ব্যবসা

‘এক্সপার্ট’ তৈরিতে বিদেশে প্রশিক্ষণের প্রস্তাব, কমিশনের প্রশ্ন

মফিজুল সাদিক

ঢাকা, ২৮ জানুয়ারি – বৈশ্বিক মন্দাজনিত আর্থিক সংকটের মধ্যে পর্যাপ্ত বরাদ্দ মিলছে না দেশের বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে। পরিস্থিতি বিবেচনায় কর্মকর্তাদের বিদেশ সফরও বন্ধ রেখেছে সরকার। এরপরও প্রস্তাবিত প্রকল্পগুলোতে ঠিকই থাকছে প্রশিক্ষণের নামে বিদেশ ভ্রমণে অর্থের সংস্থান।

সম্প্রতি ‘ইমপ্রুভিং কম্পিউটার অ্যান্ড সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারিং টারশিয়ারি এডুকেশন’ প্রকল্পের আওতায় ৭৫ কর্মকর্তার বৈদেশিক প্রশিক্ষণের প্রস্তাব রেখেছে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর। এ খাতে ব্যয় ধরা হয়েছে ১১ কোটি ৪০ লাখ টাকা। পুরো টাকাই এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের ঋণ। তবে, বৈশ্বিক মন্দায় এমন প্রস্তাবনা নিয়ে প্রশ্ন তুলে ব্যয় কমানোর পরামর্শ দিয়েছে পরিকল্পনা কমিশন।

সম্প্রতি আর্থ-সামাজিক অবকাঠামো বিভাগের সদস্য (সচিব) মোসাম্মৎ নাসিমা বেগমের সভাপতিত্বে সংশ্লিষ্টদের নিয়ে প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) সভা হয় পরিকল্পনা কমিশনে। সভায় প্রকল্পের একাধিক বিষয় নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে কমিশন। এসব বিষয়ে ব্যয় কমিয়ে যৌক্তিক পর্যায়ে নিয়ে আনার জন্য বাংলাদেশ মঞ্জুরি কমিশনকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। চিঠির জবাব এলেই পরবর্তী ধাপে পদক্ষেপ নেবে কমিশন।

সভা সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়। পরিকল্পনা কমিশনের আর্থ-সামাজিক অবকাঠামো বিভাগের যুগ্ম প্রধান (শিক্ষা উইং) রাহনুমা নাহিদ বলেন, প্রকল্পের পিইসি সভা হয়েছে। ইউজিসির প্রস্তাবিত প্রকল্পের বিষয়ে আমাদের কিছু কোয়ারি আছে। ইউজিসি এগুলো মিটআপ করলেই পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে। প্রকল্পের অনেক খাতের ব্যয় নিয়ে পরিকল্পনা কমিশন প্রশ্ন তুলেছে।’

পরিকল্পনা কমিশন সূত্র জানায়, প্রকল্পের আওতায় ৭৫ জনের বৈদেশিক প্রশিক্ষণসহ সেমিনার, ওয়ার্কশপ, অ্যাডভোকেসি এবং দেশে দুই হাজার ৯১১ জনের প্রশিক্ষণ খাতে মোট ৭৭ কোটি টাকা ব্যয়ের প্রস্তাব করা হয়েছে। এমন প্রস্তাবের যৌক্তিকতা জানতে চেয়েছে কমিশন। বর্তমান বৈশ্বিক অর্থনৈতিক অবস্থার প্রেক্ষাপট বিবেচনায় সরকার কৃচ্ছ্রসাধনে প্রশিক্ষণ খাতের ব্যয় কমানোসহ বিভিন্ন ধরনের পদক্ষেপ নেওয়ার নির্দেশনা দিয়েছে অর্থ বিভাগ। এছাড়া, প্রকল্প থেকে বৈদেশিক প্রশিক্ষণ ও আন্তর্জাতিক ভিজিটিং প্রফেসর নিয়োগের প্রস্তাবের যৌক্তিকতা নিয়ে আরও আলোচনা করা যেতে পারে বলে সাফ জানিয়ে দিয়েছে কমিশন।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, প্রকল্পে ২৫ ক্যাটাগরিতে বিভিন্ন ধরনের ন্যাশনাল কনসালট্যান্ট, সিনিয়র প্রকিউরমেন্ট স্পেশালিস্ট, প্রকিউরমেন্ট, ফাইন্যান্সিয়াল স্পেশালিস্ট ও ইন্টারন্যাশনাল কনসালট্যান্ট খাতে বাড়তি ব্যয় ধরা হয়েছে। আন্তর্জাতিক ভিজিটিং প্রফেসরস কনসালট্যান্ট নিয়োগ বাবদ এডিবির অর্থ থেকে প্রস্তাব করা হয়েছে প্রায় ৭৩ কোটি টাকা ব্যয়ের। অথচ বৈদেশিক অর্থায়নে পরামর্শক সেবা গ্রহণ না করার বিষয়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সরকারি নির্দেশনা রয়েছে। প্রায় ৭৩ কোটি টাকা পরামর্শক সেবা গ্রহণের ব্যয় প্রস্তাব পুনঃপর্যালোচনা করা প্রয়োজন বলে জানায় কমিশন।

