ব্যবসা

পাকিস্তানের অন্যতম দ্রুতবর্ধনশীল রফতানি বাজার এখন বাংলাদেশ

বদরুল আলম

ঢাকা, ২৩ ডিসেম্বর – বাংলাদেশে পাকিস্তানি পণ্যের আমদানি বাড়ছে। স্টেট ব্যাংক অব পাকিস্তানের (এসবিপি) পরিসংখ্যান অনুযায়ী, পাকিস্তানি পণ্য রফতানির অন্যতম দ্রুতবর্ধনশীল বাজার এখন বাংলাদেশ। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গত অর্থবছরের প্রবৃদ্ধির হার অব্যাহত থাকলে চলমান অর্থবছর শেষে পাকিস্তানের পণ্য রফতানির বিলিয়ন ডলারের বাজারে পরিণত হবে বাংলাদেশ।

উৎপাদনমুখী পণ্যের কাঁচামাল উৎপাদক দেশ হিসেবে পাকিস্তানি তুলা, সুতা ও কাপড়ের চাহিদা রয়েছে বাংলাদেশের খাতসংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের কাছে। বিশ্বে তৈরি পোশাক সরবরাহকারী দ্বিতীয় বৃহত্তম দেশ হিসেবে বাংলাদেশী ব্যবসায়ীরা বিপুল পরিমাণ কাঁচামাল আমদানি করেন পাকিস্তান থেকে। অনেক সময় তৈরি পোশাকের বৈশ্বিক ক্রেতাদের চাহিদাও থাকে পাকিস্তান থেকে কাঁচামাল আমদানির। ফলে স্বাভাবিকভাবেই বাংলাদেশে পাকিস্তানের পণ্য রফতানি বাড়ছে।

পাকিস্তানের বাণিজ্য উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের তথ্য অনুযায়ী, তুলা, সুতা ও কাপড় ছাড়াও বাংলাদেশে চাহিদা রয়েছে পাকিস্তানের এমন পণ্যগুলোর মধ্যে আছে গম, কেমিক্যাল, প্লাস্টিক উপকরণ, ফল, চামড়া, মূলধনি যন্ত্রপাতি, বৈদ্যুতিক পাখা, চাল, মসলা, মাছ, পেট্রোলিয়াম পণ্য, পোশাক ও আসবাব। এছাড়া পাকিস্তানি শিশুখাদ্য, ফলের রস, কাটলেরি ও অস্ত্রোপচার সরঞ্জামেরও বড় বাজার রয়েছে বাংলাদেশে।

পাকিস্তান বাণিজ্য উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের বার্ষিক বাণিজ্য পর্যালোচনা প্রতিবেদনে দেখা গিয়েছে, ২০২০-২১ অর্থবছরে দেশটির শীর্ষ ১০ রফতানি গন্তব্যের মধ্যে ছিল বাংলাদেশ। ওই অর্থবছরে বাংলাদেশে পাকিস্তানের রফতানি প্রবৃদ্ধি ছিল সামান্যই। এসবিপি প্রকাশিত ২০২১-২২ অর্থবছরের বাণিজ্য পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশে পাকিস্তানের রফতানি প্রবৃদ্ধিতে বড় উল্লম্ফন হয়েছে। ২০২০-২১ অর্থবছরে মাত্র ৩ শতাংশ রফতানি প্রবৃদ্ধি হলেও ২০২১-২২ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৪১ দশমিক ২৮ শতাংশ।

পাকিস্তানের সবচেয়ে বড় রফতানি বাজার যুক্তরাষ্ট্র। পাকিস্তান বাণিজ্য উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের তথ্য অনুযায়ী, এর পরই আছে চীন ও যুক্তরাজ্য। শীর্ষ ১০-এর বাকি দেশগুলো হলো সংযুক্ত আরব আমিরাত, জার্মানি, নেদারল্যান্ডস, আফগানিস্তান, স্পেন, ইতালি ও বাংলাদেশ।

দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, গত অর্থবছরে যুক্তরাষ্ট্রে পাকিস্তানের রফতানি প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৩৫ শতাংশ, চীনে ৩৬ ও যুক্তরাজ্যে ৭ শতাংশ। সংযুক্ত আরব আমিরাত, জার্মানি, নেদারল্যান্ডস, স্পেন, ইতালি ও বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি হয়েছে যথাক্রমে ১৩, ১৫, ৩২, ৪৩, ৪০ ও ৪১ শতাংশ।

একই পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২০-২১ অর্থবছরে বাংলাদেশে পণ্য রফতানি বাবদ পাকিস্তানের প্রাপ্ত অর্থের পরিমাণ ছিল ৬১ কোটি ৬২ লাখ ২ হাজার ডলার। ২০২১-২২ অর্থবছরে ৪১ দশমিক ২৮ শতাংশ বেড়ে তার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৮৭ কোটি ৬ লাখ ৪ হাজার ডলার। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রফতানি বাবদ অর্থমূল্যের পরিমাণ ও প্রবৃদ্ধি বিবেচনায় নিয়ে সবকিছু ঠিক থাকলে চলতি অর্থবছর শেষে বাংলাদেশে পাকিস্তানের রফতানি ১ বিলিয়ন বা ১০০ কোটি ডলারের মাইলফলক ছুঁয়ে যাবে।

