বছরজুড়ে ওটিটিতে ছিল বৈচিত্র্যময় দেশীয় কনটেন্ট
ঢাকা, ৩০ ডিসেম্বর – বদলে গিয়েছে বিনোদনের মাধ্যম। স্টেজের নাটকের তুলনায় একসময় জনপ্রিয় হলো সিনেমা। সিনেমা দেখা হতো হলে। এরপর সিনেমা চলে এল টেলিভিশনে। নাটকের ক্ষেত্রেও তাই। কিন্তু গত কয়েক বছরে টেলিভিশনের পাশাপাশি জনপ্রিয় হয়ে উঠল স্ট্রিমিং। সেখানেই এখন মুক্তি পায় সিনেমা, সিরিজ, ডকুমেন্টারি এমনকি মিউজিক ভিডিও। স্ট্রিমিং প্লাটফর্মের দিক থেকে পিছিয়ে নেই বাংলাদেশও। সময়ের সঙ্গে বাংলাদেশের নির্মাতা, প্রযোজক ও তারকারাও এগিয়েছেন। তৈরি হয়েছে প্লাটফর্ম এবং এর সঙ্গে তৈরি হচ্ছে নানা কনটেন্ট। দেশ ও দেশের বাইরেও জনপ্রিয় হচ্ছে বাংলাদেশী ওটিটি ও ওটিটির কনটেন্ট।
শুরুটা এ বছর হয়নি, হয়েছিল আরো আগে। তখনো অবশ্য ওটিটিকে আলাদা একটি বড় জায়গা হিসেবে সিংহভাগ সাধারণ দর্শক চিহ্নিত করেনি। তবে ভারতীয় ওটিটি হইচইয়ে আসা সৈয়দ আহমেদ শাওকীর ‘তাকদীর’ জনপ্রিয় হয় সব শ্রেণীর দর্শকের কাছেই। এর পরই আসে নির্মাতা আশফাক নিপুণের ‘মহানগর’ (২০২১)। সে ধারাবাহিকতায় আসে সাবরিনা, দৌড়, রিফিউজি, কাইজার, কারাগার ও বোধ। হইচইয়ে আসা ছয়টি সিরিজই বলা চলে ওটিটিতে বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় কনটেন্ট। কাইজার, মহানগর এতটাই জনপ্রিয় হয় যে কলকাতার পূজামণ্ডপে রীতিমতো ওসি হারুণ ও কাইজারের ছবি দিয়ে তৈরি হয় তোরণ। এ নিয়ে নির্মাতা আশফাক নিপুণ বলেন, ‘একটা ভালো কাজ হলে সেটা সীমানা পার করে বাইরে যাবেই। আমরা ভালো কাজ করতে পারলে তা সবাই গ্রহণ করবে। একটা সময় আমরা বড় বাজেট নিয়ে কাজ করতে পারিনি। কিন্তু আমাদের সক্ষমতা আছে। এখন নানা প্লাটফর্ম সে সুযোগ দেয়ার কারণে কাজগুলো করে দেখাতে পারছি।’
ওটিটির একটা বড় সুবিধা হচ্ছে বিশ্বের বহু মানুষের কাছে কনটেন্ট পৌঁছে দেয়া। এমনকি ভাষার বাধাও থাকে না। আশফাক নিপুণ আরো বলেন, ‘প্লাটফর্মগুলো তাদের কনটেন্ট অন্যান্য ভাষায় ডাবিং করেও প্রচার করে। আমার কাজগুলো হইচই থেকে হিন্দি, তামিল ভাষায় ডাব করা হয়েছে। সে ভাষাভাষী দর্শকও আমাদের দেশের কনটেন্টের সঙ্গে পরিচিত হতে পারছেন। ফলে কাজের সুযোগ ও পরিধি বাড়ছে।’
ওটিটির কারণে কনটেন্টের ক্ষেত্রে নতুন করে ভাবছেন নির্মাতারা। নতুন নতুন সেসব আইডিয়া দর্শকের কাছে গ্রহণযোগ্যতাও পাচ্ছে। কাইজারকে দেশীয় দর্শকেরা গ্রহণ করেছে নিবিড় করে। বিশেষত নব্বইয়ের দশকে যারা বড় হয়েছেন, তারা কাইজারে দেখানো নানা বিষয় ও রেফারেন্সের সঙ্গে নিজেদের যুক্ত করতে পেরেছেন। তিন গোয়েন্দা, ফেলুদা থেকে শুরু করে ভিডিও গেমকে যেন জীবন্ত করে তুলেছেন তানিম নূর। সিরিজের ইনট্রোতে দেখা যায় আশির দশকের কিছু দৃশ্য। সৈয়দ আহমেদ শাওকী নির্মিত কারাগার সিরিজটি মিস্ট্রি ড্রামার প্রতি নতুন করে আগ্রহী করে তুলেছে দর্শককে। প্রথম পর্বের ট্রেলার মুক্তির পর থেকেই এ সিরিজ নিয়ে দর্শকের তুমুল আগ্রহ দেখা যায়। ক্লিফ হ্যাঙ্গারে রেখে প্রথম পর্ব শেষ করার পর এ বছর ওটিটির দর্শক সম্ভবত কারাগারের মতো অন্য কোনো সিরিজের জন্য অধীর হননি।
