ব্যবসা

নেপাল থেকে বাংলাবান্ধা সীমান্ত দিয়ে সূতা আসবে বাংলাদেশে

ঢাকা, ১৫ জানুয়ারি – বাংলাবান্ধা স্থল বন্দর দিয়ে নেপাল থেকে সরাসরি সূতা আমদানির ছাড়পত্র দিয়েছে ঢাকা। ঢাকায় অবস্থিত নেপালি দূতাবাস একটি টুইট করে এই খবর নিশ্চিত করেছে।

টুইটে লেখা হয়েছে, “নেপালের সূতা রপ্তানিকারকদের জন্য বাংলাবান্ধা স্থল বন্দর খুলে দেওয়া হয়েছে। এই বন্দর দিয়ে সূতা রপ্তানির ওপরে প্রায় দুই দশক ধরে যে নিষেধাজ্ঞা ছিল, তা তুলে নেওয়া হল।”

নেপালের বিদেশমন্ত্রক এক বিবৃতি দিয়ে জানিয়েছে তারা বিশ্বাস করে যে নেপাল আর বাংলাদেশের মধ্যে বাণিজ্য ক্ষেত্রে এই সিদ্ধান্ত একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

বাংলাবান্ধা সীমান্ত দিয়ে নেপালি সূতা আমদানি করার ওপরে ২০০২ সালে বাংলাদেশ নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল। দেশীয় সূতা উৎপাদকদের সুরক্ষা দিতেই ওই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল।

এতদিন পর্যন্ত নেপালি সূতা শুধুমাত্র বেনাপোল স্থলবন্দর আর চট্টগ্রাম বন্দর দিয়েই বাংলাদেশে ঢোকার অনুমতি ছিল। নেপালের উৎপাদকরা চট্টগ্রাম বন্দর দিয়েই মূলত বাংলাদেশে সূতা রপ্তানি করতেন, যার ফলে তাদের খরচও বেড়ে যেত।

‘গার্মেন্টস খাত লাভবান হবে এই সিদ্ধান্তে’
স্থল পরিবেষ্টিত নেপাল থেকে বাংলাদেশে রপ্তানি করার জন্য বাংলাবান্ধাই সব থেকে কাছের স্থল বন্দর। নেপাল বেশ কয়েকবছর ধরেই বাংলাদেশের কাছে অনুরোধ জানিয়ে আসছিল, যাতে বাংলাবান্ধা বন্দর দিয়ে সূতা রপ্তানির ওপরে জারি থাকা নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হয়।

পলিয়েস্টার সূতা উৎপাদন নেপালে একটা বড় শিল্প। নেপালি জাতীয় ব্যাঙ্কের তথ্য অনুযায়ী চলতি আর্থিক বছরের প্রথম চার মাসে তিনশো কোটিরও নেপালি টাকা মূল্যের সূতা রপ্তানি হয়েছে।

জাতীয় ব্যাঙ্কের তথ্যে আরও পাওয়া গেছে ২০২১-২২ আর্থিক বছরে নেপাল থেকে সাড়ে নয়শো কোটি নেপালি টাকা মূল্যের সূতা রপ্তানি হয়েছিল।

ঢাকার সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের গবেষণা-নির্দেশক এবং সিনিয়র বাণিজ্য বিশ্লেষক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেমের মতে বাংলাদেশের রেডিমেড গার্মেন্ট সেক্টরের ব্যবসা বেড়েই চলেছে, তাই সরকারের এই সিদ্ধান্তের ফলে কাঁচামালের যোগান বাড়াতে সাহায্যই করবে।

বিবিসির সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে ড. মোয়াজ্জেম জানাচ্ছিলেন, “এতদিন বাংলাদেশের গার্মেন্টস শিল্প কাঁচামালের জন্য চীনের ওপরেই মূলত নির্ভর করত। কিন্তু এখন নেপাল থেকেও তারা কাঁচামাল আমদানি করতে পারবে।”

