জাতীয়

শর্ত বাস্তবায়নের ডলারের দামও বাড়বে, কমবে টাকার মান

ঢাকা, ০৫ ফেব্রুয়ারি – আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) শর্ত বাস্তবায়নের ফলে বাজারে ডলারের দাম আরও বাড়বে। বিপরীতে কমবে টাকার মান। এতে আমদানি খরচের পাশাপাশি নিত্যপণ্যের দামও বাড়বে। কমবে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা। ফলে বিশেষ করে স্বল্প ও মধ্য আয়ের মানুষের ভোগান্তি বেড়ে যাবে। এর পাশাপাশি বাড়বে বৈদেশিক দায়দেনা ও সরকারের খরচ। একই সঙ্গে কমে যাবে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। এর প্রভাবে বৈদেশিক মুদ্রা ব্যবস্থাপনার ওপর চাপ বাড়বে।

আগামী জুনের মধ্যে বৈদেশিক মুদ্রা বিষয়ে আইএমএফের প্রধান দুটি শর্ত বাস্তবায়ন করতে হবে। এর মধ্যে ডলারের বিভিন্ন ধরনের দর তুলে দিয়ে বেচা ও কেনা দাম নির্ধারণ করতে হবে। এই শর্ত বাস্তবায়ন করলে ডলারের দাম বেড়ে যাবে। একই সঙ্গে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের নিট হিসাব প্রকাশ করতে হবে। এতে রিজার্ভ বেশ কমে যাবে। আগামী জুনের মধ্যেই বাস্তবায়ন করতে হবে এসব শর্ত। এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকেও আইএমএফকে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক এ লক্ষ্যে কাজও করছে।

সূত্র জানায়, আইএমএফের শর্ত বাস্তবায়ন করতে হাতে সময় আছে মাত্র পাঁচ মাস। এর মধ্যেই বৈদেশিক মুদ্রা ব্যবস্থাপনা আবারও বড় ধরনের ধাক্কার মুখে পড়ার শঙ্কা আছে।

এ প্রসঙ্গে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ও বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, দুটি বিষয়ই আগে থেকেই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বাস্তবায়ন করা উচিত ছিল। ডলারের দর ধরে না রেখে বাজারের ওপর ছেড়ে দিলে এখন হঠাৎ করে দাম এত বেশি বাড়ত না। আগে থেকেই ধীরে ধীরে বাড়ত। এতে মানুষের সব কিছু সহনীয় হয়ে উঠত। এখন অর্থনৈতিক সংকটে চাপে পড়ে ডলারের দাম বাড়ানোয় পণ্যের দাম বেড়েছে। কষ্টে পড়েছে মানুষ। অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনাও চাপে পড়েছে। তিনি বলেন, রিজার্ভের হিসাবও ব্যবহারযোগ্য সম্পদের ভিত্তিতেই করা উচিত। হাতে নেই, অথচ কাগজে কলমে বেশি রিজার্ভ দেখানোর যুক্তি নেই।

সূত্র জানায়, বাজারে ডলার কেনার ৫ থেকে ৬ ধরনের উপকরণ রয়েছে। উপকরণ ভেদে দামও ভিন্ন ভিন্ন। একই সঙ্গে ডলার বিক্রির উপকরণও রয়েছে ৪ থেকে ৫ ধরনের। এগুলোর দামও ভিন্ন ভিন্ন। দাম ভিন্ন হওয়ায় ডলার কেনার ক্ষেত্রে দামের পার্থক্য হচ্ছে ২ থেকে ৩ টাকা। বিক্রির ক্ষেত্রে পার্থক্য আরও বেশি হচ্ছে। এছাড়া বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোতেও ডলারের দামের কোনো সমন্বয় নেই। একেক ব্যাংক একেক ধরনের দর নিচ্ছে। এতে আমদানিকারক, রপ্তানিকারক ও অন্যান্য গ্রাহক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

ডলার কেনার ক্ষেত্রে বিভিন্ন উপকরণের মধ্যে সব ব্যাংক রপ্তানি বিল কিনছে ১০৩ টাকা করে। প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স সর্বোচ্চ ১০৭ টাকা দরে কেনার কথা ব্যাংকগুলোর। কিন্তু অনেক ব্যাংক ১০৫ টাকা করেও কিনছে। কোনো কোনো ব্যাংক ১১০ থেকে ১১৪ টাকাতেও রেমিট্যান্স কিনছে। একই ডলার শুধু নামের কারণে দামের ব্যবধান হচ্ছে ২ থেকে ১১ টাকা। এ নিয়ে রপ্তানিকারকদের মধ্যে প্রচণ্ড ক্ষোভ রয়েছে। ছোট ব্যাংকগুলোতে দর বেশি হওয়ায় এখন ওইসব ব্যাংকের মাধ্যমে রেমিট্যান্স বাড়ছে। কিন্তু যেসব ব্যাংকের বিদেশে বড় নেটওয়ার্ক রয়েছে ওইসব ব্যাংকের দর কম হওয়ায় কারণে তাদের রেমিট্যান্স কমছে।

