ব্যবসা

অস্থিরতা কাটছে না চিনির বাজারে

আবু আলী ও রেজাউল রেজা

ঢাকা, ৬ জানুয়ারি – চিনির বাজারে অস্থিরতা কাটছে না। সরকারের বেঁধে দেওয়া মূল্যের চেয়ে এখনো ১০ থেকে ১৫ টাকা বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যটি। আবার পাড়া-মহল্লার অনেক দোকানে চিনি পাওয়া যাচ্ছে না। সরকারের বেঁধে দেওয়া দাম অনুযায়ী প্রতিকেজি খোলা চিনি ৯০ টাকা এবং প্যাকেট চিনি ৯৫ টাকায় বিক্রি হওয়ার কথা। অথচ রাজধানীর বাজারে খোলা চিনির কেজি ১১৫ টাকার নিচে কেনা যাচ্ছে না। কোথাও কোথাও এর বেশি দামেও বিক্রি হচ্ছে। অপরদিকে এক কেজির প্যাকেটজাত চিনির মোড়কের গায়েই দাম লেখা ১০৭ টাকা। তবে বেশি দামের এই প্যাকেট চিনিও উধাও। চিনির এই বাড়তি দামের জন্য খুচরা বিক্রেতারা পাইকারি ব্যবসায়ীদের দায়ী করেছেন। তবে পাইকারি বিক্রেতাদের ভাষ্য, বড় কোম্পানিগুলো নানা অজুহাতে সরবরাহ কমিয়ে দেওয়ার পাশাপাশি চড়া দাম ধরে রেখেছে।

পাইকারি পর্যায়ে ভোগ্যপণ্য বিক্রেতাদের সংগঠন মৌলভীবাজার ব্যবসায়ী সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক গোলাম মাওলা বলেন, গ্যাস সংকটের অজুহাত দিয়ে কোম্পানিগুলো চিনি কম সরবরাহ করছে। চাহিদা অনুযায়ী চিনি পাচ্ছি না আমরা। আমাদের রসিদ দেওয়া হলেও তাতে এক দাম থাকে, আর কিনতে হয় আরেক দামে। ফলে বিশ্ববাজারে দাম কমতির দিকে থাকলেও আমরা পাইকারি ব্যবসায়ীরা কমে চিনি কিনতে পারছি না। এখন প্রতি কেজিতে আমাদের ৫ থেকে ৭ টাকা পর্যন্ত বাড়তি দামে চিনি কিনতে হচ্ছে। প্রতি মণে ২০০ থেকে ২৮০ টাকা পর্যন্ত দাম বাড়তি। তাই খুচরা বাজারেও কমে চিনি বিক্রি করা যাচ্ছে না।

কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, ‘মূল্যস্ফীতির চেয়ে লোভের স্ফীতি আমাদের বড় সমস্যা। একশ্রেণির ব্যবসায়ীর লোভ এত বেড়েছে যে, তাদের নৈতিকতা বিলুপ্ত হয়েছে। তারা নানা অজুহাতে পণ্যের দাম বাড়িয়ে দিচ্ছে। সরকার আন্তর্জাতিক ও দেশীয় বাজার যাচাই করে দাম বেঁধে দিচ্ছে, শুল্ক সুবিধা দিচ্ছে। তারপরও ব্যবসায়ীরা বাড়তি দামেই পণ্য বিক্রি করছেন। ব্যবসায়ীদের লোভ সংবরণ করতে হবে আগে। এ ছাড়া বাজারে সমান প্রতিযোগিতার ক্ষেত্র তৈরি করতে হবে। আমাদের এখানে হাতেগোনা কয়েকটি বড় প্রতিষ্ঠান তেল, চিনির মতো প্রয়োজনীয় পণ্য আমদানি ও পরিশোধন করে বাজারে সরবরাহ করছে। এতে বাজার তাদের নিয়ন্ত্রণে চলে যাচ্ছে। বাজারে সমান প্রতিযোগিতা নিশ্চিত করতে পারলে কেউ চাইলেই অতিরিক্ত দাম বাড়াতে পারবে না।’

জানা গেছে, আগামী রমজান মাস সামনে রেখে বিপুল পরিমাণ চিনি আমদানির প্রস্তুতি নিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। এ ছাড়া লাখ লাখ টন চিনির মজুদ রয়েছে ভোগ্যপণ্যের কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে। মজুদকৃত এসব চিনি ইতোপূর্বে কম দামে আমদানি করা হয়েছে।

