আইএমএফ ছাড়া পাকিস্তানের আর কোনো উপায় নেই
ইসলামাবাদ, ২৯ জানুয়ারি – অবাধে পতন হচ্ছে পাকিস্তানি রুপির। দেশটিতে ডলারের বিনিময় হার এখন দাঁড়িয়েছে ২৬২ রুপি ৬০ পয়সায়। যদিও এক সপ্তাহ আগেও তা ছিল ২২৯ রুপি ৬৬ পয়সা। সে হিসেবে গত এক সপ্তাহে পাকিস্তানে ডলারের বিপরীতে রুপির অবমূল্যায়ন হয়েছে ১৪ শতাংশেরও বেশি। মূলত বৃহস্পতিবার থেকেই পাকিস্তানি মুদ্রার এ অবাধ পতনের প্রবণতা দেখা যাচ্ছে।
ওইদিন বাজারে ডলারের বিপরীতে পাকিস্তানি মুদ্রার অবমূল্যায়ন হয় ২৪ রুপি ৫৪ পয়সা। বৃহস্পতিবার দিন শেষে তা স্থির হয়েছিল ২৫৫ রুপি ৪৩ পয়সায়। সেখান থেকে আরো কমে শুক্রবার ডলারপ্রতি ২৬২ রুপি ৬০ পয়সায় সাপ্তাহিক বাজার শেষ করে পাকিস্তানি রুপি।
পাকিস্তানের অর্থনীতি এ মুহূর্তে বড় ধরনের উদ্বেগজনক পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। মুদ্রার অবাধ নিম্নমুখিতার পাশাপাশি দেশটির জনগণের জন্য দিনযাপনকে কঠিন করে তুলেছে অনিয়ন্ত্রিত মূল্যস্ফীতি। স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলোর তথ্য অনুযায়ী বর্তমানে দেশটিতে মূল্যস্ফীতির হার দাঁড়িয়েছে ২৫ শতাংশে। রিজার্ভ নেমে এসেছে প্রায় সাড়ে ৩ বিলিয়ন ডলারে। যদিও স্বল্প সময়ের মধ্যে দেশটিকে ঋণের কিস্তি ও সুদহার পরিশোধ করতে হবে এর চেয়ে কয়েক গুণ বেশি। সব মিলিয়ে আবারো দেউলিয়াত্বের মুখোমুখি পাকিস্তান। বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, দেউলিয়াত্বের প্রভাব সামাজিক-রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতায় ভোগা পাকিস্তানের জন্য শ্রীলংকার চেয়েও খারাপ পরিস্থিতির কারণ হয়ে দাঁড়াবে।
এ মুহূর্তে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) সহযোগিতা ছাড়া পাকিস্তানের পক্ষে এ পরিস্থিতি এড়ানো সম্ভব হবে না বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের ভাষ্যমতে, পাকিস্তানের নীতিনির্ধারকরা এখন সৌদি আরবসহ বেশ কয়েকটি দেশের কাছে ঋণের জন্য ধরনা দিচ্ছেন। আবার বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য আন্তর্জাতিক দাতাদের কাছ থেকেও প্রায় ১০ বিলিয়ন ডলার সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি পেয়েছেন তারা। কিন্তু এসব কিছুই এখন নির্ভর করছে আইএমএফের ঋণের ওপর। ২০১৯ সালে শুরু হওয়া ৭ বিলিয়ন (৭০০ কোটি) ডলারের প্যাকেজটির প্রথম কিস্তির অর্থ ছাড় হওয়ার আগ পর্যন্ত কোনো দাতা দেশ বা সংস্থা পাকিস্তানকে সহায়তা করতে রাজি নয়।
পর্যবেক্ষকরা বলছেন, কোনো দেশকে ঋণ দেয়ার আগে সংশ্লিষ্ট দেশের অর্থনীতির ঋণ ফেরত দেয়ার সক্ষমতা সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে নিতে চায় আইএমএফ। এজন্য সংস্থাটির পক্ষ থেকে নানা অর্থনৈতিক সংস্কারেরও শর্ত জুড়ে দেয়া হয়। এসব শর্তের পরিপালন নিশ্চিত হওয়ার পরই আইএমএফ ঋণ দেয়। এ কারণেই আইএমএফের ঋণসহায়তা নিশ্চিত হওয়ার পর অন্যান্য দাতা দেশের কাছ থেকেও ঋণপ্রাপ্তি সহজ হয়ে যায়। সব মিলিয়ে এখন আইএমএফই হয়ে উঠেছে পাকিস্তানি অর্থনীতির সর্বশেষ লাইফলাইন।
