অপরাধ

জাহাজ আমদানির নামে ২ দশমিক ৫ মিলিয়ন ডলার পাচার

আসাদুল্লা লায়ন

ঢাকা, ২৪ জানুয়ারি – ডিসকভারি ট্রেডিং নামে একটি কোম্পানির ম্যানেজিং ডিরেক্টর জাহিদ হোসেন মিয়া। প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান তার স্ত্রী মাহবুবা আক্তার। ২০১৩ সালে তারা ব্যাংকক থেকে একটি ফিশিং জাহাজ আমদানির জন্য সিঙ্গাপুরের এরিয়েল মেরিটাইম নামক প্রতিষ্ঠানকে প্রস্তাবনা পাঠান। এর কিছুদিন পর তাদের মধ্যে একটি চুক্তি হয়। এতে এরিয়েল মেরিটাইমের জন্য সিঙ্গাপুরের স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক ও ডিসকভারি ট্রেডিং কোম্পানির জন্য ট্রাস্ট ব্যাংককে আর্থিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে ঠিক করা হয়। পরিকল্পনা অনুযায়ী তারা জাহাজের দাম যাচাই-বাছাই করেন। এরপর ব্যাংকিং রীতি অনুযায়ী প্রতিষ্ঠান দুটি ২ দশমিক ৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের একটি ট্রান্সফারেবল এলসি গ্রহণ করে। পরে এরিয়েল মেরিটাইম চুক্তি অনুযায়ী থাইল্যান্ডের জাহাজ সরবরাহকারী কোম্পানি মার্চেন্ট হাব কোম্পানির কাছে এলসি হস্তান্তর করে।

আমদানিকারক জাহিদ হোসেন মিয়া ও তার ভায়রা এবং প্রতিঠানটির প্রধান ইঞ্জিনিয়ার জাহাজটির কাজের নিয়মিত তদারকি শুরু করেন। ফিশিং জাহাজটি দ্রুত বাংলাদেশে নিয়ে আসার জন্য তারা নিয়মিত থাইল্যান্ডে যাতায়াতও করতে থাকেন। এর ধারাবাহিকতায় থাইল্যান্ডে ডিসকভারি ট্রেডিং কোম্পানির ক্যাপ্টেন মো. ফারুক ও ইঞ্জিনিয়ার জাকির হক জাহাজটি থাইল্যান্ডের সমুদ্রে চালিয়ে দেখেন। ফিশিং এই জাহাজটির পরিক্ষামূলক যাত্রা সন্তোষজনক ও যন্ত্রপাতি ভালোভাবে কাজ করছে বলে জানান তারা।

এরপর জাহিদ হোসেন জাহাজটির ট্রায়াল শেষ হয়েছে এবং বুঝে পেয়েছেন জানিয়ে ট্রাস্ট ব্যাংকে প্রটোকল অব ডেলিভারি ডকুমেন্ট জমা দেন। নিয়ম অনুযায়ী তিনি জাহাজের মূল্য পরিশোধের জন্য ব্যাংকটির দিলকুশা শাখাকে লিখিত নির্দেশনা দেন। নির্দেশনা অনুযায়ী ব্যাংক কর্তৃপক্ষ ট্রলার পাওয়ার ৪ দিন পর ২৪ লাখ ৯৯ হাজার ৮০০ মার্কিন ডলার আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে জাহাজ সরবরাহকারীর প্রতিষ্ঠানকে পরিশোধ করে।

এর কিছুদিন পর জাহাজটি বাংলাদেশে আমদানির বিল অব এন্ট্রি না দেওয়ার বিষয়টি ব্যাংক কর্তৃপক্ষের নজরে আসে। এরপর তা দাখিলের জন্য জানালে জাহিদ হোসেন সময়ক্ষেপণ করতে থাকেন। একপর্যায়ে তিনি জানান, বঙ্গোপসাগরের প্রতিকূল আবহাওয়ায় ফিশিং জাহাজটি আনতে বিলম্ব হচ্ছে।

এভাবে সময়ক্ষেপণে সন্দেহ জাগে ব্যাংক কর্তৃপক্ষের। এরপর ট্রাস্ট ব্যাংক দিলকুশা শাখার কর্মকর্তাদের একটি দল ২০১৬ সালে থাইল্যান্ড সফর করেন। তারা পরিদর্শনে দেখতে পান, জাহাজটির তৈরির কাজ তখনও বাকি রয়েছে। মেইন ইঞ্জিন, জেনারেটর এবং ফিশিং ইকুইপমেন্টসহ অন্যান্য বেশকিছু সরঞ্জাম ছাড়াই জাহাজটি তাদের জেটিতে রয়েছে। এসব বিষয় উল্লেখ করে তারা প্রতিবেদন জমা দেন।

ট্রাস্ট ব্যাংকের এই দলটি ২০১৭ সালে ফের পরিদর্শনে যায়। তখন তাদের সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে জানানো হয়, জাহাজটির বাকি কাজ শেষ করতে আরও মোটা অংকের টাকা প্রয়োজন। ব্যাংকের এই প্রতিনিধিদল বাড়তি টাকা পরিশোধ করতে অপারগতা জানিয়ে জাহাজটি দ্রুত বাংলাদেশে পাঠানোর নির্দেশ দিয়ে ফিরে আসে।