ভারতও অনুমোদন দিয়েছে তার স্থল বন্দর ব্যবহার করার
অন্যদিকে নেপালের গার্মেন্টস এসোসিয়েশনের সভাপতি পশুপতি দেব পাণ্ডে বলছেন বাংলাদেশ যদিও বেনাপোল স্থল বন্দর দিয়ে সেদেশে সূতা আমদানির অনুমতি দিয়ে রেখেছিল, কিন্তু বেনাপোলের বিপরীতে ভারতীয় স্থল বন্দর পেট্রাপোল স্থল বন্দর দিয়ে বাংলাদেশে সূতা পাঠানোর জন্য ভারত অনুমতি দেয়নি।

এখন বাংলাদেশ যেমন বাংলাবান্ধা স্থল বন্দর ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছে, তেমনই ভারতও তাদের অংশের ফুলবাড়ি স্থল বন্দর দিয়ে নেপালি সূতা বাংলাদেশে পাঠানোর অনুমোদন দিয়েছে।

বাংলাদেশ সরকারের নতুন সিদ্ধান্তে নেপাল, ভারত আর বাংলাদেশ – তিনটি দেশই লাভবান হবে।

নেপালের টেক্সটাইল এসোসিয়েশনের সভাপতি শৈলেন্দ্র লাল প্রধান বলছিলেন, তাদের দেশে যত সূতা তৈরি হয়, তার জন্য বাজার দরকার, আর বাংলাদেশ সরকারের এই সিদ্ধান্তে ফলে নেপালের সূতা উৎপাদকরা যথেষ্ট লাভবান হবেন।

তার বিশ্বাস ভারতও এর সূতা রপ্তানিতে সহযোগিতা করবে।

নেপাল-বাংলাদেশের মধ্যে কত পরিমাণ বাণিজ্য হয়?
বাংলাদেশকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়া সপ্তম দেশ ছিল নেপাল। পাকিস্তানের সঙ্গে তাদের যথেষ্ট ভাল সম্পর্ক থাকা সত্ত্বেও তারা বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছিল। সেই ঘটনার পরে বেশ কিছুদিন পাকিস্তান আর নেপালের সঙ্গে সব কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করে দিয়েছিল।

নেপাল আর বাংলাদেশ প্রথমবার ১৯৭৬ সালে বাণিজ্য, ট্রানজিট, অসামরিক বিমান পরিবহনসহ বেশ কয়েকটি বিষয়ে চুক্তি করে। ১৯৭৮ সালে দুটি দেশের অর্থমন্ত্রীদের মধ্যে নেপাল-বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সহযোগিতার চুক্তি হয়। ১৯৯৭ সালে কাকরভিটা-ফুলবাড়ি-বাংলাবান্ধা ট্রানজিট রুট চালু হয় আর একই সঙ্গে নেপালকে মংলা বন্দর ব্যবহারের অনুমতি দেয় বাংলাদেশ।

কিন্তু ভারত -নেপাল আর ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে নেপালি রপ্তানিকারকদের বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছিল বলে বাংলাবান্ধা স্থল বন্দর খুব একটা ব্যবহার করতে পারতেন না তারা।

ইনস্টিটিউট অফ সাউথ এশিয়ান স্টাডিজের একটা প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০১৯ সালে নেপাল থেকে বাংলাদেশে এক কোটি ২০ লক্ষ ডলার মূল্যের পণ্য রপ্তানি হয়েছিল, যেখানে বাংলাদেশ থেকে নেপালে রপ্তানি হয়েছিল চার কোটি ৮৬ লাখ ডলারের পণ্য।

খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেমের কথায়, দুটি দেশের মধ্যে সুসম্পর্ক থাকা সত্ত্বেও বৈদেশিক বাণিজ্যের পরিমাণ খুবই কম। তিনি এও বলছেন যে নেপালের মানুষের ক্রয়ক্ষমতা খুবই কম আবার বাংলাদেশের প্রয়োজনীয় কাঁচামাল নেপালের কাছে অনেক পরিমাণে উৎপাদিত হয়।