আগেও বহুবার আইএমএফের ঋণে ভর করে সংকট কাটাতে সক্ষম হয়েছে পাকিস্তান। কিন্তু এবারের দৃশ্যপট পুরোপুরি ভিন্ন। গত কয়েক মাসে দফায় দফায় আলোচনার পরও ঋণের অর্থ ছাড় করতে পারেনি দেশটি। পাকিস্তানের অর্থমন্ত্রী ইসহাক দারও সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশ্যেই আইএমএফের সমালোচনায় মুখর হয়েছেন। তার ভাষ্যমতে, পাকিস্তানের সঙ্গে ‘অস্বাভাবিক’ আচরণ করছে সংস্থাটি।
কিন্তু সংস্থাটির সহায়তা ছাড়া এ মুহূর্তে আর কোনো উপায় অবশিষ্ট নেই পাকিস্তানের। দেশটির সরকারি পরিসংখ্যানের সূত্র দিয়ে টাইম ম্যাগাজিন জানাচ্ছে, গত বছরের বন্যায় দেশটির ফসল মাঠে নষ্ট হয়েছে মৌসুমি উৎপাদনের ৮০ শতাংশ। এর মধ্যেই ক্রমবর্ধমান মূল্যস্ফীতি দেশটিতে ভয়াবহ খাদ্য সংকটের আশঙ্কা তৈরি করেছে। যদিও দেশটির বন্দরে আমদানীকৃত খাদ্য, ওষুধ ও জ্বালানিবাহী জাহাজ অপেক্ষমাণ অবস্থায় নোঙর করে আছে। কিন্তু তা খালাস করা যাচ্ছে না ডলারের অভাবে।
বিভিন্ন মাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, করাচি বন্দরে এখন অত্যাবশ্যকীয় নিত্যপণ্যের পাশাপাশি এলএনজি, পেট্রোলিয়াম পণ্য ও সয়াবিন নিয়ে প্রায় নয় হাজার কনটেইনার খালাসের অপেক্ষায় রয়েছে।
ঋণের কিস্তি ছাড় করার জন্য পাকিস্তানের ওপর কঠোর শর্ত আরোপ করেছে আইএমএফ। পর্যবেক্ষকরা বলছেন, এসব শর্ত পালন করতে গেলে দেশটির সরকারের স্থানীয় জনগণের কাছে জনপ্রিয়তা হারানোর বড় ধরনের আশঙ্কা রয়েছে। এসব শর্তের মধ্যে রয়েছে বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি, করজাল সম্প্রসারণ ও বিনিময় হারের ওপর থেকে নিয়ন্ত্রণ তুলে নেয়া। এর মধ্যে শেষ শর্তটি এরই মধ্যে পাল করেছে পাকিস্তান।
বর্তমানে পাকিস্তানে ডলারের বিপরীতে রুপির বিনিময় হারে অবাধ পতনের পেছনে আইএমএফের এ মুদ্রানীতির শর্ত অনেকাংশেই দায়ী বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের ভাষ্যমতে, আইএমএফের ফর্মুলার ভিত্তিতেই মুদ্রার বিনিময় হার থেকে নিয়ন্ত্রণ তুলে নিয়ে বাজারভিত্তিক করে দিয়েছে স্টেট ব্যাংক অব পাকিস্তান (এসবিপি)। কিন্তু নিয়ন্ত্রণ তুলে নেয়ার সময়ে অর্থনীতিতে ডলারের অন্তঃপ্রবাহ নিশ্চিত করা যায়নি। ফলে ডলারের চাহিদা ও সরবরাহের ঘাটতি বেড়ে এর সঙ্গে বিনিময় হারও বেড়ে গেছে।
গত বছর ইতিহাসের ভয়াবহতম এক বন্যার শিকার হয় পাকিস্তান। গৃহহীন ও কর্মহীন হয়ে পড়ে অসংখ্য মানুষ। পাকিস্তানের উদ্বেগকে আরো বাড়িয়ে তুলছে সামাজিক রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা। বিশেষ করে খাইবার পাখতুনখাওয়া ও বেলুচিস্তান প্রদেশে ক্রমবর্ধমান সহিংসতা এ মুহূর্তে পাকিস্তানের নীতিনির্ধারকদের জন্য বড় মাথাব্যথার কারণ হয়ে উঠেছে।
আগামী মঙ্গলবার আইএমএফের একটি প্রতিনিধি দলের ১০ দিনের সফরে ইসলামাবাদ যাওয়ার কথা রয়েছে। সফর চলাকালে তারা দেশটিতে সংস্থাটির পক্ষ থেকে দেয়া শর্তগুলো পরিপালনের তথ্য খতিয়ে দেখবেন। এ নিয়ে নবমবারের মতো আইএমএফের প্রতিনিধি দল পাকিস্তান সফরে যাচ্ছে। ২০১৯ সালে ইমরান খান সরকারের আমলে ৬০০ কোটি ডলারের ঋণের প্যাকেজ নিয়ে সংস্থাটির সঙ্গে আলোচনা শুরু করে পাকিস্তান। এরপর গত বছর এ প্যাকেজের ব্যাপ্তি আরো বেড়ে দাঁড়ায় ৭০০ কোটি ডলারে।
সূত্র: বণিক বার্তা
এম ইউ/২৯ জানুয়ারি ২০২৩