জাতীয়

থাইল্যান্ডের র‍্যানং থেকে চট্টগ্রাম সরাসরি জাহাজ চলাচল কতদূর?

সাইফ বাপ্পী

ঢাকা, ২৮ জানুয়ারি – থাইল্যান্ডের র‍্যানং থেকে বাংলাদেশের চট্টগ্রাম বন্দর পর্যন্ত সরাসরি জাহাজ চলাচলের শুরুতে দীর্ঘদিন ধরেই আগ্রহ দেখিয়ে আসছে দুই দেশের সরকার। এ বিষয়ে দুই দেশের মধ্যে আনুষ্ঠানিকভাবে আলোচনা শুরু হয় ২০১৬ সালে। ওই বছরের ফেব্রুয়ারিতে বাংলাদেশ সফরে আসে থাই বন্দর কর্তৃপক্ষের ১২ সদস্যের এক প্রতিনিধি দল। ঢাকায় অনুষ্ঠিত আলোচনায় দুই পক্ষ ঐকমত্যে পৌঁছায়, পারস্পরিক সমঝোতার ভিত্তিতে চট্টগ্রাম ও র্যানংয়ের মধ্যে সরাসরি জাহাজ চলাচল শুরু করা হবে। এজন্য শুরুতে চট্টগ্রাম বন্দরের বিদ্যমান সক্ষমতা ও সুযোগ-সুবিধা নিয়ে একটি সমীক্ষা চালানো হবে।

থাইল্যান্ড-বাংলাদেশ দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যসংশ্লিষ্টরা সে সময় বিষয়টি নিয়ে বেশ উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠেছিলেন। বর্তমানে বাংলাদেশ-থাইল্যান্ড বাণিজ্যে পণ্য পরিবহন হচ্ছে সিঙ্গাপুর বন্দর হয়ে। এভাবে চট্টগ্রাম থেকে র্যানং পর্যন্ত পণ্য পরিবহনে সাধারণত সময় লাগে প্রায় দুই সপ্তাহ। সরাসরি জাহাজ চলাচল শুরু হলে তা নেমে আসার কথা ছয় থেকে আটদিনে। উদ্যোগটি বাস্তবায়ন হলে পণ্য আমদানি-রফতানি ব্যয় কমে যাওয়াসহ দুই দেশেরই অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হওয়ার কথা ছিল। যদিও আলোচনা শুরুর পর সাত বছর পেরোলেও এখনো উদ্যোগটি প্রাথমিক পর্যায়েই রয়ে গেছে।

মিয়ানমারের রাখাইনে রোহিঙ্গাদের দমনে ২০১৬ সালের অক্টোবরে বিশেষ অভিযান শুরু করে দেশটির সামরিক বাহিনী। বঙ্গোপসাগরের রাখাইন উপকূল এলাকাজুড়ে চলমান অস্থিরতা সে সময় আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে এ এলাকা ব্যবহারকারীদের জন্য বড় উদ্বেগের কারণ হয়ে ওঠে। এর সঙ্গে সঙ্গে দৃশ্যপটের আড়ালে চলে যায় র্যানং-চট্টগ্রাম সরাসরি জাহাজ চলাচল শুরু নিয়ে আলোচনার বিষয়টিও। পরের বছর আরো তীব্র হয়ে দেখা দেয় রোহিঙ্গা সংকট। সে সময়ও বিষয়টি নিয়ে দৃশ্যমান বা সরাসরি কোনো অগ্রগতি অথবা উদ্যোগ দেখা দেয়নি। ২০১৮ সালে রাখাইনে বর্মি সেনাবাহিনীর তাণ্ডব কিছুটা স্তিমিত হয়ে আসে। একই সঙ্গে র্যানং-চট্টগ্রাম রুটটি নিয়ে আবারো আলোচনা শুরু হয় থাইল্যান্ডে।

ওই সময় থাইল্যান্ডের দক্ষিণাঞ্চলীয় প্রদেশগুলোর অর্থনৈতিক উন্নয়ন নিশ্চিতে সাউদার্ন ইকোনমিক করিডোর প্রকল্প গ্রহণ করে দেশটির সরকার। এরই অংশ হিসেবে দেশটির র্যানং বন্দরের সঙ্গে চট্টগ্রামের সরাসরি জাহাজ চলাচল সুবিধা চালু করা নিয়ে থাই মহলে আবার আলোচনা শুরু হয়। যদিও ২০২১ সালে দুই দেশের মধ্যে এ-সংক্রান্ত একটি সমঝোতা স্মারক সই হওয়া ছাড়া আর কোনো দৃশ্যমান অগ্রগতি এখন পর্যন্ত দেখা যায়নি।