বাংলাদেশ-নেপাল বাণিজ্যে ভারতের ভূমিকা
দুই শক্তিশালী প্রতিবেশী দেশ – ভারত আর চীন দিয়ে ঘেরা নেপাল।

আবার নেপাল আর বাংলাদেশের মধ্যে দূরত্ব মাত্র ২২ কিলোমিটার। দক্ষিণ নেপাল আর বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলকে জুড়েছে পশ্চিমবঙ্গের শিলিগুড়ি করিডোর। এই করিডোরটিকে চিকেন্স নেক বলা হয়।

কিন্তু নেপাল থেকে বাংলাদেশ পৌঁছনর জন্য ভারতের সহায়তা প্রয়োজন হয় নেপালের। তাই নেপাল বাংলাদেশের দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ভারতের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।

পশুপতি দেব পাণ্ডে বলছিলেন নেপাল তার প্রয়োজনীয় পণ্যের ৮০ %ই ভারত থেকে আমদানি করে, আবার নিজেদের ৮০% পণ্য ভারতেই রপ্তানি করা হয়।

আবার নেপাল এবং বাংলাদেশের মধ্যে বিদ্যুৎ ক্ষেত্রে সহযোগিতা নিয়ে আলোচনা চলছে। নেপালে জলবিদ্যুৎ আর বাংলাদেশের গ্যাস দুটি দেশের মধ্যে সহযোগিতায় বড় ভূমিকা রাখতে পারে।

নেপালে বর্তমানে ১২৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়, এবং তা বাড়িয়ে পাঁচ হাজার মেগাওয়াট করার পরিকল্পনা নিয়েছে তারা।

অতিরিক্ত বিদ্যুৎ বাংলাদেশকে তারা বিক্রি করতেই পারে, কিন্তু সেক্ষেত্রে ভারতের মধ্যেকার ট্রান্সমিশন গ্রিড ব্যবহার করতে হবে।

কাঠমান্ডুর এশিয়ান ইনস্টিটিউট অফ ডিপ্লোম্যাসি এন্ড ইন্টারন্যাশনাল এফেয়ার্সের চিফ এক্সিকিউটিভ সুনীল কে সির কথায়, নেপাল আর বাংলাদেশে ভারতের এনটিপিসিকে অনুরোধ করেছিল যে ৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ যাতে নেপাল থেকে বাংলাদেশে পাঠানো যায় তাদের গ্রিড ব্যবহার করে। কিন্তু চারমাস হয়ে গেছে ভারত সেই অনুমতি দেয়নি।

গুলাম মোয়াজ্জেম বলছিলেন, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর আশিয়ান বা ইউরোপিয়ান ইউনিয়নকে দেখে শেখা উচিত।

“আশিয়ান দেশগুলো নিজেদের মধ্যেই প্রায় ৩৮ শতাংশ বাণিজ্য চালায় আর ইইউ দেশগুলোর যা বৈদেশিক বাণিজ্য, তার ৬৮ শতাংশ সদস্য দেশগুলোর মধ্যেই চলে। আর দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মোট বৈদেশিক বাণিজ্যের মাত্র ৫ শতাংশ নিজেদের মধ্যে করে,” বলছিলেন মি. মোয়াজ্জেম।

তিনি আরও বলছিলেন যে ভারত যদি এগিয়ে এসে এই অঞ্চলের নেতৃত্ব দেয় বাণিজ্যের ক্ষেত্রে আর অন্য দেশগুলোও ভারতের সঙ্গে সহযোগিতা কর, তাহলে পুরো দক্ষিণ এশিয়ারই বাণিজ্য বৃদ্ধি পাবে, যাতে লাভবান হবে সব দেশই।

সূত্র: বিবিসি নিউজ বাংলা
আইএ/ ১৫ জানুয়ারি ২০২৩

Back to top button