা মহামারির মতো প্রতিকূলতা জয় করে সুস্থ-স্বাভাবিক পরিবেশে পূর্ণোদ্যমে শিক্ষার্থীরা পড়াশোনায় মনোনিবেশ করতে পেরেছে। লেখাপড়ার স্থবিরতার পরিবেশ দূর হয়েছে। আগামীতে পূর্ণ সিলেবাসে ও পূর্ণ সময়ে এইচএসসি পরীক্ষা নেওয়া হবে।

পাসের হারে ধাক্কার আরেকটি কারণে তুলে ধরে সিলেট বোর্ড চেয়ারম্যান বলেন, আগেরবারের অটোপাসের কারণে ২০২১ সালের ব্যাচে কোনো অনিয়মিত পরীক্ষার্থী ছিল না। সবাই নিয়মিত শিক্ষার্থী থাকায় পাসের হারও বেশি হয়েছে। এবার ২০২২ ব্যাচে গতবারের অনিয়মিত শিক্ষার্থীরা অল্প হলেও আছে। এতে পাস কমেছে, কমেছে জিপিএ ৫ও।

বিষয়ভিত্তিক ফল বিশ্নেষণে দেখা গেছে, বাংলায় সবচেয়ে কম পাস করেছে রাজশাহী বোর্ডে, ৯৩ দশমিক ৪০ ভাগ। ইংরেজিতে সবচেয়ে বেশি পাস করেছে কুমিল্লা বোর্ডে, ৯৪.৬৪ ভাগ। কম ময়মনসিংহ বোর্ডে ৮২.০৫ ভাগ। পদার্থবিজ্ঞানে পাসের শীর্ষে সিলেট বোর্ড ৯৬.৭৯ ভাগ, কম দিনাজপুর ৮৮.৩৬। রসায়নে শীর্ষে ঢাকা বোর্ড ৯৭ দশমিক ৫৮ ভাগ, সবার কম দিনাজপুর বোর্ডে ৯১ দশমিক ২৩ ভাগ। হিসাববিজ্ঞানে পাসের হারে সবাইকে পেছনে ফেলেছে কুমিল্লা বোর্ড ৯৬ দশমিক ৯০ ভাগ, কম দিনাজপুরে ৭৯ দশমিক ৯৬ ভাগ। আর পৌরনীতিতে সবাইকে অবাক করে দিয়ে ময়মনসিংহ বোর্ডের শিক্ষার্থীরা ৯৯ দশমিক ৬৬ ভাগ পাস করে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন। এই বিষয়ে সবচেয়ে কম পাস করেছেন চট্টগ্রাম বোর্ডের ছাত্রছাত্রীরা, ৯৩ দশমিক ৪৮ ভাগ।

ফল নিয়ে রাজধানীর খ্যাতনামা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ কামরুন নাহার বলেন, এবারের সার্বিক ফল সন্তোষজনক। শিক্ষার্থীরা কষ্ট করেছে, তাই ফলও ভাল হয়েছে। করোনা মহামারির মধ্যেও আমরা শিক্ষার্থীদের অনলাইনে ক্লাস নিয়েছিলাম, শিক্ষকদেরও প্রশিক্ষণ দিয়েছি। ছাত্রীদের ক্লাস টেস্ট, মডেল টেস্ট নেওয়া হয়েছে। এতে তাদের পরীক্ষাভীতি দূর হয়েছে। যার প্রভাব সার্বিক ফলে পড়েছে।

রাজশাহী শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক হাবিবুর রহমান বলেন, এবার ফল খারাপ হয়েছে তা বলা যাবে না। সার্বিক বিচারে ভালো হয়েছে বলতে হবে। এই পরীক্ষার্থীরা করোনাকাল পার করে পরীক্ষা দিয়েছে। বিভিন্ন সমস্যা ছিল। অনেকেই গতবারের তুলনা করে বলছেন খারাপ হয়েছে, তবে আমি বলব- গতবার তিনটি পরীক্ষা কম দিতে হয়েছিল।

বরিশাল শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান (ভারপ্রাপ্ত) অধ্যাপক বাহারুল আলমও পাসের হার ও জিপিএ ৫ প্রাপ্তি কমে যাওয়া প্রসঙ্গে বলেন, গত বছর করোনাকালীন বিভাগভিত্তিক ৩টি বিষয়ের ওপর পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। এ বছর মোট ১২টি পত্রে পরীক্ষা হয়। যে কারণে পাসের হার ও জিপিএ ৫ প্রাপ্তি কমেছে।

দিনাজপুর শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক কামরুল ইসলাম বলেন, বর্তমানে ক্লাস ও পরীক্ষা যথা নিয়মেই চলছে, আগামীবারে আমরা ৩ ঘণ্টা ধরেই পরীক্ষা নেব। তাতে আগামীবারে আরও ভালো ফল হবে বলে আশা করি।
পাসের হারে সাধারণ শিক্ষা বোর্ডগুলোর মধ্যে দেশসেরা হওয়া কুমিল্লা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক জামাল নাছের বলেন, ভালো ফলের জন্য বোর্ড প্রশাসনের মনিটরিং ও অভিভাবকরাও আন্তরিক ছিলেন। সর্বোপরি সংক্ষিপ্ত সিলেবাসে পরীক্ষা হওয়ার কারণে পরীক্ষার্থীরা ভালো প্রস্তুতি নিতে পারায় ফল ভালো হয়েছে।

চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক নারায়ণ চন্দ্র নাথ বলেন, চট্টগ্রাম জেলার কলেজগুলোর তুলনায় পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন জেলার ফল তুলনামূলক খারাপ হয়েছে। এটা পাসের হারে প্রভাব ফেলেছে। আবার ইংরেজি বিষয়ে এবার বেশিরভাগ শিক্ষার্থী কম নম্বর পেয়েছে। এ জন্য জিপিএ ৫ কমে গেছে।

সূত্র: সমকাল
এম ইউ/০৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৩

Back to top button