এছাড়া, বিশেষায়িত প্রফেশনাল কাজের জন্য সাধারণভাবে পরামর্শ সেবা গ্রহণ করা হয়। কিন্তু দাপ্তরিক কাজেও পরামর্শক ব্যয় ধরা হয়েছে। এসব কাজের জন্য কোনো পরামর্শক সেবার প্রয়োজন নেই বলে জানায় কমিশন। একই সঙ্গে প্রতিটি ম্যানেজমেন্ট ইউনিটে প্রকিউরমেন্ট স্পেশালিস্ট পদ থাকার পরও সাধারণ প্রকৃতির দাপ্তরিক ক্রয়ে কেন কেন্দ্রীয় প্রকিউরমেন্ট স্পেশালিস্ট প্রয়োজন তা সুস্পষ্ট নয়। বিষয়গুলো সম্পর্কে আরও গভীরভাবে পর্যালোচনা করে প্রকল্প প্রস্তাব করার পরামর্শ দিয়েছে কমিশন।

জানা যায়, প্রস্তাবিত প্রকল্পে তিনটি বিশ্ববিদ্যালয়ের আইটি-আইটিএস বিভাগের অন্য নতুন একাডেমিক ভবন নির্মাণসহ পূর্ত খাতে তিন কোটি ৯২ লাখ টাকার প্রস্তাব করা হয়েছে। নির্মাণ ও পূর্ত কাজের প্রাক্কলন গণপূর্ত অধিদপ্তরের রেট শিডিউল-২০১৮ অনুসরণে করা হয়েছে বললেও ডিপিপিতে ইঞ্জিনিয়ারিং এস্টিমেট আকারে তা সংযুক্ত করা হয়নি।

প্রকল্প থেকে পাঁচ হাজার ১৯৭ জন শিক্ষার্থীকে প্রায় ৮৭ কোটি টাকা স্কলারশিপ-ফেলোশিপ অ্যাওয়ার্ড প্রোগ্রাম প্রস্তাব করা হয়েছে। তবে প্রকল্প সমাপ্তির পর কীভাবে এ কার্যক্রম পরিচালনা করা হবে তার সুস্পষ্ট রূপরেখা ডিপিপিতে থাকা প্রয়োজন। প্রকল্প বাস্তবায়নে ডিপিপিতে একটি জিপ, চারটি মাইক্রোবাস কেনা বাবদ দুই কোটি ৮২ লাখ টাকার প্রস্তাব করা হয়েছে। মাইক্রোবাসের প্রয়োজনীয়তা ও যৌক্তিকতা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছে কমিশন।

অর্থ বিভাগ থেকে বর্তমান বৈশ্বিক অর্থনৈতিক অবস্থার প্রেক্ষাপট বিবেচনায় ক্রয় পরিকল্পনায় কম্পিউটার সামগ্রী, অফিস সরঞ্জাম ও আসবাবপত্র সংগ্রহে একাধিক ছোট ছোট প্যাকেজের প্রস্তাব করা হয়েছে, যা সংশোধন করা প্রয়োজন।

