র্যাব-ডিবির কাছ থেকে তথ্য-প্রমাণ পেয়ে যা বললেন ফারদিনের সহপাঠীরা
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) শিক্ষার্থী ফারিদিন নুর পরশের মৃত্যুর ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তদন্তে পাওয়া তথ্য-প্রমাণে সন্দেহ নেই শিক্ষার্থীদের।
শনিবার বিকেলে বুয়েট ক্যাম্পাসের শহীদ মিনারের পাশে দাঁড়িয়ে সাংবাদিকদের শিক্ষার্থীরা বলেন, ফারদিনের লাশ উদ্ধারের পর থেকে ঘটনার সুষ্ঠু তদন্তের দাবি নিয়ে বিভিন্ন কর্মসূচি আমরা পালন করছিলাম। ডিবি ও র্যাব থেকে ব্যাখ্যা পাওয়ার পর আমরা নতুন কোনো কর্মসূচিতে যাচ্ছি না। তবে ফারদিনের পরিবারের যে কোনো যৌক্তিক দাবির পক্ষে আমরা থাকবো।
এর আগে গত বৃহস্পতিবার শিক্ষার্থীদের একটি দল ডিবি কার্যালয়ে যান তদন্তের তথ্য-প্রমাণাদি দেখার জন্য। সেখানে প্রায় তিন ঘণ্টা ডিবি কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনার পর শিক্ষার্থীরা ওই সময় সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ডিবির তদন্তের প্রচেষ্টায় আমরা সন্তুষ্ট। তবে কিছু গ্যাপ রয়েছে, সেই গ্যাপগুলো পরিষ্কার করার দাবি জানান তারা। এরপর শুক্রবার র্যাব সদর দপ্তরে গিয়ে শিক্ষার্থীরা প্রায় তিন ঘণ্টা বৈঠক করেন। এরপর শনিবার সংবাদ সম্মেলন করে নিজেদের অবস্থানের কথা জানান শিক্ষার্থীরা।
শিক্ষার্থীরা বলেন, আমারা ডিবি ও র্যাবের কাছে জানতে চেয়েছিলাম ফারদিন ইস্যু নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ অনেক সন্দেহ তৈরি হয়েছে। গত ১৪ ডিসেম্বর যখন বলা হলো ফারদিন আত্মহত্যা করেছে তখন আমরা মানববন্ধনের ডাক দিয়েছিলাম, কিন্তু ডিবি আমাদের তদন্তে পাওয়া প্রতিবেদন দেখতে আহ্বান জানায়। অন্য সবার মতো আমাদের মনেও সন্দেহ ছিল। যেহেতু ডিবি থেকে আমাদের সেই সন্দেহের বিষয়ে প্রশ্ন করার সরাসরি সুযোগ দেয়া হয়। তাই আমরা সেখানে যাই। যাতে আমাদের সন্দেহ দূর হয়।
ডিবি-র্যাবের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল, ময়নাতদন্তের পর ডাক্তার বলেছিল ফারদিনের শরীরে অসংখ্য আঘাতের চিহ্ন থাকার কথা। তাহলে এখন কী ভাবে আত্মহত্যা হলো। পরে র্যাব ও গোয়েন্দা পুলিশ ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলে আমাদের জানিয়েছে, ফারদিনের শরীরে থাকা আঘাতগুলো অনেকটা কিলঘুশির মতো। কাটা-চিহ্ন ছিল না। বেশিরভাগ আঘাত রক্তজমা ছিল। এটা ব্রিজ থেকে লাফ দেয়া কিংবা পানির আঘাত ও স্প্যানের আঘাত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তাই ডাক্তার বলেছেন, এই আঘাতের ভিত্তিতে বলা সম্ভব না যে এটা হত্যা না, আত্মহত্যা।
শিক্ষার্থীরা বলেন, আমরা আরও জানতে চেয়েছিলাম, যে সিসিটিভি ফুটেজ দেখিয়ে বলা হয়েছে ফারদিন ব্রিজ থেকে লাফ দিয়েছে। এর সত্যতা কোথায়? ফারদিনের শেষ লোকেশন দেখা গেছে যাত্রাবাড়ী থেকে একটি লেগুনায় উঠেছে। সেই লেগুনা তাকে সুলতানা কামাল ব্রিজের তারাবো এলাকায় নামিয়ে দেয়। সেই লেগুনা চালককে জিজ্ঞাবাদ করা হয়েছে। এছাড়া চালকের মোবাইলের লোকেশন ও ফারদিনের ইন্টারনেট ব্রাউজিং লোকেশন ভেরিফাই করা হয়েছে। এর মাধ্যমে তারা নিশ্চিত হয়েছে। এই সময়ে তিনি বিভিন্ন ওয়েবসাইট ব্রাউজ করছিল। এটা করতে করতে ফারদিন ব্রিজের মাঝামাঝি চলে যায়। পরে যে স্থান থেকে লাফ দেয় সেখানে তার মোবাইলের লোকেশন পাওয়া যায়। তাই তদন্তকারীদের ধারণা, এই একই সময়ে অন্য ব্যক্তির লাফ দেয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। এছাড়া তারা আরও দেখেছে, ওই সময়ের পরপরই ফারদিনের মোবাইল ও ঘড়ি ওই লোকেশনে বন্ধ হয়ে যায়। তাই তাদের ধারণা- এটা ফারদিন ছিল।