আলোচনা শুরুর পর থেকে এ নিয়ে ইতিবাচক মনোভাব দেখিয়ে এসেছে বাংলাদেশও। দুই দেশের আগ্রহ সত্ত্বেও উদ্যোগটি গতিশীল না হওয়ার পেছনে রোহিঙ্গা সংকটের বড় একটি ভূমিকা থাকলেও থাকতে পারে বলে মনে করছেন কোনো কোনো বিশ্লেষক। নয়াদিল্লিভিত্তিক থিংকট্যাংক প্রতিষ্ঠান অবজারভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের (ওআরএফ) চলতি মাসে প্রকাশিত অকেশনাল পেপারের এক নিবন্ধে এ-সংক্রান্ত এক পর্যবেক্ষণে বলা হয়, ২০১৬ সালের প্রাথমিক বৈঠকের কয়েক মাসের মধ্যেই মিয়ানমারে রোহিঙ্গা সংকট পরিস্থিতির অবনতি হয়, যার ধাক্কা বাংলাদেশেও এসে পড়ে। এমন পরিস্থিতিতে হয়তো বাংলাদেশের সঙ্গে চলমান উপকূলীয় জাহাজ চলাচল চুক্তি-সংক্রান্ত আলোচনা নিয়ে না এগোনোই বুদ্ধিমানের কাজ হবে বলে ধরে নিয়েছে থাইল্যান্ড সরকার। কারণ সে ক্ষেত্রে চুক্তির অধীন জাহাজগুলোকে মিয়ানমারের রাখাইন উপকূল হয়ে আন্দামান সাগরে চলাচল করতে হবে।

তবে ভূরাজনীতি ও ভূঅর্থনীতির কোনো কোনো পর্যবেক্ষকের মধ্যে এর দ্বিমতও রয়েছে। সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ুন কবিরের মতে, আন্তর্জাতিক মেরিটাইম কার্যক্রম ও আইন অনুযায়ী অভ্যন্তরীণ অবস্থা যেমনই হোক না কেন, সেখানকার জলসীমায় অন্য দেশের জাহাজ চলাচলে তেমন একটা বাধা পড়ে না। সে ক্ষেত্রে রোহিঙ্গা ইস্যুর সঙ্গে এর সংযোগ থাকার সম্ভাবনা কম।

তবে যে কারণই থাকুক না কেন, এ মুহূর্তে থাইল্যান্ডের সঙ্গে বাণিজ্য বাড়ানোর বিষয়টিতে গুরুত্ব দেয়া প্রয়োজন বলে মনে করছেন তিনি। তিনি বলেন, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার যেসব দেশ শক্তিশালী অর্থনীতি হিসেবে বড় হচ্ছে, তার মধ্যে থাইল্যান্ড একটি এবং দেশটির এ ধরনের উদ্যোগগুলোয় প্রচুর বিদেশী বিনিয়োগও আছে। বর্তমান ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতি ও বাস্তবতা অনুযায়ী, বাংলাদেশের এখন এ ধরনের দেশগুলোর সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক জোরদার করার ওপর মনোযোগ দিতে হবে। আমাদের প্রেক্ষাপটে ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়ার মতো দেশগুলোর সঙ্গেও দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যিক-অর্থনৈতিক সম্পর্ক জোরদার করা উচিত। সে ক্ষেত্রেও চট্টগ্রাম বন্দর একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।

