জাতীয়

সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের ‘নির্বাচনি’ বিজয়োৎসব শুরু, যা আছে ঘোষণায়

মাহফুজ সাদি

ঢাকা, ১৪ ডিসেম্বর – ‘স্পর্ধায় তাড়াবো ধেয়ে আসা যত কালো’—স্লোগানে বিজয় উৎসব-২০২২ শুরু করেছে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট, চলবে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত। মঙ্গলবার (১৩ ডিসেম্বর) কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে উৎসবের উদ্বোধন করেন নাট্যজন ফেরদৌসী মজুমদার।

সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট সভাপতি গোলাম কুদ্দুছ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, করোনা মহামারি ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে দুনিয়া আজ কঠিন সংকটের মুখে। বৈশ্বিক এই সংকটের বিরূপ প্রভাব পড়েছে বাংলাদেশেও। এই অবস্থা মোকাবিলায় পুরো জাতিকে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করা উচিত।

ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের বিরোধীদের একহাত নিয়ে তিনি বলেন, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে সরকারের ওপর এককভাবে দায় চাপাতে চাইছে কোন কোন রাজনৈতিক মহল। এর মধ্য দিয়ে তারা মানুষকে বিভ্রান্ত করে রাজনৈতিক ফায়দা লুটতে চায়। তাদের এই অপতৎপরতা কারও কাম্য নয়। অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ রক্ষায় সাংস্কৃতিক কর্মীদের সোচ্চার হতে হবে।

জোটের সাধারণ সম্পাদক আহকাম উল্লাহ্ বলেন, বঙ্গবন্ধু হত্যা থেকে শুরু করে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা- প্রতিটি আক্রমণের মূলে ছিল বাংলাদেশবিরোধী অপশক্তি। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বাংলাদেশকে অসাম্প্রদায়িক পথে চালাতে তাদের সাথে কোনও আপস করা চলবে না। সাংস্কৃতিক কর্মীরা আপস করবে না।

কর্মসূচির মধ্যে ছিল—শহীদ বেদীতে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ, এক মিনিট নীরবতা পালন, জাতীয় সংগীত ও মুক্তিযুদ্ধের গান, বিজয়ের আবৃত্তি এবং নৃত্যের সাথে বেলুন উড্ডয়ন। দ্বিতীয় পর্বে ছিল সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।

এ বছর ১৩-১৬ ডিসেম্বর রাজধানীর কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার ও রবীন্দ্র সরোবরসহ ৯টি মঞ্চে এবারের বিজয় উৎসব হচ্ছে কোনও কোনও মঞ্চে এরপরও অনুষ্ঠান হবে।

যেসব মঞ্চে উৎসবটি চলছে— কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার: ১৩-১৬ ডিসেম্বর; ধানমন্ডির রবীন্দ্র সরোবর মঞ্চ: ১৮-১৬ ডিসেম্বর; রায়ের বাজার বুদ্ধিজীবী স্মৃতিস্তম্ভ: ১৪-১৬ ডিসেম্বর; মিরপুর ৬ নম্বর মুকুল ফৌজ মাঠ: ১৫-১৬ ডিসেম্বর; দনিয়া মাসুদ মঞ্চ: ১৪-১৬ ডিসেম্বর; ভিক্টোরিয়া পার্ক: ১৯-২০ ডিসেম্বর; মতিঝিল টিএন্ডটি কলোনি মাঠ: ১৬ ডিসেম্বর; উত্তরা বঙ্গবন্ধু মঞ্চ: ১৫ ডিসেম্বর এবং পূর্বাচল জয় বাংলা স্কয়ার: ১৬ ডিসেম্বর।

এছাড়া সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সহযোগিতায় বাংলাদেশ আবৃত্তি সমন্বয় পরিষদ ১৫ ও ১৬ কলকাতায় বাংলাদেশ ডেপুটি হাইকমিশন, ১৭ ডিসেম্বর বেনাপোল ও যশোর এবং ২৩ ডিসেম্বর ঢাকার গুলশানে বিচারপতি শাহাবুদ্দিন পার্কে বিজয় উৎসব উপলক্ষে অনুষ্ঠান আয়োজন করেছে। ১৫০টির বেশি সংগঠনের ৩ হাজার ৫ শ’র বেশি শিল্পী এবারের বিজয় উৎসবে অংশ নেবেন।

বিজয় উৎসবের ঘোষণায় যা আছে

আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে এবারের বিজয় উৎসবের উদ্বোধনের দিন একটি ঘোষণা পাঠ করা হয়। সেটি এখানে তুলে ধরা হলো-

যে সময়ে আমরা এ বছর বিজয় উৎসবের আয়োজন করছি, এ সময়টি বৈশ্বিক এবং দেশীয় প্রেক্ষাপটে অতীব গুরুত্বপূর্ণ। করোনা মহামারি-উত্তর বিশ্ব যখন আবার স্বাভাবিকতায় ফিরে আসার প্রস্তুতি গ্রহণ করছে, ঠিক সে সময়ে ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধ পুরো বিশ্বকে এক নাজুক পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দিয়েছে। যুদ্ধের দামামা, নানাধরনের অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা, অবরোধ, বৃহৎ শক্তিসমূহের নতুন নতুন বলয় সৃষ্টি এবং পরিধি বিস্তারের জন্য উন্নয়নশীল এবং স্বল্পোন্নত দেশসমূহের ওপর অযাচিত চাপ প্রয়োগের ফলে দেশে দেশে অর্থনৈতিক সংকট দেখা দিয়েছে। একই কারণে আমাদের দেশেও আমদানি ব্যয় বৃদ্ধি, কোন কোন ক্ষেত্রে রফতানি সংকুচিত হওয়া এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের স্বাভাবিক গতি ব্যাহত হওয়ায় দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধিতে সাধারণ মানুষের জীবনমান রক্ষায় নতুন চ্যালেঞ্জ দেখা দিয়েছে।