শিক্ষার্থীরা বলেন, আমরা জানতে চেয়েছিলাম ফারদিন যে সব স্থানে ঘুরে বেড়িয়েছে তার সঠিক প্রমাণ আছে কি না? এর ব্যাখ্যায় ডিবি ও র্যাব কর্মকর্তারা বলেছেন, ওইদিন রাত ১১টার দিকে বুয়েটের এক সহপাঠীর সঙ্গে দীর্ঘ সময় ধরে কথা বলেছে। ওই সময় ফারদিন স্বাভাবিক ছিল। তিনি স্পেন যাওয়া নিয়ে আলোচনা করেছেন। রাত ১টা ৫৭ মিনিটে ফেসবুকের ম্যাসেঞ্জারে এক বন্ধুর সঙ্গে কথা বলে। সেই সময়েও স্বাভাবিক মনে হয়েছে তাদের।
আমরা আরও জানতে চেয়েছিলাম এক লেগুনা চালক কতদিন আগে ফারদিনকে কোথাও নামিয়ে দিয়েছে, এটা সে কি ভাবে মনে রেখেছে? এর ব্যাখ্যায় ডিবি ও র্যাবের কর্মকর্তারা আমাদের জানিয়েছেন, এটার বিষয় লেগুনা চালক বলেছে বলেছেন, যাত্রাবাড়ী থেকে সুলতানা কামাল ব্রিজের তারাবো এলাকায় অল্প দূরত্বে দুজনকে নামিয়েছে। ফারদিনের মোবাইলের লোকেশন অনুযায়ী দুই স্থানের কোনো একটিতে নেমেছে বলে পুলিশের ধারণা। আর লেগুনা চালকদের দেয়া তথ্যের সঙ্গে ফারদিনের মোবাইলের তথ্য মিলেছে।
মাদক, চনপাড়া বস্তি, রায়হান গ্যাং, গাড়ির সিসিটিভি ফুটেজ বেড়িয়েছে। এই সকল প্রশ্নের যৌক্তিক একটি উত্তর পাওয়ার দরকার ছিল। আমরা বিভিন্ন মানববন্ধনেও এই সকল প্রশ্নের জবাব চেয়েছি। এই তথ্যগুলো যেহেতু র্যাবের বরাত দিয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে এসেছে তাই আমরা এর উত্তর র্যাবের কাছে চেয়েছিলাম। কারণ মাদক, রায়হান গ্যাং ও চনপাড়া বস্তির বিষয়টি এসেছে র্যাবের মাধ্যমে। এর প্রেক্ষিতে র্যাব আমাদের বলেছে, তারা প্রথম তদন্ত শুরু করে তিনিটা প্রশ্ন সামনে রেখে। এগুলো হলো- পরিকল্পিত হত্যা, দূর্ঘটনা কি না ও আত্মহত্যা কি না। তদন্তের শুরুতে তারা ফারদিনের রবি নাম্বারের নেটওয়ার্ক ধরে শুরু হয়। আর ফারদিনের সর্বশেষ অবস্থান অনুযায়ী তারাবো ও চনপাড়া বস্তি এলাকায় দেখিয়েছে। যেহেতু চনপাড়া বস্তি একটি অপরাধ প্রবণ হওয়ায় র্যাব সেই বিষয়কে গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত শুরু করে। চানপাড়ার বেশ কয়েকজনের কাছ থেকে ফারদিনকে হত্যা করা হয়েছে বলে তথ্য দিয়েছে।
কিন্তু পরবর্তীতে তারা তথ্য যাচাই-বাছাই করে মিল পায়নি। এর পরে তারা সুলতানা কামাল ব্রিজের দিকে নজর দিয়েছে। আর গাড়িতে তোলা, বা সিএনজিতে ওঠার বিষয়টি র্যাব জানতো না। তারা সিএনজি ফুটেজ তাদের কাছে আসে নাই। এটা ভুল হওয়ার কারণ হলো ফারদিনের শরীরে ছিলো শার্ট, কিন্তু সিএনজিতে ওঠা তরুণের গায়ে ছিলো কালো গেঞ্জি। সিএনজির সঙ্গে ফারদিনের মোবাইলের লোকেশন মিলেনি।
বুয়েট ক্যাম্পাসে যাওয়ার কথা বলে গত ৪ নভেম্বর ডেমরার কোনাপাড়ার বাসা থেকে বের হন ফারদিন। ৭ নভেম্বর বিকেলে নারায়ণগঞ্জের শীতলক্ষ্যা নদী থেকে তার মরদেহ উদ্ধার করে নৌ পুলিশ।
গত বুধবার র্যাব ও ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) দাবি করে, ফারদিনকে হত্যা করা হয়নি। তিনি ডেমরার সুলতানা কামাল সেতু থেকে লাফ দিয়ে আত্মহত্যা করেছেন। আত্মহত্যার কারণ হিসেবে ডিবি পারিবারিক চাপ, দুই ভাইয়ের পড়াশোনার টাকা জোগানো, ধারাবাহিকভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষার ফল খারাপ হওয়া ও বিতর্ক প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করতে স্পেনে যাওয়ার টাকা সংগ্রহ করতে না পারাকে উল্লেখ করে। যদিও ফারদিনের বাবা এ দাবি মানতে নারাজ।
সূত্র: বাংলাদেশ জার্নাল
এম ইউ/১৭ ডিসেম্বর ২০২২