বডিবিল্ডার শুভর লাথিকাণ্ড যেভাবে দেখছেন ক্রীড়া তারকারা
ঢাকা, ৩০ ডিসেম্বর – জাতীয় বডিবিল্ডিং প্রতিযোগিতায় পুরস্কারে লাথি মেরে এখন ক্রীড়াঙ্গনে আলোচনার কেন্দ্রে জাহিদ হাসান শুভ। ফেডারেশনের বিরুদ্ধে অনেকটা বিদ্রোহই ঘোষণা করেছেন তিনি। অবশ্য শাস্তি হিসেবে এরই মধ্যে তাকে আজীবনের নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে বাংলাদেশ বডিবিল্ডিং ফেডারেশন।
এ ঘটনায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে শুরু করে ক্রীড়াঙ্গনে রয়েছে মিশ্র পতিক্রিয়া। অন্য খেলার ক্রীড়াবিদরা কীভাবে দেখছেন বিষয়টি? দেশ রূপান্তর জানার চেষ্টা করেছে সেটি।
কি ঘটেছিল সেদিন
সবশেষ জাতীয় বডিবিল্ডিং প্রতিযোগিতার পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান ছিল ২৩ ডিসেম্বর। প্রতিযোগিতার একটি ক্যাটাগরিতে দ্বিতীয় হন শুভ। মঞ্চে উঠে পুরস্কারও নেন তিনি। কিন্তু এক পর্যায়ে সেই পুরস্কারে লাথি মেরে বসেন এই প্রতিযোগী।
শুভর অভিযোগ ইভেন্টটি পাতানো ছিল এবং তাকে অন্যায়ভাবে দ্বিতীয় করা হয়েছে। পুরস্কার মঞ্চে তার সঙ্গে একজন কর্মকর্তারা খারাপ ব্যবহার করেছেন বলেও দাবি তার।
ওই ঘটনার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে বেশ তোলপাড় তৈরি হয়। সেখানে দেখা যায়, পুরস্কার নেওয়ার পর কিছু বলতে চাইছেন তিনি। কিন্তু তাকে মঞ্চ থেকে সরে নির্দিষ্ট স্থানে গিয়ে দাঁড়াতে নির্দেশ দিচ্ছেন ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক নজরুল ইসলাম। এ সময় তাকে বেশ রাগান্বিতই লাগছিল।
শুভ পরে একাধিক ভিডিওতে দাবি করেন, ‘যা করেছি ঠিক করেছি। আমি অনিয়ম আর দুর্নীতির বিরুদ্ধে লাথি মেরেছি।’
এখানে উল্লেখ্য, শুভ যে পুরস্কারটিতে লাথি মেরেছিলেন সেটি ছিল একটি ব্লেন্ডার। একটি খেলার জাতীয় প্রতিযোগিতায় সেরাদের পুরস্কার হিসেবে ব্লেন্ডার দেওয়া নিয়েও সমালোচনা রয়েছে।
ফেডারেশন আজীবনের নিষেধাজ্ঞা দিলেও আইনি লড়াইয়ের ঘোষণা দেন শুভ। গত কয়েক দিন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও সংবাদ মাধ্যমে বেশ সরব ছিলেন আগেও চারবার মিস্টার বাংলাদেশ খেতাব জেতা এই বডিবিল্ডার।
ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের অবস্থান
