জাতীয়

‘ছন্দপতনে’ বিএনপির নতুন পরিকল্পনা

কামরুল হাসান

ঢাকা, ২২ জানুয়ারি – সারাদেশে সরকারবিরোধী চলমান আন্দোলনে সাময়িক ছন্দপতন ঘটেছে বলে মনে করছে বিএনপি। দলের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটির সভায় এ নিয়ে আলোচনা উঠেছে। তাই এবার নতুন কৌশলে মাঠে নামতে চায় দলটি। একদিকে ধীরে চলো নীতি, অন্যদিকে রাজপথে থাকতে ধারাবাহিক কর্মসূচি। নেতাকর্মীকে চাঙ্গা রাখতেও নানামুখী তৎপরতা রয়েছে দলটির। চলমান আন্দোলনে জনসম্পৃক্ততা বাড়াতেও নেওয়া হচ্ছে ভিন্নধর্মী পরিকল্পনা। পাশাপাশি দলকে শক্তিশালী করতে ঢেলে সাজানো হচ্ছে অনেক গুরুত্বপূর্ণ সাংগঠনিক ইউনিট। এর বাইরে সরকারের দিকে নজর রাখছে দলটি। আগামী জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ক্ষমতাসীন দল কী ধরনের পদক্ষেপ নিতে পারে তা নিয়ে চলছে চুলচেরা বিশ্নেষণ।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু বলেন, তাঁরা তাঁদের চলমান আন্দোলন অব্যাহত রেখেছেন। আন্দোলনের কোনো ছন্দপতন ঘটেনি। আন্দোলন কখনও তুঙ্গে উঠবে, আবার কখনও কৌশলগত কারণে নিম্নমুখী হবে- এটাই হলো আন্দোলনের ধরন। এটাই আন্দোলনের নিয়ম। তাঁরা ধারাবাহিকভাবে রাজপথের কর্মসূচিতে আছেন। যুগপৎভাবে আন্দোলনের মধ্য দিয়ে তাঁরা এই সরকারের পদত্যাগ নিশ্চিত করতে চান।

গত জুলাই থেকে বিভিন্ন জনইস্যুতে রাজপথে আন্দোলন করছে বিএনপি। জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি ও দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির প্রতিবাদে জেলা পর্যায়ের আন্দোলন শুরু করে দলটি।

দেশের বিভিন্ন জেলায় এ কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে পুলিশের গুলিতে নেতাকর্মী নিহতের ঘটনায় আন্দোলনে গতিবেগ বৃদ্ধি পায়। দ্বিতীয় ধাপের কর্মসূচিতে ঢাকা মহানগরে ১৬টি সমাবেশ ও মোমবাতি প্রজ্বালন কর্মসূচি শেষ করে গত ১২ অক্টোবর থেকে চাল, ডাল, জ্বালানি তেল, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধি ও বিভিন্ন জেলায় নেতাকর্মীকে হত্যার প্রতিবাদ, খালেদা জিয়ার মুক্তি এবং নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলার প্রতিবাদে বিভাগীয় গণসমাবেশ করে বিএনপি। হামলা-মামলা, পরিবহন ধর্মঘট, পথে পথে বাধাবিপত্তি পেরিয়ে এসব সমাবেশ শান্তিপূর্ণভাবে শেষ করতে সক্ষম হয় বিএনপি।

রাজনৈতিক বিশ্নেষকরা বলছেন, গত ১০ ডিসেম্বর ঢাকার গণসমাবেশ নিয়ে ক্ষমতাসীন দল ও বিএনপির মধ্যে মনস্তাত্ত্বিক খেলায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয় দলটিকে। নয়াপল্টন থেকে গণসমাবেশ সরিয়ে নিয়ে বিএনপি সে খেলায় অনেকটা পিছুটান দেয়। গোলাপবাগে বড় সমাবেশ হলেও এটা বিএনপির নেতাকর্মীর মধ্যে অনেকটা হতাশার জন্ম দেয়। তাঁদের মধ্যে ধারণা জন্মেছে, সরকার যেভাবে চেয়েছে, বিএনপি সেভাবেই সমাবেশ করেছে।

বিশিষ্ট রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক দিলারা চৌধুরী বলেন, ১০ ডিসেম্বর বিএনপির গণসমাবেশকে কেন্দ্র বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাসসহ দলের অনেক নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাঁরা এক মাস কারাগারে ছিলেন। বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া অন্তরীণ, তারেক রহমান দেশের বাইরে। তাই তাঁদের অবর্তমানে একটু তো হোঁচট খাবেই। তবে এটা সত্য, এবারের গণতন্ত্রের মুক্তির আন্দোলন শুধু বিএনপির মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, এটা জনগণের আন্দোলনে রূপ নিয়েছে। সেখানে কোনো ছন্দপতন ঘটেনি।

বিএনপি নেতারাও জানান, সারাদেশে মামলা-হামলা আর গ্রেপ্তারের মধ্যেও গত বছরের মধ্যভাগ থেকে রাজনীতির মাঠে ঢেউ তুলতে সক্ষম হয়েছিলেন তাঁরা। বিভাগীয় সমাবেশগুলোতে গণউপস্থিতি তাঁদের ধারণাকে অনেকটা ভুল প্রমাণ করেছিল। সাধারণ মানুষের উপস্থিতি ছিল লক্ষণীয়। ঢাকার গণসমাবেশের আগ পর্যন্ত তাঁরা অনেকটাই সুবিধাজনক অবস্থায় ছিলেন। ওই সমাবেশের ভেন্যু নিয়ে সরকার ও বিএনপির মধ্যকার সৃষ্ট জটিলতা এবং গত ৭ ডিসেম্বর নয়াপল্টনে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষের ঘটনায় কৌশলগত ব্যাকফুটে যায় দলটি। ওই ঘটনায় বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ পাঁচ শতাধিক নেতাকর্মীকে আটক করে পুলিশ।

