পরিবেশ

দখল কম, দূষণই বড় সমস্যা শ্যামপুর খালের

রাশেদুল হাসান

রাজধানীর শ্যামপুর খাল। শ্যামপুর ওয়াসা রোড হতে শ্যামপুর ব্রিজ। বড়ইতলা থেকে আল আমিন মসজিদ মোড় জিয়া সরণী পর্যন্ত প্রায় ২ দশমিক ৩০ কিলোমিটারের বেশি এ খালটি দূষণে মৃতপ্রায়। ময়লা ভর্তি হয়ে শক্তি পলি জমে খালটিতে পানি প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হয়েছে বিভিন্ন জায়গায়। এতে বর্ষাকালে জলাবদ্ধতার ভোগান্তিতে পড়েন স্থানীয়রা।

এলাকাবাসীর অভিযোগ, খালটি এখন মশার আঁতুড়ঘরে পরিণত হয়েছে। মশার কামড় আর ময়লার উৎকট গন্ধে খালের দুই পাড়ের বাসিন্দাদের প্রাণ ওষ্ঠাগত। সমস্যা নিরসনে সিটি করপোরেশনের উদ্যোগ যথাযথ নয় বলেও দাবি তাদের।

আর সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বাসা-বাড়ি, দোকানপাট ও কারখানা থেকে নির্বিচারে পয়োবর্জ্য ও গৃহস্থালির বর্জ্য ফেলার কারণে খাল পরিষ্কার করেও সুফল মিলছে না। ফলে নেওয়া হচ্ছে বড় উন্নয়ন কাজ।

সোমবার খালটি সরেজমিনে পরিদর্শনে দেখা যায়। শ্যামপুর খালের বড়ইতলা থেকে জিয়া সরণি পর্যন্ত খালটির সীমানা নির্ধারণ করে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের নাম লেখা খুঁটি স্থাপন করা হয়েছে।

খালটির দুই কিলোমিটার অংশে কোথাও ৬০ ফুট প্রশস্ত আর কোথাও ২৫-৩০ ফুট। পুরো অংশে কোনও স্থায়ী অবৈধ স্থাপনা না থাকলেও আছে অস্থায়ী স্থাপনা। খালের দুই পাশের বাসাবাড়ি থেকে রান্নাঘর ও পয়োবর্জ্য পাইপের সাহায্যে ফেলা হচ্ছে খালে। তাতেই পানির রং কুচকুচে কাল আর দুর্গন্ধ ছড়ায় সারাদিন।

বড়ইতলা থেকে বড় মসজিদ বটতলা খালটি ক্রমাগত সরু হয়ে নালায় রূপ নিয়েছে। বটতলা থেকে আল আমিন মসজিদ ও জিয়া সরণী পর্যন্ত এ খালটি ৪০-৫০ থেকে ৫০ ফুট রয়েছে। এ অংশে খালে কিছু অস্থায়ী দখল ও দেখা যায়।

বড়ইতলা এলাকায় খালের পাড় দিয়ে হাঁটতেই খালে দেখা যায় আইসক্রিম ও চায়ের কাপ, লেপ- তোষক- বালিশ, পরিত্যক্ত টিভি -ফ্রিজ পলিথিন, বিস্কুটের খোসা, তরকারির খোসা এমনকি ওষুধের শিশি ও বাক্স।

মেডিক্যাল বর্জ্যের বিষয়ে কথা হয় খালের পাড়ের তাওয়াক্কুল মেডিসিন অ্যান্ড হেলথ কেয়ারের মালিক নাজমুস ছাআদাত এর সঙ্গে। ফার্মেসির ময়লা কেন খালে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি আমার দোকানের সুচ-সিরিঞ্জসহ চিকিৎসা বর্জ্য আলাদা করে ভ্যান সার্ভিসে দিয়ে দেই। কিন্তু কয়েকদিন আগে দোকান পরিষ্কার করতে গিয়ে অনেক ময়লা ছিল, তাই কিছু ওখানে ফেলেছি।

বড়ইতলা থেকে পূর্ব দিকের বাড়তেই খালের দুই পাশে পড়ে দুই পাড়ের এক, দুই, তিন ও চারতলা বাড়িগুলো। খাল ভর্তি ময়লা দেখেই বোঝা যায় বাড়িগুলো থেকেই ফেলা হয়েছে এসব।

কিছুদূর এগিয়ে চোখে পড়ে খালের মধ্যে টেইলার্সের কাটা কাপড় খালের মধ্যে। বিউটি টেইলার্সের মালিক ময়না বেগম বলেন, বাচ্চারা কিছু কাপড়ের টুকরা খেলতে নিয়ে হয়তো খালে ফেলে দিয়েছে।

তিনি বলেন, আমার দোকান হতে হয়তো বাচ্চারা একটু ফেলতে পারে। কিন্তু এই যে তিন তলা চারতলা বাড়িগুলো থেকে প্রতিদিন ময়লা ফেলে। চারতলা থেকে নিচে নেমে গিয়ে কেউ ড্রামে ময়লা ফেলতে চায় না। ধরে সোজা খালে ফেলে। তাছাড়া ময়লার ভ্যান ও প্রতিদিন আসে না।