চিনির বাজার স্থিতিশীল রাখতে উদ্যোগ নিয়েছে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরও। এরই মধ্যে তারা সরকারের কাছে ১১ দফা সুপারিশ করেছে। সুপারিশমালার মধ্যে রয়েছে- মিলগুলোকে তাদের সর্বোচ্চ উৎপাদন এবং সরবরাহ অব্যাহত রাখার নির্দেশনা প্রদান। মিল থেকে খুচরা পর্যায় পর্যন্ত কোথাও অসাধু উদ্দেশ্যে চিনি মজুদ করে বাজার অস্থিতিশীল করছে কিনা গোয়েন্দা সংস্থা কর্তৃক তা নজরদারি করা। চিনির বাজার স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত মোবাইল কোর্ট/বাজার অভিযান অব্যাহত থাকতে হবে। দাম পর্যালোচনার জন্য মূল্য নির্ধারণ সংক্রান্ত জাতীয় কমিটির নিয়মিত সভা করে নিতে হবে সিদ্ধান্ত। চিনি উৎপাদনকারী মিলগুলোতে নির্ধারিত চাপের গ্যাস সরবরাহ নিশ্চিতের বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। মিল মালিক থেকে খুচরা পর্যায়ে ক্রয়-বিক্রয়ের ক্ষেত্রে পাকা রসিদ প্রদানে নিতে হবে ব্যবস্থা। এলসি খোলার ক্ষেত্রে বিদ্যমান জটিলতা দূর করতে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক কর্তৃক ব্যবসায়ীদের সহযোগিতা প্রদানের নির্দেশনা এবং মিলগেট থেকে চিনি পরিবহনে যানবাহনের অপেক্ষমাণ সময় কমিয়ে আনতে হবে। এলাকাভিত্তিক ডিলার নির্ধারণ করে তাদের মাধ্যমে স্থানীয় বাজারগুলোতে নিশ্চিত করতে হবে চিনি সরবরাহ। মিলগুলো কর্তৃক অত্যাবশ্যকীয় পণ্য বিপণন ও পরিবেশক নিয়োগ আদেশ ২০১১-এর ‘ফরম ঘ’ অনুযায়ী, সাপ্লাই অর্ডারে চিনির একক মূল্য উল্লেখ করতে হবে। ঢাকাসহ বড় বড় বাজারে পাইকারি ব্যবসায়ীদের চাহিদা মতো ব্যবস্থা নিতে হবে মিল থেকে সরাসরি চিনি সরবরাহের।

চিনির বাজার নিয়ে নড়েচড়ে বসেছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। রমজান মাসকে সামনে রেখে আমদানি শুল্ক কমাতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) চিঠি দেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি। মন্ত্রী জানিয়েছেন, দেশে চিনির দাম অন্যান্য দেশের তুলনায় একটু

বেশি। এ বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। মন্ত্রণালয় এনবিআরকে চিঠি পাঠাবে যাতে চিনি আমদানিতে যে শুল্ক আছে, রমজান মাসকে সামনে রেখে তা যেন পুনরায় বিবেচনা করা হয়।

এর বাইরে বাংলাদেশ ব্যাংক সম্প্রতি তেল, চিনি, ছোলা, খেজুরসহ সাত ভোগ্যপণ্য আমদানিতে এলসি মার্জিন বা নগদ জমা ন্যূনতম পর্যায়ে রাখা এবং এসব পণ্য ৯০ দিনের বাকিতে আমদানির সুযোগ দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের অপর এক প্রজ্ঞাপনে এলসি মার্জিনে ছাড় দেওয়ার তালিকায় যুক্ত হয়েছে চাল ও গম। তবে ব্যবসায়ী ও ব্যাংকাররা মনে করছেন, ভোগ্যপণ্য আমদানি এবং সরবরাহকারী বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠানের জন্য শূন্য বা কম মার্জিনে এলসি খোলার সুবিধা আগে থেকেই আছে। তাই শুধু মার্জিনে ছাড় দিলে কাজ হবে না, আমদানিকারকরা যাতে পর্যাপ্ত ডলারের সংস্থান পান এবং এলসি খুলতে কোনো সমস্যায় না পড়েন তার জন্য যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে।

সূত্র: আমাদের সময়
আইএ/ ৬ জানুয়ারি ২০২৩

Back to top button