অর্থমূল্য বিবেচনায় পাকিস্তান থেকে গত অর্থবছরে হওয়া মোট রফতানির ৪৫ শতাংশই ছিল ওভেন কটন ফ্যাব্রিকস। পণ্যটি বাংলাদেশে রফতানি হয় ৩৯ কোটি ৭৯ লাখ ১৮ হাজার ডলারের। ২০২০-২১-এর চেয়ে ২০২১-২২ অর্থবছরে পণ্যটির রফতানি প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৩৪ দশমিক ৪১ শতাংশ। এ পণ্য মূলত বাংলাদেশ থেকে রফতানি হওয়া ওভেন পোশাকের কাঁচামালের জোগান নিশ্চিত করেছে।

কয়েকজন তৈরি পোশাক রফতানিকারকের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তৈরি পোশাকের কাঁচামাল উৎপাদনে সক্ষমতার উন্নয়ন হলেও এখনো স্বনির্ভর হতে পারেনি বাংলাদেশ। এ প্রেক্ষাপটে ক্রেতাদের চাহিদা ও নির্ধারিত মান অনুযায়ী সুতা ও কাপড় আমদানি করতে হয়। ক্রেতাদের পছন্দ অনুসরণ করার কারণেই তৈরি পোশাকের কাপড় আমদানির বড় উৎস দেশ হয়ে উঠেছে পাকিস্তান। এ রফতানির পরিমাণও ধীরে ধীরে বাড়ছে।

পোশাক প্রস্তুত ও রফতানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএর সহসভাপতি শহিদউল্লাহ আজিম বলেন, ‘পাকিস্তান থেকে অনেক ফ্যাব্রিক বাংলাদেশে আসে। বিশেষায়িত কাপড় উৎপাদনে পাকিস্তানের সক্ষমতা ভালো। মৌলিক কাঁচামাল তুলা উৎপাদনকারী দেশ হিসেবে পাকিস্তানের সুতা ও কাপড় উৎপাদন সক্ষমতা খুবই কার্যকর। দেশটি থেকে পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে ব্যয়ও প্রতিযোগিতামূলক। মুক্তবাজার অর্থনীতির প্রেক্ষাপটে আমরা চীন থেকেও আমদানি করি, আবার পাকিস্তান থেকেও আমদানি করি। যে দেশে মূল্য সুবিধা পাওয়া যায় সেখান থেকেই আমরা আমদানি করি। অনেক সময় ক্রেতারা পাকিস্তানের উৎপাদকের কাছ থেকে কাপড় আমদানির বিষয়টি ঠিক করে দেন। চাহিদা ও জোগান নিশ্চিতের বিষয়গুলো বিবেচনায় নিলে বাংলাদেশে পাকিস্তানের রফতানি আরো বাড়বে বলেই ধারণা করছি।’

দুই দেশের দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য বৃদ্ধির ক্ষেত্রে কোনো বাধা নেই উল্লেখ করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব তপন কান্তি ঘোষবলেন, ‘পাকিস্তানের কাঁচামাল উৎপাদন সক্ষমতা আছে। তুলা, সুতা, কাপড় উৎপাদন করে দেশটি। বাণিজ্য বৃদ্ধির ক্ষেত্রে কোনো বাধা না থাকার কারণে বাংলাদেশে পাকিস্তানের রফতানিতে প্রবৃদ্ধি হয়তো হচ্ছে। তাছাড়া, সাফটার (সাউথ এশিয়ান ফ্রি ট্রেড এরিয়া চুক্তি) অধীনে দুই দেশই অগ্রাধিকার সুবিধা পায়। দুই দেশের বাণিজ্য বর্ধিত হলে তা ইতিবাচক। গত এক দশকে দুই দেশের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক উন্নয়নে বিশেষ কোনো উদ্যোগ না থাকলেও স্বাভাবিক বাণিজ্য অব্যাহত আছে।’

এসবিপির পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশে রফতানির পাশাপাশি বাংলাদেশ থেকেও পাকিস্তানে পণ্য রফতানি বাড়ছে। ২০২১-২২ অর্থবছরে বাংলাদেশ থেকে পাকিস্তানের আমদনি প্রবৃদ্ধি হয়েছে ২৮ দশমিক শূন্য ৬ শতাংশ। বাংলাদেশ থেকে পাকিস্তানের আমদানি হয়েছে ৯ কোটি ৭৫ লাখ ডলারের পণ্য। বাংলাদেশের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশ থেকে পাকিস্তানে রফতানি হওয়া পণ্যের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হলো ওভেন ও নিট পোশাক, হোমটেক্সটাইল, কৃষি পণ্য, চামড়াজাত জুতা-স্যান্ডেল, কাঁচাপাট, পাটজাত পণ্য।

জানতে চাইলে ইপিবির ভাইস চেয়ারম্যান এএইচএম আহসান বলেন, ‘দুই দেশের বাণিজ্য উন্নয়নে কোনো বাধা নেই। সম্পর্ক আরো উন্নয়নের অনেক সুযোগ রয়েছে। দুই দেশের ব্যবসায়ীদের মধ্যে যোগাযোগ ও আস্থা বাড়াতে হবে।’

সূত্র: বণিক বার্তা
আইএ/ ২৩ ডিসেম্বর ২০২২

Back to top button