তবে তাঁরা জানান, বিএনপি নীতিগতভাবে শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি পালনে বদ্ধপরিকর। যার কারণে সরকারের উস্কানিতে পা না দিয়ে সমাবেশ সফল করতেই বেশি মনোযোগ ছিল তাঁদের। কিন্তু এ ঘটনার পর থেকে বিএনপির চলমান আন্দোলনে অনেকটা ধীর গতি পায়। এসব নিয়ে দলের নীতিনির্ধারক নেতারা নিজেদের বৈঠকে চুলচেরা বিশ্নেষণ করেন বলে জানা গেছে।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির একজন সদস্য জানান, বিভিন্ন জনইস্যুতে তাঁরা নিয়মিত রাজপথে থাকবেন। এর মাধ্যমে নেতাকর্মীকে চাঙ্গা রাখতে চান, অন্যদিকে জনসম্পৃক্ততাও বাড়াতে চান। সর্বশেষে সমমনা সব রাজনৈতিক দলগুলোকে নিয়ে সরকার পতনের চূড়ান্ত আন্দোলনে যাবেন তাঁরা। তাঁর মতে, একদিকে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, অন্যদিকে গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বাড়িয়ে সরকার জনগণের রোষানলে রয়েছে। এটা আগামীতে আরও বাড়বে। আর এসব ইস্যুতে রাজপথের আন্দোলনে সাধারণ মানুষের সমর্থন আদায় পুরোটা সম্ভব হবে। ইতোমধ্যে এর ফলাফল তাঁরা পেতে শুরু করেছেন। যে কোনো কর্মসূচিতে দলীয় নেতাকর্মী ছাড়াও সাধারণ জনতার অংশগ্রহণ ক্রমান্বয়ে বাড়ছে।

প্রাধান্য জনইস্যু: বিএনপি নেতারা জানান, সরকারবিরোধী আন্দোলনে সাধারণ মানুষকে সম্পৃক্ত করতে এরই মধ্যে জনইস্যুক প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে। তেল, গ্যাস, বিদ্যুৎসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধির ইস্যুতে শুরু থেকে আন্দোলন করছেন তাঁরা। এ ছাড়া সরকারের পদত্যাগসহ ১০ দফা দাবি ও রাষ্ট্র সংস্কারে ২৭ দফা রূপরেখাকে মানুষের দোরগোড়ায় নিয়ে যেতে এরই মধ্যে সারাদেশে কার্যক্রম শুরু করা হয়েছে। বিভিন্ন সভা-সেমিনারে, আলোচনায় তাদের দাবির সপক্ষে যুক্তি তুলে ধরা হচ্ছে, নেওয়া হচ্ছে পরামর্শ।

শক্তিশালী সংগঠন: রাজপথে কর্মসূচি পালনের পাশাপাশি দলের বিভিন্ন সংগঠনকে ঢেলে সাজানোর উদ্যোগ নিয়েছে বিএনপি। এর মধ্যে খুব দ্রুত সময়ের মধ্যে ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির থানা কমিটি ঘোষণা হতে পারে। ঢাকা মহানগর দক্ষিণের থানা কমিটি গঠনেও চলছে তোড়জোড়। রাজপথের আন্দোলন জোরদার করতে ছাত্রদলের কমিটিকে আরও বর্ধিত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

সুযোগসন্ধানী নেতা: আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে সরকার কী কী পরিকল্পনা নিতে পারে তা নিয়েও দলের মধ্যে আলোচনা চলছে। এর মধ্যে ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ আসনের উপনির্বাচনে বিএনপি থেকে বহিস্কৃত উকিল আবদুস সাত্তারের ঘটনাকে সামনে আনা হয়। বিএনপি নেতারা মনে করছেন, আগামী নির্বাচনের আগে এ ধরনের আরও তৎপরতা চালাতে পারে ক্ষমতাসীন দল। বিভিন্ন প্রলোভনের টোপ, ব্যবসা-বাণিজ্য ঠিক রাখার বাসনা কিংবা জোরপূর্বক আরও অনেক নেতাকে নির্বাচনে নিয়ে আসা কিংবা দলের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ার চেষ্টা হতে পারে। দলের সঙ্গে বেইমানিও করতে পারেন অনেকে।

যুগপৎ আন্দোলন: ঢাকা বিভাগীয় গণসমাবেশ থেকে যুগপৎ আন্দোলনের নতুন ধারা শুরু করে দলটি। তবে তাতে মাঠ পর্যায়ে তেমন সাড়া ফেলতে পারেনি বলে মনে করছেন দলটির নেতাকর্মীরা। এ অবস্থায় আন্দোলনের ধারা অব্যাহত রাখতে এবং নেতাকর্মীকে চাঙ্গা রাখতে নতুন নতুন কর্মসূচির কথা চিন্তা করছেন দলের হাইকমান্ড। সর্বশেষ দলের স্থায়ী কমিটির বৈঠকে পুরো আন্দোলনের রূপরেখা নিয়ে আলোচনা করা হয়।

সূত্র: সমকাল
আইএ/ ২২ জানুয়ারি ২০২৩

Back to top button