একই অভিযোগ এ এলাকার আরেক বাসিন্দা মনসুর হেলালের। তিনি বলেন, সিটি করপোরেশনের ময়লার ভ্যান প্রতিদিন আসে না। মানুষ ও অসচেতন সব ময়লা সোজা খালে ফেলে। মানুষ ময়লা সংগ্রহের টাকা ও দেয় আবার খালেও ফেলে। এটা নোংরা দুর্গন্ধ এলাকা। বৃষ্টি হলে শুরু হয় জলাবদ্ধতা । আমি ২০ বছর ধরে এমনই দেখতেছি। আমরা ধরেই নিয়েছি আমরা এরকমই চলবো।

তিনি দাবি করেন, খালটির ময়লা সরিয়ে পুনরায় খনন না করলে দুর্গন্ধ মশার কামড় থেকে রেহাই মিলবে না।

এলাকায় মশা কেমন জিজ্ঞেস করলে মানসুর বলেন, ‘সন্ধ্যার পর মশার কামড়ে টেকা বড় দায়। আমরা প্রতিদিন এখানে লার্ভার ওষুধ দেই এরপর টিকতে পারি নাই। ওষুধ না দিলে যে কী হতো আল্লাহ ভালো জানে ।

খাল পরিষ্কার করা হয় কিনা জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, খাল তো পরিষ্কার করা হয়ই। এ মাথা থেকে পরিষ্কার করে ওই মাথায় যাওয়ার আগেই এ মাথা ময়লায় ভরে যায়। মানুষ তো আর ময়লা ফেলা বন্ধ করে না।

জিয়া সরণী ব্রিজের কাছে দুইজন পরিচ্ছন্ন কর্মীকে খাল থেকে ময়লা উঠিয়ে রাস্তায় জমা করতে দেখা যায়।

সিটি করপোরেশনের ভ্যান খালের দুই পাড়ের বাসা বাড়ি থেকে নিয়মিত ময়লা নেওয়া হয় না কেন জিজ্ঞেস করা হলে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা আবদুল মোতালিব বলেন, বিষয়টি আমাদের কেউ জানায়নি যে ময়লা নিয়মিত সংগ্রহ করা হচ্ছে না। আমি এখনই আমাদের পরিচ্ছন্ন পরিদর্শকদের মাধ্যমে খোঁজ নিচ্ছি।

প্রধান সম্পত্তি কর্মকর্তা রাসেল সাবরিন বলেন, শ্যামপুর খালে দখল নেই। আমরা দখল উচ্ছেদ করে সীমানা নির্দেশক খুঁটি স্থাপন করেছি। উচ্ছেদের সময় সকল রকম জরিপ দেখেই করা হয়েছে।

খাল নিয়ে কী পরিকল্পনা করছে দক্ষিণ সিটি জিজ্ঞেস করা হলে তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী খাইরুল বাকের জানান, ৮৯৮ দশমিক ৭৩ কোটি টাকার একটি প্রকল্প অনুমোদন দিয়েছে সরকার। এ ব্যয়ে চারটি খালের ১৯ দশমিক ৭৮ কিলোমিটার পুনরুদ্ধার বা সংস্কারের জন্য ২০২৬ সালের জুনের মধ্যে খাল পুনরুদ্ধার ও সংস্কার এবং নান্দনিক পরিবেশ সৃষ্টি করবে।

প্রকল্পের আওতায় মান্ডা খালের আট দশমিক ৯ কিলোমিটার (দুই লাখ ১৭ হাজার ৫০০ বর্গমিটার), শ্যামনগর খালের চার দশমিক ৭৮ কিলোমিটার (৫৭ হাজার ৩৬০ বর্গমিটার), জিরানী খালের তিন দশমিক ৯ কিলোমিটার (৭৮ হাজার বর্গমিটার) এবং কালুনগর খালের দুই দশমিক চার কিলোমিটার (২৮ দশমিক ৮০ বর্গমিটার) খাল পুনরুদ্ধার বা সংস্কার করা হবে।

প্রকল্পের প্রধান কার্যক্রমের মধ্যে রয়েছে- খাল পরিষ্কার করা, পলি অপসারণ, ঢাল সুরক্ষা ও নিষ্কাশন কাঠামো নির্মাণ, ল্যান্ডস্কেপ তৈরি করা এবং সংশ্লিষ্ট এলাকা সবুজায়ন ।

তিনি বলেন, আমাদের বিভিন্ন কাজের প্রাক্কলন ও টেন্ডারে যাওয়ার প্রক্রিয়া নিচ্ছি। আমাদের কাজ শুরু করতে দুই মাস সময় লাগবে।

আইএ/ ৩১ ডিসেম্বর ২০২২

Back to top button