অপরাধ

প্রতারণা করে কোটি টাকার পার্ক, বাড়ি ও জমি কিনেছেন হরিদাস

ঢাকা, ০৯ নভেম্বর – কারো কাছে পরিচিত প্রধানমন্ত্রীর পরিবারের সদস্যদের প্রটোকল অফিসার। কারো কাছে মন্ত্রীর একান্ত সচিব (পিএস)। বিভিন্ন সময় অভিনব সব প্রতারণার মাধ্যমে মাত্র ৮ বছরে হাতিয়ে নিয়েছেন কোটি কোটি টাকা। ময়মনসিংহে দুই কোটি টাকা ব্যয়ে গড়েছেন ‘প্যারিস সুইমিং পুল ও অ্যান্টারটেইনমেন্ট পার্ক।’
অভিনব সব প্রতারণার মাধ্যমে হাতিয়ে নেওয়া শ্রী হরিদাস চন্দ্র তরনীদাস ওরফে তাওহীদকে (৩৪) থামিয়েছে জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থা (এনএসআই) ও র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব)। সোমবার (৭ নভেম্বর) রাতে রাজধানীর বনানী থেকে সহযোগী ইমরানসহ হরিদাসকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
র‌্যাব জানায়— ২০১৪ সালে এডিট করে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে নিজের ছবি জুড়ে ওয়ালপেপারে টাঙিয়ে রাখেন হরিদাস। তখন থেকেই প্রভাবশালী ব্যক্তিদের নাম ভাঙিয়ে কীভাবে অর্থ উপার্জন করা যায় তার ফন্দিফিকির করতে থাকেন। ২০১৯ সালে ধর্মান্তরিত হয়ে হরিদাস চন্দ্র থেকে তাওহীদ ইসলাম নাম ধারণ করেন। এরপর প্রতারণার মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করে ধনী ও প্রভাবশালী বনে যান।
মঙ্গলবার (৮ নভেম্বর) দুপুরে কারওয়ান বাজারে র‌্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা জানান র‌্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন।
তিনি বলেন, একশ্রেণির প্রতারকচক্র স্পর্শকাতর ব্যক্তিদের অথবা সমাজের বিভিন্ন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নাম ব্যবহার করে বা তাদের প্রটোকল অফিসার, বা বিভিন্ন মন্ত্রীর এপিএস পদবি ব্যবহার করে মানুষের সঙ্গে প্রতারণার মাধ্যমে অর্থ আত্মসাৎ করছে। এমনকি প্রতারকচক্র প্রধানমন্ত্রীর পরিবারের প্রটোকল অফিসার পরিচয় দিয়েও অর্থ আত্মসাৎ করে আসছিল।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে চাকরি, পদোন্নতি ও বদলির কথা বলে মোটা অংকের টাকা আত্মসাৎ
র‍্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক বলেন, এলাকার বিত্তশালী লোক এসব প্রজেক্টে বিনিয়োগ করলে তাদের লভ্যাংশ দেওয়া হবে। এছাড়া প্রজেক্ট শুরু হলে— প্রজেক্ট সমাপ্ত করার জন্য সে প্রধানমন্ত্রীর পরিবারের সহায়তায় বিভিন্ন সরকারি দপ্তর থেকে অর্থ এবং উন্নয়নমূলক কাজের সম্পন্ন করতে তাদের আশ্বস্ত করতেন। এছাড়া এসব প্রজেক্ট বাস্তবায়ন হলে এলাকার উন্নতি হবে বলে প্রলুব্ধ করতেন। তার প্রতারণায় প্রলুব্ধ হয়ে অনেকেই চাকরি, বদলি, টেন্ডারসহ বিভিন্ন বিষয়ে তদবির করার জন্য সহায়তা চায়।
এ সুযোগকে কাজে লাগিয়ে হরিদাস চাকরিপ্রত্যাশী, সরকারি চাকরিজীবীদের পছন্দমত জায়গায় বদলি, বিভিন্ন ক্রয়-বিক্রয় ও উন্নয়নমূলক কাজের টেন্ডারে অংশ দিতে ইচ্ছুক ব্যক্তিদের কাছ থেকে টাকার বিনিময়ে কাজ করে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে টাকা আত্মসাৎ করতে করতেন। তার সহযোগী গ্রেফতার ইমরান স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে কর্মরত তার বিভিন্ন সহযোগীসহ অন্যান্য ক্লায়েন্ট সংগ্রহ করে হরিদাসের কাছে নিয়ে আসতেন। এ সময় হরিদাস এসব ব্যক্তিদের স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে বিভিন্ন পদে চাকরি, পদোন্নতি এবং বদলির বিষয়ে আশ্বস্ত করে মোটা অংকের টাকা আত্মসাৎ করতেন।
