ঢাকা, ২৭ অক্টোবর – জঙ্গি সংগঠন জামাতুল আনসার ফিল শারক্কিয়া’র প্রধান জঙ্গি নেতা শামীন মাহফুজ ওরফে স্যার। কয়েকটি জঙ্গি সংগঠনের সদস্যদের নিয়ে গঠন করা হয়েছে এই সশস্ত্র সংগঠনটি। শামীন মাহফুজকে গ্রেফতার করা গেলে এই সংগঠনের বিষয়ে সব তথ্য পাওয়া যাবে বলে মনে করেন গোয়েন্দারা। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের এক কর্মকর্তা বলেন, সম্প্রতি যৌথ বাহিনীর অভিযান শুরু হওয়ার পরে জঙ্গি নেতা শামীন মাহফুজ সস্ত্রীক আত্মগোপনে আছেন। তথ্য বলছে, তিনি পাহাড়ি এলাকায় অবস্থান করছেন।
শামীন মাহফুজ ছাত্রজীবন থেকেই জঙ্গিবাদে জড়িত। খুব সতর্কতার সঙ্গে সংগঠনের কাজ করতেন। ২০১৬ সাল মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের হাতে গ্রেফতার হওয়ার পরে সামনে চলে আসেন মাহফুজ। এরপর জামিনে বেরিয়ে পেছন থেকে সংগঠনের কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন বলে জানান গোয়েন্দা কর্মকর্তারা।
গোয়েন্দা পুলিশের এক কর্মকর্তা বলেন, সম্প্রতি সারা দেশে যেসব তরুণ হিজরতের উদ্দেশে ঘর ছেড়েছেন তারা সবাই শামীন মাহফুজের তত্ত্বাবধানে ছিলেন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিয়মিত মনিটরিংয়ের কারণে কোথাও সুবিধা করতে না পারায় পাহাড়ের দিকে যান তারা। সেখানে প্রশিক্ষণ ক্যাম্প গড়ে তুলেন।
সিটিটিসি’র সিটি ইনভেস্টিগেশন বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার এসএম নাজমুল হক বলেন, গতকাল পাঁচ জঙ্গি সদস্যকে গ্রেফতারের পরে নতুন কিছু তথ্য পাওয়া গেছে। তাদের পৃথক জিজ্ঞাসাবাদে আরও ১০-১২ জঙ্গি সদস্যের তথ্য পাওয়া গেছে।
বৃহস্পতিবার (২৭ অক্টোবর) আদালতে তুলে তাদের রিমান্ড আবেদন করা হয়। পরে আদালত দুদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। এখন তাদের দেওয়া প্রাথমিক তথ্যগুলো আরও যাচাই-বাছাই করা হবে।
সিটিটিসি প্রধান মো. আসাদুজ্জামান বলেন, গত কয়েক মাস ধরে তারা নতুন জঙ্গি সদস্যদের পাহাড়ে প্রশিক্ষণ দিয়ে আসছে। এছাড়া শামীন মাহফুজ এখন পাহাড়েই অবস্থান করছেন বলে তথ্য আছে। আর এই সংগঠনের নারী সদস্যের মধ্যে মাহফুজের স্ত্রীসহ আরও তিন-চার জন আছেন। কয়েক বছর ধরে দেশের কোথাও সুবিধা করতে না পেরে তারা আনসার ফিল হিন্দাল শারক্কিয়ার নামে এই সংগঠন দাঁড় করান। বর্তমানে তারা এই সংগঠনকেই সশস্ত্র করে তুলতে কাজ করছিলেন।
নতুন এই জঙ্গি সংগঠন জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্কিয়ার গঠনের পরিকল্পনা হয় কারাগারে। ২০১৭ সাল থেকে নতুন জঙ্গি সংগঠনটি গঠনের কাজ শুর করেন সংশ্লিষ্টরা। পাহাড়ি অঞ্চলে প্রশিক্ষণও শুরু করে সংগঠনটি। সম্প্রতি সংগঠনটির বেশ কয়েকজন সদস্যকে গ্রেফতার করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। তবে এই সংগঠনটির উদ্দেশ্য কী তা এখনও অজানা।
জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে যারা হিজরতের উদ্দেশে বাড়ি ছেড়ে বের হতেন, তাদের ঢাকায় সংগঠনের কথিত ‘আনসার হাউজে’ রাখা হতো। সেই আনসার হাউজ দেখাশোনা করতেন আব্দুল্লাহ নামে একজন। দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে নতুন সদস্যরা হিজরতের উদ্দেশে বাড়ি ছেড়ে বের হয়ে এখানেই আসতেন।
পরে সেখান থেকে দলে দলে প্রশিক্ষণের জন্য পার্বত্য অঞ্চলে নেওয়া হতো। গ্রেফতারকৃত তাজুল ও হাবিবুল্লাহ নতুন জঙ্গি সংগঠনের যেসব সদস্য আনসার হাউজে আসতেন তাদের রাজধানী ঢাকা বিভিন্ন এলাকা থেকে রিসিভ করে নিয়ে আসতেন বলে জানিয়েছেন সিটিটিসির প্রধান আসাদুজ্জামান।
তিনি বলেন, কুমিল্লা থেকে জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে বের হওয়া সাত তরুণের মধ্যে আবরার নামে এক তরুণকে গ্রেফতার করে সিটিটিসি। আবরার জিজ্ঞাসাবাদে জানায়, ডা. শাকের বিন ওয়ালী নামে এক জঙ্গি তাকে বাড়ি থেকে নিয়ে আসে। এরপর ডা. শাকের বিন ওয়ালীকেও রামপুরার বাসা থেকে গ্রেফতার করা হয়। এই শাকের বিন ওয়ালী এই নতুন জঙ্গি সংগঠনের দাওয়া বিভাগের প্রধান। শাকের বিন ওয়ালী কুমিল্লা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল থেকে এমবিবিএস পড়াশোনা করেছেন। শাকের বিন ওয়ালী জঙ্গি সংগঠনটির গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে ছিলেন। তিনি ‘বড় হুজুরের’ নির্দেশে তরুণদের জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ করার কাজ করতেন।
এই ডা. শাকের বিন ওয়ালি প্রতি মাসে একবার বান্দরবান এলাকায় নতুন জঙ্গি সংগঠন প্রশিক্ষণ শিবিরে যেতেন। সেখানে তাদের কোনও সদস্য অসুস্থ বা রোগে আক্রান্ত হলে তিনি চিকিৎসা দিতেন। আবার তিনি যখন ঢাকায় থাকতেন তখন তিনি নতুন জঙ্গি সংগঠনটি প্রধান শামীন মাহফুজ ওরফে স্যারের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করতেন। অসুস্থতার লক্ষণ শুনে ব্যবস্থাপত্র পাঠাতেন শাকের বিন ওয়ালী। এছাড়া জঙ্গি সংগঠনটির সঙ্গে প্রশিক্ষণ শিবিরে থাকা পাহাড়ি সন্ত্রাসী সংগঠন কুকিচিনের সদস্যরা আহত হলে সেখানে গিয়ে চিকিৎসা করতেন এই চিকিৎসক।
ডাক্তার শাকের বিন ওয়ালীর কাছ থেকে মহসিন ওরফে রিয়েল নামে আরেক জঙ্গি নেতার নাম পাওয়া যায়। এই মহসিন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্স-মাস্টার্স শেষ করে নতুন জঙ্গি সংগঠনটির একজন শীর্ষ নেতা হিসেবে কাজ শুরু করেন।
ডা. শাকের বিন ওয়ালীর কাছ থেকেই নতুন সংগঠনের তথ্য মেলে। যা পরে পর্যালোচনা করে সত্যতা পাওয়া গেছে বলে জানান সিটিটিসি প্রধান মো. আসাদুজ্জামান। শাকেরের কথা মতো, এই সংগঠনের প্রথম আমির মাইনুল ইসলাম ওরফে রক্সি। ২০২১ সালের আগ পর্যন্ত রক্সি ছিলেন এই সংগঠনের আমির। ওই বছর রক্সিকে গ্রেফতার করে সিটিটিসি।