সম্ভাবনা তৈরি করেছে এবং প্রশংসিত হয়েছে ইমতিয়াজ সজীব নির্মিত রিফিউজি ও রায়হান খানের দৌড়। হইচইয়ে বাংলাদেশের কনটেন্ট নিজস্ব একটি জায়গা করে নিয়েছে। একে এখন আর কেবল ভারতীয় ওটিটি প্লাটফর্ম বলা যায় না। পাশাপাশি বাংলাদেশের ওটিটিও দারুণ সব কনটেন্ট নিয়ে এসেছে। এক্ষেত্রে বঙ্গ, বায়োস্কোপ, বিঞ্জ, চরকি, টফি সবাই এগিয়ে যাচ্ছে সমান তালে। গত বছরের মতো বঙ্গ এবারো নিয়ে এসেছে ‘সাহিত্য থেকে সিনেমা’র আয়োজন বঙ্গ বেজড অন বুক বা বঙ্গ বব। ঈদুল আজহায় সাহিত্যনির্ভর সাতটি টেলিফিকশন নিয়ে হয়েছিল এ আয়োজন। সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম, ইমদাদুল হক মিলনের মতো সাহিত্যিকদের গল্প থেকে নির্মিত হয়েছে টেলিফিকশন। বাদ পড়েনি তরুণরাও। তাদের প্রতিনিধি ছিলেন ওবায়েদ হক, রাহিতুল ইসলাম। এ সময়ে বায়োস্কোপ এনেছিল ২১টি শর্টফিল্ম নিয়ে ‘বাইশে একুশ’। প্রতিটি কনটেন্ট নিয়েই হয়েছিল আলোচনা। পেয়েছে প্রশংসা।
তুলনামূলক এগিয়ে আছে চরকি। একাধিক সিরিজ, ওয়েব ফিল্ম উপহার দিয়েছে তারা। ৭ নাম্বার ফ্লোর, দুদিনের দুনিয়া, দাগের মতো ওয়েব ফিল্মের পাশাপাশি দিয়েছে অরিজিনাল সিরিজ সিন্ডিকেট। তবে সবচেয়ে জনপ্রিয় হয়েছিল নুহাশ হমায়ূনের অ্যান্থোলজি সিরিজ ‘পেট কাটা ষ’। সিরিজটি বাংলাদেশের দর্শকের কাছে তুমুল জনপ্রিয় হওয়ার পাশাপাশি কলকাতায়ও জনপ্রিয় হয়। সৃজিত মুখার্জি ফেসবুক পোস্টে এ সিরিজের প্রশংসা করেছেন। এমনকি আন্তর্জাতিক প্লাটফর্ম হুলুতে মুক্তি পেয়েছে তার শর্টফিল্ম ‘ফরেনারস অনলি’।
অনেক দিন ধরেই ওটিটিতে নতুন নতুন কনটেন্ট নিয়ে আসার চেষ্টা করছে বিঞ্জ। এ বছর তাদের আনা দুটো কাজ বেশ মনোযোগ পেয়েছে। একটি হলো মুনতাসির ও অন্যটি মায়াশালিক। শিহাব শাহীনের মায়াশালিক মুক্তি পেয়েছে বছরের শেষের দিকে। রোমান্টিক একটি গল্পকে সায়েন্স ফিকশনের সঙ্গে ব্লেন্ড করে চমৎকার একটি ওয়েবফিল্ম উপহার দিয়েছেন এ নির্মাতা। অন্যদিকে মুনতাসির নিয়েও প্রশংসা দেখা গিয়েছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। কেবল সিনেমা-সিরিজই নয়, খেলা দেখতেও ওটিটির দ্বারস্থ হচ্ছে দর্শক। ফুটবল বিশ্বকাপ টফিতে দেখছেন অনেকেই। এছাড়া বিদেশী নানা সিরিজ ডাবিং করে দর্শককে উপহার দেয় প্রতিটি ওটিটি। জনপ্রিয়তার কারণে নতুন নতুন আরো ওটিটি আসছে বাজারে। বছরের শেষেই এসেছে দীপ্ত প্লে।
ওটিটির জনপ্রিয়তার সঙ্গে সঙ্গে এর প্রতি ঝুঁকেছেন নির্মাতারাও। টেলিভিশনের জন্য কনটেন্ট নির্মাণ করতেন যারা, এখন ওটিটির জন্য তারাই কনটেন্ট তৈরি করেন। নতুন নির্মাতাও তৈরি হচ্ছে। ওটিটি এতটা জনপ্রিয় হওয়ার আগেই এর জন্য কনটেন্ট নির্মাণ করেছিলেন অমিতাভ রেজা চৌধুরী। হইচইয়ের জন্য ২০১৯ সালে তিনি নির্মাণ করেছিলেন ঢাকা মেট্রো। এ বছর সেখানেই মুক্তি পেয়েছে তার সিরিজ ‘বোধ’। সব বয়সের ও অভিজ্ঞতার নির্মাতাদের এভাবে ওটিটিতে কাজ করাই প্রমাণ করে বর্তমান সময়টা ওটিটিরই এবং ভবিষ্যতে ওটিটিতে বৈচিত্র্যময় নানা কনটেন্ট নিয়ে ফিরবেন তারা।
আইএ/ ৩০ ডিসেম্বর ২০২২