শুভর লাথিকাণ্ড খতিয়ে দেখার ঘোষণা দিয়েছে যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়। মঙ্গলবার সংবাদমাধ্যমকে যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী জাহিদ আহসান রাসেল বিষয়টি জানান। ফেডারেশন বা খেলোয়াড় কোনো পক্ষ থেকে অভিযোগ না পেলেও নিজ তাগিদে তদন্ত কমিটি গঠন করে দেন প্রতিমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘বিষয়টি আমাদের নজরে এসেছে। তাই প্রকৃত ঘটনা কী তা খতিয়ে দেখতে তদন্ত করছি আমরা।’ প্রতিমন্ত্রী এ সময় বলেন, খালি চোখে তার কাছেও এই প্রতিযোগিতার ফলাফল প্রশ্নবিদ্ধ মনে হয়েছে।
ফেডারেশনের সবশেষ ভাবনা
শুভর লাথিকাণ্ডে ক্রীড়ামন্ত্রণালয়ের তদন্তের ঘোষণা দেওয়াকে স্বাগত জানিয়েছে বডিবিল্ডিং ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক নজরুল ইসলাম।
বুধবার রাতে তিনি বলেন, ‘মাননীয় মন্ত্রী যে উদ্যোগ নিয়েছেন, উনার সুনেতৃত্বের জন্য আমরা বডিবিল্ডিং ফেডারেশন ধন্যবাদ জানাই। এই তদন্ত কমিটির মাধ্যমে আমাদের বডিবিল্ডিং ফেডারেশনের ন্যায়পরতা এবং সৎ অবস্থানের বিষয়টি আবারও প্রমাণ হবে বলে আমরা আশা করছি।’
শুভ পাশে অন্য খেলার তারকারা
শুভর লাথি কাণ্ড নিয়ে দেশ রূপান্তরের সঙ্গে কথা বলেছেন এসএ গেমসে স্বর্ণজয়ী সাঁতারু মাহফুজা খাতুন শীলা, স্বর্ণজয়ী ভারোত্তোলক মাবিয়া আক্তার সীমান্ত ও কমনওয়েলথ গেমসে রুপাজয়ী শুটার আব্দুল্লাহ হেল বাকী। তাদের কেউই আসলে শুভর ওইভাবে প্রতিবাদকে সমর্থন জানাচ্ছেন না। তবে অন্যায় করলেও একজন খেলোয়াড়কে এভাবে আজীব নিষিদ্ধ করার পক্ষেও নন তারা কেউ।
শীলা যেমন বলছেন, ‘যদি খেলোয়াড়ের দৃষ্টিকোণ থেকে চিন্তা করি, তাহলে অবশ্যই বলব এমন ব্যবহার করা ছেলেটার ঠিক হয়নি। কিন্তু ভিন্ন মত হলো, সে যদি মঞ্চে কিছু বলতেই চাইতো, তাহলে তাকে বলতে দেওয়া উচিত ছিল। তার সঙ্গে কি ব্যবহার করা হয়েছে সেটা ভিডিওতে আমরা দেখেছি। একজন চারবারের ন্যাশনাল চ্যাম্পিয়নের সাথে এই ব্যবহার কখনোই সমীচীন না। এটা কেউ করতে পারেন না।’
যোগ করেন, ‘কারও সঙ্গে এমন ঘটলে উত্তেজিত হওয়া স্বাভাবিক। আমি সাপোর্ট করছি না। তবে যখন অন্যায় করা হয় তখন আসলে মাথা ঠিক থাকে না। তবে হ্যাঁ, প্রতিবাদের ভাষা অন্যভাবে হতে পারতো।’
শুটার বাকী বলেন, ‘এখানে কীভাবে প্রথম-দ্বিতীয় নির্বাচন করা হয়েছে সেটা তো আমি বুঝি না। কিন্তু আমি যেটা দেখলাম, মঞ্চে একজন কর্মকর্তা তাকে (শুভ) বেশ ঝাড়ি দিচ্ছেন। সেখানে অনেক দর্শক আছেন, সাংবাদিক আছেন। আমি কখনো দেখিনি একজন খেলোয়াড়ের সঙ্গে এতটা বাজে ব্যবহার করা হয়।’
