ঢাকা, ৬ নভেম্বর – অনিয়ম ও দুর্নীতিতে জড়ালে আর ছাড় পাবেন না রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের দায়ী কর্মকর্তারা। কারণ এখন থেকে এসব ব্যাংকের গুরুতর অনিয়মে দায়ী কর্মকর্তাদের তালিকা নিয়মিতভাবে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। সম্প্রতি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পর্ষদসভায় এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এর আগে এ ধরনের উদ্যোগ কখনো দেখা যায়নি। মূলত ব্যাংকগুলো ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা বৃদ্ধি এবং সুশাসন নিশ্চিত করতে দায়ী কর্মকর্তাদের দ্রুত শাস্তির আওতায় আনতে এমন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এরই মধ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অফসাইট সুপারভিশন বিভাগের তত্ত্বাবধানে সংশ্লিষ্ট সব বিভাগ থেকে দায়ী কর্মকর্তাদের তথ্য সংগ্রহ করে তালিকা তৈরির কাজ চলছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের দায়ী কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে আইনিব্যবস্থা জোরদারে এ উদ্যোগ ইতিবাচক। তবে এর মাধ্যমে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা আরও খর্ব হলো।
ব্যাংকগুলো হচ্ছে- সোনালী, জনতা, অগ্রণী, রূপালী, বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ও বেসিক ব্যাংক। গত দেড় দশকে ব্যাংক খাতে যতগুলো বড় বড় ঋণ কেলেঙ্কারির ঘটনা ঘটেছে, তার অধিকাংশই ঘটেছে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোতে। এসব ঘটনায় ব্যাংকগুলোর পরিচালনা পর্ষদ ও কর্মকর্তাদের যোগসাজশের প্রমাণ মেলার পরও দায়ীদের বিরুদ্ধে তেমন কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। ফলে দীর্ঘ সময়েও ফেরেনি ব্যাংকগুলোর হাজার হাজার কোটি টাকা, যা এখন খেলাপিতে পরিণত হয়েছে। বছরের পর বছর এর বিপরীতে মুনাফা থেকে প্রভিশন (নিরাপত্তা সঞ্চিতি) রাখতে গিয়ে ব্যাংকগুলোর আর্থিক ভিত্তি দুর্বল হয়ে পড়ছে। নিয়মিত সমঝোতা চুক্তির আওতায় তত্ত্বাবধান করার পরও এসব ব্যাংকের উন্নতি হচ্ছে না। তবে দেরিতে হলেও এসব ব্যাংকের অসাধু ও দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে হার্ডলাইনে যাচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। গত আগস্ট মাসে অনুষ্ঠিত কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ৪২৩তম সভায় বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক উদ্ঘাটিত রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর গুরুতর অনিয়মের জন্য দায়ী কর্মকর্তাদের তালিকা নিয়মিতভাবে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। জানা গেছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের কোনো পরিদর্শন প্রতিবেদন স্বউদ্যোগে অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠানোর নজির খুবই কম। এ ক্ষেত্রে সমন্বয়হীনতার অভাব রয়েছে। তবে নতুন গভর্নর হিসেবে আবদুর রউফ তালুকদার যোগদান করার পর এ সমন্বয়হীনতা কমিয়ে আনার ওপর জোর দিয়েছেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বাংলাদেশ ব্যাংকের এক কর্মকর্তা বলেন, ব্যাংক খাতে যেসব অনিয়ম হয়, তার অধিকাংশই রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোতে। এসব ব্যাংকের কর্মকর্তাদের সততা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। তাই আগামীতে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে শাস্তির প্রক্রিয়াটা ইমপ্রুভ করার জন্য এমন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তিনি আরও বলেন, কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য প্রত্যেকটি ব্যাংকের নিজস্ব পলিসি রয়েছে। যখন কোনো ব্যাংকের বিরুদ্ধে অনিয়ম উদ্ঘাটন করা হয়, তখন ওই পলিসি অনুযায়ী দায়ী কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে বলা হয়ে থাকে। তবে এ ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলো অভ্যন্তরীণ তদন্ত পরিচালনার পর কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করে থাকে। এ প্রক্রিয়ায় দায়ী কর্মকর্তাদের শাস্তি নিশ্চিত হতে অনেক বিলম্ব হয়।
জানা গেছে, চলতি অর্থবছর থেকে প্রতি তিন মাস পর পর এসব ব্যাংকের গুরুতর অনিয়মের জন্য দায়ী কর্মকর্তাদের তালিকা পাঠানোর সিদ্ধান্ত হয়। ওই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, গত জুলাই থেকে সেপ্টেম্বরÑ এই তিন মাসের তালিকা চূড়ান্ত করতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিভাগ যেমন ব্যাংক পরিদর্শন বিভাগ-১, ২ ও ৮ এবং ফিন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটি অ্যান্ড কাস্টমার সার্ভিসেস বিভাগ, বৈদেশিক মুদ্রা পরিদর্শন বিভাগ, ব্যাংকিং প্রবিধি ও নীতি বিভাগ এবং পেমেন্ট সিস্টেমস বিভাগ থেকে তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। অফসাইট সুপারভিশন বিভাগ থেকে এসব তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। শিগগিরই ওই তথ্য সমন্বয় করে দায়ী কর্মকর্তাদের তালিকা আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগে পাঠানো হবে।
এদিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান হলেও বাস্তবে তা ভোগ করতে পারছে না। ব্যাংক খাতের যে কোনো সিদ্ধান্তে সরকারের শীর্ষ মহল থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওপর হস্তক্ষেপ করা হয়ে থাকে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলও (আইএমএফ) মনে করে, বিশ্বের অন্যান্য দেশে কেন্দ্রীয় ব্যাংক স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারলেও বাংলাদেশে তা হচ্ছে না। সংস্থাটির মতে, ব্যাংক খাতে সুদহার নিয়ন্ত্রণ, মুদ্রানীতি, সরকারি ব্যাংকে হস্তক্ষেপসহ নানাভাবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাজে বাধা দেওয়া হচ্ছে। গত সপ্তাহে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব শেখ মোহাম্মদ সলিম উল্যাহর সঙ্গে বৈঠকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বায়ত্তশাসন নিশ্চিত করার ওপর জোর দেন আইএমএফ প্রতিনিধি দলের সদস্যরা।
সূত্র: আমাদের সময়
আইএ/ ৬ নভেম্বর ২০২২