দুদিন আগে রক্সিকে আবার রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। রক্সি জানায়, এই সংগঠনের মূল মাস্টারমাইন্ড শামীন মাহফুজ ওরফে স্যার। ২০১৪ সালে শামীন মাহফুজ ওরফে স্যারকে গ্রেফতার করেছিল ডিবি। রক্সিও ২০১৫ সালে একবার গ্রেফতার হয়েছিলেন। রক্সি ও শামীন যখন একসঙ্গে জেলখানায় ছিলেন তখন তারা সেখানে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি আবু সাঈদের সংস্পর্শে আসেন। আবু সাইদের সংস্পর্শে এসে তারা বিভিন্ন বিষয়ে আলাপ আলোচনা করেন। এই তিন জন জেলখানায় বসে নতুন সংগঠন তৈরির পরিকল্পনা করেন। পরিকল্পনা হয় রক্সি ও শামীন জেলখানা থেকে বের হয়ে জেল থেকে বের হওয়া ও বাইরে থাকা জঙ্গিদের নিয়ে শক্তিশালী সশস্ত্র একটি জঙ্গি সংগঠন গঠন করবেন। পরিকল্পনা অনুযায়ী জামিনে বের হয়ে রক্সি ও শামীন সংগঠনের কাজ শুরু করে দেন।
ডা. শাকের, কৃষিবিদ মহসিন ও রক্সির বরাতে সিটিটিসি প্রধান বলেন, শামীন মাহফুজ ২০০৬ সাল থেকে পাহাড়ি এলাকাকে কেন্দ্র করে একটি জঙ্গি নেটওয়ার্ক তৈরি করার জন্য পরিকল্পনা করে আসছিলেন। সর্বশেষ ২০১৭ সালে মাহফুজ জামিনে বের হন। পাহাড়ি এলাকায় একটি প্রশিক্ষণ ক্যাম্প খুঁজতে থাকেন। পরে জানতে পারেন পাহাড়ি এলাকায় কুকি-চিন নামে একটি সংগঠন সক্রিয় আছে। সেই সংগঠনের প্রধান নাথাং বম। এই নাথাং বম শামীন মাহফুজের বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। শামীন মাহফুজ ও নাথাং বম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একসঙ্গে লেখাপড়া করেছেন।
বন্ধু নাথাং বমের সঙ্গে যোগাযোগ করে শামীন তার সংগঠনের সদস্যদের প্রশিক্ষণের কথা বলেন। নাথাং বম অর্থের বিনিময়ে প্রশিক্ষণ দিতে রাজি হন। এই পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ২০১৯ সালে কক্সবাজারের একটি হোটেলে বৈঠক করেন তারা। এই মিটিংয়ে উপস্থিত ছিলেন শামীন, রক্সি, মহসিন, বিকাশ ও তমাল নামে আরেকজন। কুকিচিনের পক্ষ থেকে মিটিংয়ে ছিলেন নাথাং বম ও তার দুই সহযোগী। মিটিং অর্থের বিনিময়ে প্রশিক্ষণের সিদ্ধান্ত হলে নতুন জঙ্গি সংগঠনের সদস্যরা বান্দরবানের পাহাড়ি এলাকায় প্রশিক্ষণ শিবিরে কাটআউট পদ্ধতিতে যাওয়া শুরু করে। এছাড়া বাইরে থেকে একমাত্র ডা. শাকের প্রশিক্ষণ শিবির পরিদর্শন করতে পারতেন। তাছাড়া অন্য সদস্যদের সেই সুযোগ ছিল না।
এই সংগঠনের সদস্য কত ও কথিত হিজরতের নামে কতজন নিখোঁজ— জানতে চাইলে সিটিটিসি প্রধান বলেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তথ্য মতে এখন পর্যন্ত ৭০ জন নিখোঁজ রয়েছেন। হয়তো সবাই প্রশিক্ষণে যায়নি। আমরা যতটুকু জানি তিন ধাপে প্রশিক্ষণ শিবির লোক পাঠানো হয়েছে।
কে এই শামীন মাহফুজ
গাইবান্ধার সাগরঘাটার শামীন মাহফুজ একটি ক্যাডেটে কলেজের মেধাবী ছাত্র ছিলেন। মেধা তালিকায় স্থান করে এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষা পাস করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সমাজবিজ্ঞানে অনার্স-মাস্টার্স শেষ করেন। পরে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি সম্পন্ন করেন। রাইফেলস কলেজের শিক্ষক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করলেও পরে তিনি উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকও ছিলেন। এখান থেকে সবার কাছে তিনি ‘স্যার’ হিসেবে পরিচিত হন। তার স্ত্রীও এই জঙ্গি মতাদর্শে বিশ্বাসী।
সূত্র : বাংলা ট্রিবিউন
এন এ/ ২৭ অক্টোবর