বাকী বলে যান, ‘আগে পেছনের ঘটনা কি হয়েছে জানি না। সেই বিষয়ে যাচ্ছিও না। তবে খেলোয়াড়ের সঙ্গে যে ব্যবহার করা হয়েছে, এটা উচিত হয়নি। আর খেলোয়াড়টি যেটা করেছে সেটা হয়তো রাগের মাথায় করেছে। আমার মনে হয় দুই পক্ষই ভুল করছে। বাইরে থেকে তো বেশি কিছু বলা যায় না। যেটা হয়েছে সেটা আসলে উচিত হয়নি।’
মাবিয়া আক্তার সীমান্ত বলেন, ‘প্রথম কথা হচ্ছে ওর (শুভ) আচরণ অশোভন ছিল। তবে ওর সঙ্গে কর্মকর্তারা যেটা করেছেন, সেটা মানা যায় না। কোনো খেলোয়াড়ের সঙ্গে যদি অবিচার না হয় তাহলে কখনোই কেউ এভাবে রেগে যায় না। বডিবিল্ডিং নিয়ে আমাদের ধারণা নেই ঠিক। কিন্তু এটা তো বুঝি, যার মাসল বেশি সে প্রথম স্থানে আসে। যে ছেলেটা প্রথম হয়েছে তার মাসলের সঙ্গে দ্বিতীয় হওয়ার শুভর মাসল কিন্তু অনেক ভালো। আমি বলছি না, ওকে অন্যায়ভাবে দ্বিতীয় দেওয়া হয়েছে। কিন্তু ওর সঙ্গে মঞ্চে যেটা করা হলো, সেটা ঠিক হয়নি।’
খেলোয়াড়রা অসহায়
শুভর লাথিকাণ্ডের পর প্রেস বিজ্ঞপ্তি দিয়ে তাকে নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার কথা জানায় ফেডারেশন। তবে আজীবন নিষেধাজ্ঞাকে লঘু পাপে গুরু দণ্ডই বললেন শীলা-মাবিয়ার মতো তারকা।
মাবিয়া যেমন বলেই দিলেন তারা খেলোয়াড়রা সব সময় অসহায়, ‘আমি সব সময় বলি আমরা সব খেলোয়াড়রাই অনিরাপদ। এই যে ছেলেটাকে নিষিদ্ধ করা হলো, সে এখন কার কাছে গিয়ে অভিযোগ করবে বা আশ্রয় চাইবে। আমাদের যদি কোনো অ্যাসোসিয়েশন থাকতো তাহলে হয়তো আমরা ফেডারেশনের এই বিষয়গুলো নিয়ে অভিযোগ করতে পারতাম। এখন শুভর তো কোনো যাওয়ার জায়গাই নেই। বডিবিল্ডিংয়ে একজন খেলোয়াড় হতে কিন্তু অনেক খরচ হয়। একজন খেলোয়াড়ের পুরো ক্যারিয়ার নষ্ট করার অধিকার কোনো ফেডারেশন বা কর্মকর্তার নেই। আমি বলব দুই পক্ষেরই বিনয়ী হয়ে সমাধান করা উচিত।’
সাঁতারু শীলার প্রশ্ন, ‘ফেডারেশন চাইল আর তাকে আউট করে দিল বা আজীব নিষিদ্ধ করে দিল। কিন্তু খেলোয়াড়টা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে? তাকে আজীবন নিষিদ্ধ করা মানে একজন প্রতিভাবান খেলোয়াড়কে আমরা হারালাম। একজন খেলোয়াড় তো একদিনে তৈরি হয় না। আমার কাছে মনে হয় উভয় পক্ষ বসে সমঝোতা করা উচিত।’
অ্যাথলেট কমিশন কি ভাবছে?
ক্রীড়াবিদদের ভালো-মন্দ, বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধাগুলো দেখার জন্য ২০১৯ সালে বাংলাদেশ অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশন শুধু মাত্র খেলোয়াড়দের নিয়ে গঠন করে ‘অ্যাথলেট কমিশন’। কমিশনের চেয়ারম্যান জোবেরা রহমান লিনুর কাছে প্রশ্ন ছিল শুভর ঘটনা নিয়ে তার ব্যক্তিগত ভাবনা কী?