২০২০ সালে ঘটনাটি বাংলাদেশ পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) নজরে আসে। এরপর সিআইডির ফাইন্যান্সিয়াল ক্রাইম ইউনিট অনুসন্ধান শুরু করে। এতে উঠে আসে ডিসকভারি ট্রেডিং কোম্পানির ম্যানেজিং ডিরেক্টর জাহিদ হোসেন মিয়ার প্রতারণার ছক। তারা জানতে পারে, থাইল্যান্ডে জান্তা সরকার ক্ষমতায় আসায় মার্চেন্ট হাবের মালিক মি. বুনজানের সকল ব্যাংক হিসেব ফ্রিজ করা হয়েছে। ফলে তিনি আর্থিক সংকটে পড়ে ট্রলারের কাজ শেষ করতে পারেননি। জাহাজটি পুরোপুরি প্রস্তুত করতে আরও ৩ থেকে ৪ মাস সময় লাগবে। অভিযুক্ত জাহিদ হোসেন ফিশিং জাহাজটি প্রস্তুত না হওয়া সত্ত্বেও সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান মার্চেন্ট হাবের প্যাডে ট্রলারটি প্রটোকল অব ট্রেইল ও রেডিনেস সার্টিফিকেটসহ সব কাগজপত্র প্রস্তুত করেন।

এ ছাড়াও যে ক্যাপ্টেন ও ইঞ্জিনিয়ারকে দিয়ে ফিশিং জাহাজটির পরিক্ষামূলকভাবে চালানোর কথা জানিয়েছিলেন অথচ তারা এ ঘটনাই জানেন না। সেই চিফ ইঞ্জিনিয়ার মো. জাহাঙ্গীর আলমের নিয়োগের আগেই জালিয়াতির মাধ্যমে ভুয়া কাগজপত্র তৈরি করে ব্যাংকে জমা দেন জাহিদ হোসেন। ফিশিং জাহাজটির পরিক্ষামূলকভাবে চালানোর সময় তার প্রতিষ্ঠানের জাকির হক এবং ফারুক নামে আরও দুজন ক্যাপ্টেন অংশ নেয় বলে জানান। তবে তারাও এ প্রতিষ্ঠানের কর্মচারী ছিলেন না বলে জানতে পারে সিআইডি।

তদন্তে সিআইডি আরও জানতে পারে, ক্যাপ্টেন জাকির হকের প্রকৃত নাম মো. জাকির হোসেন এবং ক্যাপ্টেন ফারুকের প্রকৃত নাম খান সালাউদ্দিন ফারুক। তারা দুজন ক্রিস্টাল ফিসারিজ কোম্পানিতে চাকরিরত। এ ঘটনার সময় তারা প্রতিষ্ঠানটির তিনটি ট্রলার আমদানিতে ইঞ্জিনিয়ার এবং ক্যাপ্টেন হিসেবে কাজ করেন।

তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্র জানান, অভিযুক্ত ডিসকভারি ট্রেডিং কোম্পানির ম্যানেজিং ডিরেক্টর জাহিদ হোসেন পাচারের ঘটনায় আথিক লেনদেন খুবই সুক্ষ্মভাবে পরিচালনা করেছেন। তার এই লেনদেনের প্রক্রিয়া অর্থপাচারের এই আইনে রিপোর্ট করাও দুস্কর। এ ছাড়াও ফিশিং জাহাজটি হস্তান্তরের পর ইঞ্জিনিয়ার নিয়োগ দিয়েছেন এবং জাহাজটি বাংলাদেশের সমুদ্রে যাত্রা করতে আরও অর্থের প্রয়োজন বলে আরও অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনা ছিল।

এ ঘটনার পর প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান তার স্ত্রী মাহবুবা আক্তারকে বিদেশে পাঠিয়েছেন। অভিযুক্ত জাহিদের নামে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে তা পরিশোধ না করায় বহু মামলা বিচারাধীন। এর মধ্যে ঢাকার আদালতে ২টি মামলা, চট্টগ্রামের ডাবলমুরিং থানায় ৭ মামলায় সাজা, ২ মামলায় গ্রেপ্তারি পরোয়ানা, হালিশহর থানায় ৫ মামলায় সাজা, ১ মামলায় গ্রেপ্তারি পরোয়ানা, এ ছাড়া পাচলাইশ থানার প্রায় ৩৩ মামলায় গ্রেপ্তারি পরোয়ানা রয়েছে।

সিআইডির ফাইন্যান্সিয়াল ক্রাইম ইউনিটের বিশেষ পুলিশ সুপার হুমায়ুন কবির জানান, ট্রলার আমদানির নামে অর্থপাচারের ঘটনায় মামলা দায়ের করেছিল সিআইডি। এর অনুসন্ধান কার্যক্রম শেষ হয়েছে। এতে ২ দশমিক ৫ মিলিয়ন ডলার পাচারের প্রমাণ পাওয়া গেছে। আদালতে এ মামলার অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়েছে।

সূত্র: দেশ রূপান্তর
আইএ/ ২৪ জানুয়ারি ২০২৩

Back to top button