প্রতারণার টাকায় ‘প্যারিস সুইমিংপুল রিসোর্ট’
কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, তাওহীদ প্রতারণার মাধ্যমে পাওয়া টাকা দিয়ে ২০১৯ সালে ফুলবাড়িয়া এলাকায় প্রায় একবিঘা জমি কিনে প্যারিস সুইমিংপুল অ্যান্টারটেইনমেন্ট পার্ক নামে রিসোর্টের কাজ শুরু করে। কাজ শুরু হলে তার প্রলোভনে আরও অনেকেই টাকা লেনদেনের রশিদ ছাড়া তাকে লাখ লাখ টাকা দেন। ২০২০ সালে প্রায় তিন কোটি টাকা ব্যয়ে রিসোর্টের কাজ শেষ হলে ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে পর্যটকদের জন্য উন্মুক্ত করা হয়। রিসোর্টে প্রবেশ মূল্য ৫০ টাকা, সুইমিংপুলে গোসল ১০০ টাকা এবং রিসোর্টের ভেতরে ঘোরাঘুরির জন্য ৫০ টাকা করে টিকিট ছিল। দলে দলে পর্যটক তার রিসোর্টে ভিড় করতে থাকেন। অনেকে বিয়ে, জন্মদিনসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানের জন্য তার রিসোর্ট ভাড়া নিতেন। তখন সে বিভিন্ন বিত্তশালী ব্যক্তিদের তার রিসোর্টে আমন্ত্রণ জানান এবং এডিট করা প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ছবি প্রদর্শন করে তার প্রজেক্টসহ অন্যান্য প্রজেক্টে বিনিয়োগ করতে উৎসাহিত করতেন। এর মাধ্যমে সে অনেকের কাছ থেকে অর্থ আদায় করেছেন।
হরিদাস জড়িত ছিল স্বর্ণ চোরাচালান বাণিজ্যেও
র‍্যাবের মূখপাত্র বলেন, হরিদাস কখনো নিজেকে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের কর্মকর্তা বা তার পরিবারের প্রটোকল অফিসার, বৈমানিক কর্মকর্তা পরিচয় দিয়ে একাধিক প্রতারণা করে আসছিল। সে ফুলবাড়িয়া এবং বিভিন্ন এলাকায় বিভিন্ন পদে চাকরি দেওয়ার নাম করে শতাধিক লোকের কাছ থেকে কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়। তার কাজে বাধা দেওয়ায় সে একজন স্থানীয় নেতাকে প্রকাশ্যে হত্যার হুমকি দেন। সে বিভিন্ন সরকারি কার্যালয়ে টেন্ডারের বিষয়ে তদবির করার জন্য প্রধানমন্ত্রীর পরিবারের পরিচয় দিয়ে ফোনালাপ করে টেন্ডারে অংশগ্রহণকারীদের কাছ থেকে অর্থ হাতিয়ে নেন। যদিও সে কাউকে কাজ পাইয়ে দিতে সক্ষম হয়নি। সে স্বর্ণ চোরাচালান ও স্বর্ণবারের অবৈধ বাণিজ্যের সঙ্গেও জড়িত।
সহযোগী ইমরান মেহেদী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের ক্যাশিয়ার
গ্রেফতার ইমরান মেহেদী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের ক্যাশিয়ার। তার নামে একাধিক অপকর্ম- প্রাইভেট ক্লিনিকে চাকরি দেওয়া, অনলাইনে নিবন্ধন আবেদন, নিবন্ধিত প্রতিষ্ঠানের নবায়নসহ অর্থ জালিয়াতির বিভিন্ন অপকর্মে জড়িত থাকায় শাস্তিস্বরূপ চলতি বছরের প্রথম দিকে বিভাগীয় শহর থেকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে বদলি করা হয়।
২০১৪ সাল থেকে গ্রেফতার তাওহীদ প্রতারণা করে আসছিল। কিন্তু এতদিন কেন আইনের আওতায় এলো না। সাংবাদিকদের এমন এক প্রশ্নের জবাবে র‍্যাবের মুখপাত্র বলেন, সে ২০১৪ সাল থেকে প্রতারণা করছে এ মর্মে আমাদের কাছে কেউ অভিযোগ করেনি। তবে সম্প্রতি জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থার (এনএসআই) তদন্তে বেশকিছু তথ্য বেরিয়ে আসে। পাশাপাশি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে বিভিন্ন পদে চাকরি, পদোন্নতি ও বদলির বিষয়ে আশ্বস্ত করে ভুয়া ডিও লেটার ও ভুয়া সিল ব্যবহার করে একাধিক ভুক্তভোগীর কাছ থেকে মোটা অংকের টাকা আত্মসাৎ করেছে। যদিও তিনি এখন পর্যন্ত কাউকে চাকরি দিতে পারেননি।
সূত্র: জাগোনিউজ
আইএ/ ০৯ নভেম্বর ২০২২

Back to top button