জাতীয়

হঠাৎ আলোচনায় খালেদা জিয়া

ঢাকা, ২৮ জানুয়ারি – আবারও হঠাৎ আলোচনায় বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। যদিও তিনি দুর্নীতির মামলায় সাজাপ্রাপ্ত এবং এখন একটি সরকারি সিদ্ধান্তে সাজা খাটা স্থগিত অবস্থায় জেলের বাইরে গুলশানের বাড়িতে বাস করছেন।

ফৌজদারি অপরাধে আদালতের রায়ে দণ্ডিত জেলবন্দি ব্যক্তির রাজনীতিতে কোনো প্রকাশ্য ভূমিকা থাকার কথা নয়। তবে তাঁর সাজা স্থগিত রয়েছে কোনো শর্তাধীনে কিনা, তা নিয়ে বিএনপি নেতারা মাঝেমধ্যে বিতর্ক তোলেন। রাজনৈতিক আলোচনায়ও এমন প্রশ্ন সামনে আনা হয়- তাঁর অনুপস্থিতিতে কে হবেন বিএনপির শীর্ষ নেতা, দল ক্ষমতায় এলে কে হবেন সরকারপ্রধান ইত্যাদি। বিএনপির চলতি আন্দোলনের মধ্যে সম্প্রতি ‘১০ ডিসেম্বরের পর দেশ চলবে খালেদা জিয়ার নির্দেশে’ মর্মে আওয়াজ ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল।

তখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ৩ ডিসেম্বর জেলহত্যা দিবস স্মরণে আওয়ামী লীগের অনুষ্ঠানে ভাষণে মানবিক কারণে খালেদার সাজা স্থগিত সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘বিএনপি যদি বেশি বাড়াবাড়ি করে … বেশি বাড়াবাড়ি করলে আবার জেলে পাঠিয়ে দেব।’

সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য শেখ ফজলুল করিম সেলিম তাঁর বক্তব্যে খালেদা জিয়াকে কারাগার থেকে বাসায় আনা সম্পর্কে বলেছেন, তিনি রাজনীতি করবেন না বলে মুচলেকা দেওয়া রয়েছে।

বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ওই দিনই সংবাদমাধ্যমের কাছে শেখ সেলিমের বক্তব্য অসত্য বলে জোরালোভাবে দাবি করেছেন। এ নিয়ে দু’পক্ষের পাল্টাপাল্টি বক্তব্যে আবারও সরগরম হয়ে উঠেছে রাজনীতির মাঠ। খালেদা জিয়ার নেতৃত্ব নিয়ে চলছে নানা হিসাব-নিকাশ।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের গতকাল সাংবাদিকদের বলেন, ‘পত্রিকায় দেখেছি। আমাদের দলের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য শেখ ফজলুল করিম সেলিম একজন দায়িত্বশীল মানুষ। নিশ্চয়ই তাঁর কাছে এই বিষয়টিতে প্রমাণ রয়েছে। তাঁর মতো একজন ব্যক্তি প্রমাণ ছাড়া কোনো কথা বলবেন- এটাও তো বিশ্বাস করা যায় না। কাজেই এ নিয়ে আমি কোনো প্রশ্ন করতে চাই না।’

বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল গতকাল বলেছেন, বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে ভয় পায় আওয়ামী লীগ। তাঁর জনপ্রিয়তায় ভীত দলটি মিথ্যা মামলায় সাজা দিয়েছে। খালেদা জিয়া রাজনীতি করবেন না- এ ধরনের কোনো মুচলেকা দেওয়ার প্রশ্নই ওঠে না।

গণমাধ্যমকেও মির্জা ফখরুল জানান, শেখ সেলিমের বক্তব্য সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন ও বানোয়াট।

দু’বছর আগে দেশে করোনা মহামারির সময় পরিবারের আবেদনে দুটি শর্তে খালেদা জিয়ার সাজা সাময়িক স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত হয় বলে ওই সময় সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। সেগুলো হলো- এই সময় তাঁর ঢাকায় নিজের বাসায় থাকতে হবে এবং তিনি বিদেশে যেতে পারবেন না।

আইনমন্ত্রী জানিয়েছিলেন, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে ছয় মাসের জন্য তাঁর সাজা স্থগিত করা হয়েছে। খালেদা জিয়ার বয়স বিবেচনায়, মানবিক কারণে, সরকার সদয় হয়ে দ াদেশ স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

গতকাল শুক্রবার আইনমন্ত্রীর বক্তব্য জানার জন্য পক্ষ থেকে একাধিকবার চেষ্টা করেও ফোনে তাঁকে পাওয়া যায়নি।

খালেদা জিয়ার আইনজীবী জয়নাল আবেদীন গতকাল বলেছেন, সরকার যে ক্ষমতাবলে সিদ্ধান্তটি দিয়েছেন, সেই ফৌজদারি কার্যবিধির ৪০১ ধারায় মুচলেকা দেওয়ার কোনো বিধান নেই। তিনি বলেন, ‘কার্যত আমরা অনেকবার আদালতে খালেদা জিয়ার জামিনের জন্য আবেদন করেছি। কিন্তু আদালত জামিন দেননি। তখন আমরা সরকারের হাতে থাকা ৪০১ ধারার ক্ষমতাবলে জামিনের আবেদন করেছি। তারা সেই ধারা অনুযায়ী সাজা স্থগিত করে মুক্তি দিয়েছে। এখানে রাজনীতি না করার ব্যাপারে মুচলেকার প্রশ্নই ওঠে না। এটি শেখ সেলিমের রাজনৈতিক বক্তব্য।’