এদিকে আমদানির ক্ষেত্রে ডলারের দামও একেক ব্যাংকে একেক রকম। ১০২ টাকা থেকে ১১৪ টাকা করেও আমদানি ডলার বিক্রি হচ্ছে। ব্যাংক ভেদে ব্যবধান হচ্ছে ১২ টাকা। আন্তঃব্যাংকে প্রতি ডলার বিক্রি হচ্ছে সর্বোচ্চ ১০৭ টাকা।

এদিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর কাছে ডলার বিক্রি করছে ১০২ টাকা করে। এই ডলার দিয়ে আমদানি ব্যয় মেটানোর জন্য বাণিজ্যি ব্যাংক গ্রাহকদের কাছে বিক্রি করছে ১০৬ থেকে ১০৭ টাকা করে। এতে ডলারের দামে এক ধরনের বিশৃঙ্খলা বিরাজ করছে।

এছাড়াও টেলিগ্রাফিক ট্রান্সফার (টিটি), ওভার ড্রাফট (ওডি), ইলেকট্রনিক ট্রান্সফার (ইটি), নগদ ডলার ইত্যাদি নামেও ডলার বেচাকেনা হচ্ছে। এসব ক্ষেত্রেও ডলারের দাম ভিন্ন। ডলারের দামের সঙ্গে সমন্বয় করে অন্যান্য মুদ্রার নামও ভিন্ন হচ্ছে।

আইএমএফ বলেছে, ডলারের দামে এই বিশৃঙ্খলা রোধ করতে এর দর বাজারের ওপর ছেড়ে দিতে হবে। ডলারের বিভিন্ন উপকরণ কমিয়ে বেচা ও কেনা এই দুই ধরনের দাম ঠিক করতে হবে। এতে সব খাতেই দাম বেড়ে ১০৬ থেকে ১০৭ টাকায় উঠতে পারে।

বৈদেশিক মুদ্রা ব্যবসার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক লাইসেন্সপ্রাপ্ত বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর নির্বাহীদের সংগঠন বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বাফেদা) মাধ্যমে ডলারের দাম নির্ধারণ করে বাজারে প্রয়োগ করা হয়। এর নেপথ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হস্তক্ষেপ থাকে। আগে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সরাসরি হস্তক্ষেপ করত।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাবে গত এক বছরে ডলারের দাম বেড়েছে ২৫ শতাংশ। গত বছরের ১ ফেব্রুয়ারি প্রতি ডলারের দাম ছিল ৮৬ টাকা। এখন তা বেড়ে ১০৭ টাকা হয়েছে। ওই সময়ে দাম বেড়েছে ২১ টাকা। বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর হিসাবে দাম আরও বেশি বেড়েছে। ডলারের দাম বাড়লে পণ্যের আমদানি খরচ বাড়বে। এতে পণ্যের দামও বাড়বে। একই সঙ্গে বাড়বে সরকারের খরচও। এসব মিলে বাড়বে মূল্যস্ফীতির হার। গড় মূল্যস্ফীতি এখন ৭ দশমিক ৭০ শতাংশ। আইএমএফের মতে, বছর শেষে তা বেড়ে ৮ দশমিক ৯০ শতাংশে দাঁড়াতে পারে।

শর্ত অনুযায়ী আগামী জুনের মধ্যে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের নিট হিসাব প্রকাশ করতে হবে। অর্থাৎ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে ব্যবহার করার মতো যে বৈদেশিক মুদ্রা থাকবে তাই রিজার্ভে দেখাতে হবে। কোনো তহবিলে বিনিয়োগ করা অর্থ রিজার্ভে দেখানো যাবে না। আইএমএফের মতে, এতে দেশের নিট রিজার্ভ কমে আগামী মার্চে দুই হাজার ২৯৪ কোটি ডলারে দাঁড়াতে পারে। যা দিয়ে আড়াই মাসের কিছু বেশি সময়ের আমদানি ব্যয় মেটানো যাবে। আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী তিন মাসের আমদানি ব্যয়ের সমান রিজার্ভ থাকতে হয়। খাদ্য আমদানি করলে চার মাসের আমদানি ব্যয়ের সমান রিজার্ভ থাকতে হয়। বাংলাদেশ খাদ্য আমদানি করে। এ হিসাবে রিজার্ভ ঝুঁকিতে পড়ে যাচ্ছে। সংস্থাটির হিসাবে আগামী জুনে নিট রিজার্ভ বেড়ে দুই হাজার ৪৪৬ বিলিয়ন ডলার ও ডিসেম্বরে দুই হাজার ৬৮১ কোটি ডলারে দাঁড়াতে পারে। বাংলাদেশ ব্যাংকের আইএমএফের ঋণের প্রথম কিস্তি বাবদ ৪৭ কোটি ৬২ লাখ ডলার যোগ হওয়ার পর গ্রস হিসাবে এখন রিজার্ভ তিন হাজার ২৬৯ কোটি ডলার।

সূত্র: যুগান্তর
এম ইউ/০৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৩

Back to top button