প্রকল্প প্রসঙ্গে ইউজিসির সদস্য প্রফেসর ড. মো. সাজ্জাদ হোসেন বলেন, পিইসি সভা হয়েছে। ইউজিসির চেয়ারম্যান স্যার যেভাবে চান সেভাবে সব হবে। সংশ্লিষ্টদের আলাপ-আলোচনা করে প্রকল্প বাস্তবায়নে এডিবির মতামত নেওয়া হবে।

বৈদেশিক প্রশিক্ষণে ১১ কোটি ৪০ লাখ টাকা প্রস্তাব প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘এটা বৈদেশিক ভিজিট নয়। কোনো কিছু ঘুরে বা দেখে আসাও নয়। পরিকল্পনা কমিশন যদি কিছু জানতে চায় সেগুলো বুঝিয়ে বলবো। এটা টিচার ও এক্সপার্ট ট্রেনিং। বলা যায় এক্সপার্ট তৈরি করা। ডলারের সংকট হবে না, কারণ ডলার এডিবি দেবে। ডলার ক্রাইসিসের সঙ্গে এটা সম্পৃক্ত নয়।’

ইউজিসি থেকে জানা যায়, প্রকল্পের প্রস্তাবিত ব্যয় এক হাজার ৯৪ কোটি ৯৯ লাখ টাকা। প্রকল্পে সরকারি অর্থায়ন ২৫২ কোটি ৬৯ লাখ এবং বাকি ৮৪২ কোটি ৩০ লাখ টাকা এডিবি ঋণ। প্রকল্পটি অনুমোদনের পর পাঁচ বছরে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করবে বাংলাদেশ মঞ্জুরি কমিশন। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হবে।

প্রকল্পের উদ্দেশ্য
কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং-ইনফরমেশন টেকনোলজি বিষয়ের জন্য গুণমান, সম-সুযোগ এবং দক্ষতার ভিত্তিতে অধিক প্রাসঙ্গিক উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা, আইটি-আইটিএস সেক্টরে দেশকে নেতৃত্ব দিতে সক্ষম এমন স্নাতক তৈরি ও আধুনিক গবেষণার সুযোগ সৃষ্টির মাধ্যমে বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থার উন্নয়ন।

প্রকল্পের সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য
তথ্যপ্রযুক্তি শিল্পের প্রয়োজনের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ বিষয়ে স্নাতকের সংখ্যা বাড়ানো, প্রকল্পের আওতাভুক্ত তিন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দুই হাজার ২শ শিক্ষার্থীকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি দেওয়া, ডিগ্রি অর্জনের ছয় মাসের মধ্যে কমপক্ষে ৪০ শতাংশ স্নাতক নারী-পুরুষকে চাকরিতে যোগদানে সক্ষম করা প্রভৃতি।

মূল কার্যক্রম
প্রকল্পভুক্ত তিনটি বিশ্ববিদ্যালয়ে আইটি-আইটিএস বিভাগের জন্য নতুন একাডেমিক ভবন নির্মাণ, তিনটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সংশ্লিষ্ট বিভাগের জন্য অফিস ইক্যুপমেন্ট, কম্পিউটার সামগ্রী ও টিচিং অ্যান্ড লার্নিং মেটেরিয়াল সংগ্রহ করা, প্রকল্প বাস্তবায়নে একটি জিপ ও চারটি মাইক্রোবাস কেনা, গবেষণা পরিচালনা, দেশীয় পরামর্শক এবং আন্তর্জাতিক ভিজিটিং প্রফেসর নিয়োগ।

উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক থেকে প্রকল্পে ঋণ সহায়তা মিলবে বলে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ থেকে চিঠি পাওয়া গেছে।

সূত্র: জাগো নিউজ
আইএ/ ২৮ জানুয়ারি ২০২৩

Back to top button