দুর্নীতির দুই মামলায় মোট ১৭ বছর সাজাপ্রাপ্ত খালেদা জিয়া ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি কারাবন্দি হন। ২০২০ সালের ২৫ মার্চ থেকে খালেদা জিয়া গুলশানের ভাড়া বাড়িতে অবস্থান করছেন। ওই সময় সরকারের নির্বাহী আদেশে প্রথমে ছয় মাসের জন্য শর্তসাপেক্ষে মুক্তি পান খালেদা জিয়া। এর পর প্রতি ছয় মাস পরপর তাঁর সাজা স্থগিতের মেয়াদ বাড়ানো হচ্ছে। এবার নিয়ে ছয়বার হয়েছে।

বৃহস্পতিবার সংসদ অধিবেশন শেষ হওয়ার পর শেখ ফজলুল করিম সেলিম সংসদে দেওয়া তাঁর বক্তব্যের ব্যাখ্যা নিজেই দিয়েছেন। সাংবাদিকদের তিনি বলেছেন, ‘খালেদা জিয়ার মুক্তির জন্য তাঁর ভাই শামীম এস্কান্দার ও বোন সেলিমা রহমান ২০২০ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করেছিলেন। তখন তাঁদের বলা হয়েছিল, সরকারের নির্বাহী আদেশে মুক্তি পেলে খালেদা জিয়া রাজনীতি করতে পারবেন না- এই মুচলেকা দিতে হবে। সে সময় খালেদা জিয়ার রাজনীতি না করার ব্যাপারে মুচলেকা দেওয়া হয়েছিল।’ সেই মুচলেকা লিখিত ছিল কিনা- এমন প্রশ্নের জবাবে শেখ সেলিম জানান, সেটা তাঁর জানা নেই।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ক্ষমতাসীন দলের কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতা বলেছেন, দুর্নীতি মামলায় ১৭ বছরের সাজাপ্রাপ্ত হওয়ায় বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়ার পক্ষে এমনিতেই রাজনীতি করার কোনো সুযোগই নেই। সেটা তিনি লিখিত মুচলেকা দিন বা না দিন। তা ছাড়া শর্তসাপেক্ষে মুক্তি দিয়ে তাঁকে তাঁর বাসায় থাকার সুযোগ দেওয়ার সময়ই সরকারের অন্যতম শর্তও ছিল, তিনি রাজনীতি করতে পারবেন না। এই শর্ত মেনেই তো খালেদা জিয়ার পরিবারের সদস্যরা তাঁকে নিজ বাসায় রাখার বিষয়ে সম্মতি দিয়েছিলেন। ফলে মুচলেকা লিখিত ছিল কী, ছিল না- এমন প্রশ্ন তোলা অবান্তর।

তা ছাড়া ওয়ান-ইলেভেনের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় খালেদা জিয়ার ছেলে তারেক রহমান যে ‘আর রাজনীতি করবেন না’ বলে লিখিত মুচলেকা দিয়ে দেশে ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছিলেন, সেটা ধ্রুব সত্য বলে এই নেতারা উল্লেখ করেন।

এ বিষয়ে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের আরও বলেন, ‘জিয়াউর রহমানের সন্তান তারেক রহমান সম্পর্কে আমি জানি। এটা আমরা পরিস্কারভাবে জানি। তখন আমরা বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রিজন সেলে ছিলাম। সেও (তারেক রহমান) সেখানে ছিল। সে যে মুচলেকা দিয়ে আর রাজনীতি করবে না বলে চলে গিয়েছিল- এর সত্যতা কিন্তু আমাদের কাছে আছে।’

বিএনপি নেতাদের দাবি, খালেদা জিয়াকে রাজনীতি থেকে দূরে রাখতে অন্যায়ভাবে কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। খালেদা জিয়াকে কারাবন্দি এবং তারেক রহমানকে বিদেশে রেখেও বিএনপি লাখ লাখ মানুষের উপস্থিতিতে রাজনৈতিক আন্দোলনের কর্মসূচি পালন করছে। দীর্ঘদিন দলের এই দুই শীর্ষ নেতার অনুপস্থিতিতে দলের কোনো ক্ষতি হয়নি। বিএনপির প্রতি মানুষের জনসমর্থন বেড়েছে।

বিরোধী নেতাদের মতে, সাবেক প্রধানমন্ত্রী এখনও এত প্রাসঙ্গিক যে, তাঁকে বন্দি রেখেও সরকারের লাভ হচ্ছে না। খালেদা জিয়াকে কীভাবে স্থায়ীভাবে রাজনীতির বাইরে রাখা যায়, সে চেষ্টা করা হচ্ছে। মুচলেকা প্রভৃতি বক্তব্য সরকারের দুর্বলতার লক্ষণ বলে তাঁরা দাবি করছেন।

সূত্র: সমকাল
এম ইউ/২৮ জানুয়ারি ২০২৩

Back to top button