থাই গণমাধ্যমের বক্তব্য অনুযায়ী, র্যানং বন্দরটিকে প্রধানত বাংলাদেশ, ভারত, মিয়ানমার ও শ্রীলংকার সঙ্গে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া থেকে বাণিজ্যিক কার্যক্রম পরিচালনার গেটওয়েতে রূপ দিতে চাচ্ছে থাই সরকার। এজন্য বিশেষ জোর দেয়া হচ্ছে চট্টগ্রাম বন্দরের ওপর। দেশটির পক্ষ থেকে ২০১৬ সালে প্রথম আলোচনার সময় বলা হয়েছিল, র্যানং বন্দরকে বিমসটেক অঞ্চলভুক্ত দেশগুলোর (বাংলাদেশ, ভুটান, ভারত, মিয়ানমার, শ্রীলংকা, নেপাল ও থাইল্যান্ড) জন্য বড় একটি শিপিং হাব হিসেবে গড়ে তোলার পরিকল্পনা করা হচ্ছে। এ পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য চট্টগ্রাম বন্দরের সঙ্গে র্যানংয়ের সংযোগ গড়ে তোলা জরুরি। এ বিষয়ে থাই সরকারের প্রত্যাশা, বাংলাদেশে চট্টগ্রাম, পায়রা ও মোংলার সঙ্গে র্যানংয়ের সরাসরি সংযোগ তৈরি করা গেলে পরে তা ভারতের কলকাতা, চেন্নাই ও মুম্বাই বন্দর পর্যন্ত সম্প্রসারণের পথ তৈরি হবে। সে ক্ষেত্রে সংযোগটি বাংলাদেশ ও থাইল্যান্ড উভয়ের জন্যই লাভজনক প্রমাণিত হবে।

এছাড়া কভিড মহামারীর প্রাদুর্ভাবও চট্টগ্রাম-র্যানং জাহাজ চলাচলের কার্যক্রম বাস্তবায়ন বিলম্বিত করে তোলার জন্য দায়ী বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সচিব মো. ওমর ফারুক এ বিষয়ে বলেন, ‘আমরা আগে থেকেই বিষয়টি নিয়ে কাজ করছিলাম। করোনাকালে বিষয়টি থমকে গিয়েছিল। চট্টগ্রাম বন্দরের সঙ্গে থাই কর্তৃপক্ষের সম্প্রতি ভার্চুয়ালি একটি এমওইউ হয়েছে। তবে এর কার্যক্রম এখনো একেবারেই প্রাথমিক পর্যায়ে।’

শুধু থাইল্যান্ড নয়, মিয়ানমার, ভারত, নেপাল ভুটানসহ প্রতিবেশী প্রায় সবগুলো দেশই এখন চট্টগ্রাম বন্দরকে বাড়তি গুরুত্ব দিয়ে দেখছে। মিয়ানমারের ব্যবসায়ীরাও এখন সড়কপথের পরিবর্তে চট্টগ্রাম বন্দরে সরাসরি নৌপথে পণ্য পরিবহনে বেশি আগ্রহী। কারণ দুই দেশের স্থলবাণিজ্য মোটামুটি ব্যয়বহুল ও সময়সাপেক্ষ। তবে মিয়ানমারের সামরিক জান্তা ক্ষমতা দখল করে নেয়ার পর থেকে এ সম্ভাবনা অনেকটাই ম্রিয়মাণ হয়ে উঠেছে।

নেপাল-ভুটানের মতো স্থলভাগবেষ্টিত দেশগুলোর আন্তর্জাতিক বাণিজ্যেও এখন চট্টগ্রাম বন্দরকে বাড়তি গুরুত্ব দিয়ে দেখা হচ্ছে। বিশেষ করে নেপালের জন্য ভারতের কলকাতা বন্দর ব্যবহারের চেয়ে চট্টগ্রাম বা মোংলা বন্দর তুলনামূলক বেশি কাছে ও সুবিধাজনক। কলকাতা বন্দরের ওপর নির্ভরতা কমানোর ক্ষেত্রে ভুটানের জন্য সবচেয়ে ভালো বিকল্প হয়ে উঠেছে চট্টগ্রাম।

নিজ ভূখণ্ডের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় আট রাজ্যের অর্থনৈতিক উন্নয়নে চট্টগ্রাম বন্দরের ভূমিকা অনুধাবন করতে পারছে ভারতও। এ মুহূর্তে বাংলাদেশের সঙ্গে কানেক্টিভিটি বাড়ানোয় জোর দিচ্ছে দেশটি, যার বড় অংশই আবর্তিত হচ্ছে চট্টগ্রাম বন্দরকে ঘিরে।

সূত্র: বণিক বার্তা
আইএ/ ২৮ জানুয়ারি ২০২৩

Back to top button