লিনু বলেন, ‘এটা খুবই দুঃখ জনক। একজন খেলোয়াড় কখনোই পুরস্কারে লাথি মারতে পারে না। আর কর্মকর্তাদের সঙ্গে তার ঠিক কি হয়েছে আমি জানি না। তবে ওই খেলোয়াড়ের এটা করা উচিত হয়নি।’
লিনু অবশ্য এও বলছেন, ‘যদি কোনো চোরামি করা হয়ে থাকে সেটাও দেখতে হবে। আসলে ঘটনা কতটুকু সত্য সেটা বিচার করতে হবে। এই জিনিসটা খতিয়ে দেখা দরকার।’
এখানে অ্যাথলেট কমিশন কি ভূমিকা রাখতে পারে? জানতে চাইলে লিনু বলেন, ‘এখানে অ্যাথলেট কমিশনের ভূমিকা রাখার কিছু নেই আসলে। আমাদের কমিশনের দায়িত্ব হচ্ছে খেলোয়াড়দের সুযোগ-সুবিধা দেখভাল করা। তারা কোথাও লাঞ্ছিত হচ্ছে কিনা, তারা অ্যাবিউজ হচ্ছে কিনা- এগুলো দেখা। বডিবিল্ডিংয়ে যে ঘটনা ঘটেছে এখানে অ্যাথলেট কমিশনের ভূমিকা তেমন নেই। তবে সে যদি আমাদের কাছে আসে তাহলে আমরা হয়তো চিন্তা করে দেখবে আমাদের কিছু করা যায় কিনা।’
আজীবনের নিষেধাজ্ঞা নিয়ে ফেডারেশনের বক্তব্য
শুভর আজীবনের নিষেধাজ্ঞা সম্পর্কে জানতে চাইলে ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক নজরুল ইসলাম বলেন, ‘দেখুন শুভ প্রত্যেক জাজকে গালি দিয়েছে। বডিবিল্ডিংয়ের কাউকে সে মানছে না। নিজে ফেডারেশন তৈরি করবে, সে যা বলবে সেটাই করতে হবে এমন ভাব তার কথায় ফুটে উঠছে। আর অশ্লীল অঙ্গভঙ্গির ভিডিও আমরা আমাদের পেজে দিতে বাধ্য হয়েছি। এমন অঙ্গভঙ্গির মাধ্যমে সে আমাদের বডিবিল্ডিংয়ে বাজে ইমেজ তৈরি করেছে। এটার কারণে আমরা ওই ধরনের সিদ্ধান্তে গিয়েছি।’
শুভর সঙ্গে তিনি মঞ্চে কোনো বাজে ব্যবহার করেননি বলেও দাবি করেন, ‘একটা পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে কোনো খেলোয়াড় মাইক চাইবে, এই ধরনের কোনো নিয়ম কোথাও নেই। সেই প্রেক্ষিতে আমি তাকে হাতের ইশারায় নির্দেশনা দিলাম, তার স্থানে যাওয়ার জন্য। এখানে তার সঙ্গে আমি কোনো কথাও বলিনি। হাতের ইশায় যেতে বলেছি। সে এখন সেটা অন্যভাবে বলে বেড়াচ্ছে।’
শুভর সবশেষ বক্তব্য কী
লাথিকাণ্ডের পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও সংবাদমাধ্যমে বেশ সরবই ছিলেন শুভ। তবে তার সবশেষ মনোভাব জানতে বুধবার থেকে ফোনে যোগাযোগ করা হলেও সাড়া মেলেনি। বৃহস্পতিবার ফোন রিভিস করলেও দেশ রূপান্তরের সাংবাদিক পরিচয় পেয়ে কেটে দেন তিন। পরে একাধিকবার যোগযোগ করলেও ফোন বন্ধ হওয়া যায়। কখনো ফোন ঢুকলেও রিসিভ করেননি।
সূত্র: দেশ রূপান্তর
আইএ/ ৩০ ডিসেম্বর ২০২২