নাজুক এই বিশ্ব পরিস্থিতিকে পুরো জাতি ঐক্যবদ্ধভাবে মোকাবেলা করবে, এটাই প্রত্যাশিত। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য হলো, এ জাতীয় সংকট মোকাবিলায় আমরা এখনও কোন ঐক্যসূত্রে দাঁড়াতে পারিনি। আগামী জাতীয় নির্বাচন সন্নিকটে বিধায় কোন কোন রাজনৈতিক মহল পরিস্থিতির সকল দায় এককভাবে সরকারের ওপর চাপিয়ে দিয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করা এবং রাজনৈতিক ফায়দা লাভে তৎপর। তবে একইসাথে আমরা ব্যাংকের অর্থ লোপাটকারী এবং সিন্ডিকেট তৈরি করে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির মাধ্যমে জনজীবনে সংকট সৃষ্টিকারীদের চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান গ্রহণ করা জরুরি বলে মনে করি।

সকলেই জানেন যে, এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে আমরা স্বাধীনতা অর্জন করেছি। এই স্বাধীনতার মূল লক্ষ্য ছিল, কতগুলো নীতি-আদর্শের প্রতিষ্ঠা করা। আর সেই প্রত্যয়ে ৭২-এর সংবিধানে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও বাঙালি জাতীয়তাবাদকে আমাদের সংবিধানের মূল স্তম্ভ এবং রাষ্ট্র পরিচালনার নীতি হিসেবে গ্রহণ করা হয়। কিন্তু ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ তার পরিবারের অধিকাংশ সদস্য এবং ৩ নভেম্বর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে জাতীয় চার নেতাকে হত্যার মধ্য দিয়ে অগণতান্ত্রিকভাবে ক্ষমতা দখলকারী গোষ্ঠী মুক্তিযুদ্ধের বিপরীতে পুরনো পাকিস্তানি ভাবাদর্শে বাংলাদেশকে পরিচালিত করার নীতি অবলম্বন করে। স্বাধীনতাবিরোধী ও সাম্প্রদায়িক শক্তিকে রাজনীতিতে পুনর্বাসিত করে দেশের সম্প্রীতির বন্ধনকে বিনষ্ট করবার পরিকল্পনা ছিল তারই অংশ। সাম্প্রদায়িক এই জঙ্গিগোষ্ঠীর উত্থান এবং অসাম্প্রদায়িক চেতনা, মুক্তবুদ্ধির চর্চা ও উদারবাদী সংস্কৃতির বিরুদ্ধে আঘাত ও অপপ্রচার বিএনপি-জামায়াতের রাজনৈতিক পরিকল্পনারই অংশ বলে আমরা মনে করি। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে এধরনের অপতৎপরতা বৃদ্ধির আলামত ইতোমধ্যেই পরিলক্ষিত হচ্ছে। মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে দণ্ডিত সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর পুত্রের সাম্প্রতিক বক্তব্য এবং ১০ ডিসেম্বর ঢাকায় এক সমাবেশে বিএনপি ঘোষিত দশ দফার মধ্যে জঙ্গি দমন আইন বাতিলের দাবি আমাদেরকে শঙ্কিত করে তোলে। এমনি পরিস্থিতিতে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের প্রত্যাশা হলো, অসাম্প্রদায়িক উদারবাদী গণতান্ত্রিক শক্তির ঐক্যবদ্ধ অবস্থান গ্রহণ। ধর্ম-বর্ণ, জাতি-গোষ্ঠী নির্বিশেষে সবার জন্য সম-অধিকারের বাংলাদেশ নিশ্চিতকরণে এই ঐক্যবদ্ধতার কোন বিকল্প আছে বলে আমরা মনে করি না। একই উদ্দেশ্যে দেশব্যাপী একটি সাংস্কৃতিক জাগরণ গড়ে তোলায় সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট প্রতিশ্রুতিবদ্ধ এবং ইতোমধ্যে সে প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। আমরা বিভেদের বিপরীতে সম্প্রীতির বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় দেশবাসীকে ঐক্যবদ্ধ করার লক্ষ্যে নানাবিধ কর্মসূচি গ্রহণ করেছি। জানুয়ারি মাস থেকে ঢাকায় এবং দেশব্যাপী এ সকল কর্মসূচি পালিত হবে। আমরা দেশের সকল সামাজিক, সাংস্কৃতিক, পেশাজীবী সংগঠনকে অনুরূপ কর্মসূচি গ্রহণের আহ্বান জানাই।

সংস্কৃতির শক্তি নিয়ে সকল অপশক্তি প্রতিরোধ করে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের ভিত্তিতে একটি অসাম্প্রদায়িক শোষণমুক্ত গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় আমরা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। আমরা বিশ্বাস করি, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য সুন্দর আগামী প্রতিষ্ঠায় আমাদের ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টার মধ্য দিয়েই জাতির স্বপ্ন বাস্তবায়িত হবে। আমাদের প্রত্যয়, দেশের শুভবুদ্ধিসম্পন্ন সকল মানুষের ঐক্যবদ্ধ প্রয়াসের মধ্য দিয়ে সকল অশুভ শক্তিকে পরাভূত করে মানবিক বোধসম্পন্ন সাম্য-মৈত্রীর সমাজ প্রতিষ্ঠিত করবোই।

সূত্র: বাংলা ট্রিবিউন
আইএ/ ১৪ ডিসেম্বর ২০২২

Back to top button