নতুন ইতিহাসের হাতছানি, জিনপিংয়ের হাতেই থাকছে চীন
বেইজিং, ১৫ অক্টোবর – অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির টানা অবনতি, শূন্য কভিড নীতির বাধা, আবাসন খাতে ধস, ইউক্রেন সংকটে রাশিয়ার প্রতি অব্যাহত সমর্থন আর তাইওয়ান ইস্যুতে পশ্চিমা চোখ রাঙানি- সব মিলিয়ে মহা চ্যালেঞ্জ অতিক্রম করছে চীন। এমনই বাস্তবতায় আগামীকাল রাজধানী বেইজিংয়ের তিয়েন আনমেন স্কয়ারের গ্রেট হলে শুরু হচ্ছে সপ্তাহব্যাপী চীনের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিসি) কংগ্রেস। ক্ষমতাসীন দলের ঐতিহাসিক এই সম্মেলন উদ্বোধন করবেন চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং। এটা নিশ্চিত যে, কংগ্রেসে দলের নেতা হিসেবে তৃতীয় মেয়াদে তিনিই জয়ী হবেন। আর এর মাধ্যমে তাঁর হাতেই থাকছে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশটির শাসন, যা মাও সেতুংয়ের পর চীনের সবচেয়ে ক্ষমতাধর শাসক হিসেবে তাঁর অবস্থানকে আরও দৃঢ় করবে। অবশ্য, কংগ্রেস ঘিরে জিনপিংয়ের বিরুদ্ধে বিরল বিক্ষোভ হয়েছে বেইজিংয়ে। তাঁকে আর প্রেসিডেন্ট হিসেবে চান না এমন স্লোগান আর প্ল্যাকার্ড নিয়ে জড়ো হন নাগরিকরা।
কংগ্রেসের শুরুতে দেওয়া ভাষণে জিনপিং আগামী ৫ বছরের জন্য বিশাল পরিকল্পনা ও অগ্রাধিকারের রূপরেখা তুলে ধরবেন। জিনপিংয়ের আরও ৫ বছর ক্ষমতায় থাকার প্রস্তাব অনুমোদন হতে পারে সেখানে। এর মাধ্যমেই চীনের রাজনীতিতে নতুন ইতিহাস তৈরি হবে। ৬৯ বছর বয়সী জিনপিং দীর্ঘ সময়, এমনকি সারাজীবন ক্ষমতায় থাকার পরিকল্পনা করছেন বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। চীন নানামুখী সংকট পার করলেও কূটনীতিক ও অর্থনীতিবিদরা বলছেন, জিনপিং ক্ষমতায় তাঁর অবস্থানকে সুসংহত করতে প্রস্তুত।
কংগ্রেসে অংশ নিচ্ছেন পার্টির প্রায় ২ হাজার ৩০০ প্রতিনিধি। তাঁদের মধ্যে প্রায় ২০০ জন দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য হবেন। আরও ১৭০ জন হবেন বিকল্প সদস্য। কেন্দ্রীয় কমিটি দলের পলিটব্যুরোর ২৫ জন সদস্য নির্বাচন করবে। তারপর পলিটব্যুরোর সদস্যরা পলিটব্যুরোর স্থায়ী কমিটির সদস্যদের নিয়োগ করবেন। তাঁরাই দলের ক্ষমতাধরদের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিনিধি। বর্তমানে পলিটব্যুরো স্থায়ী কমিটির সদস্য সাতজন, যার মধ্যে রয়েছেন দলটির সেক্রেটারি জেনারেল ও প্রেসিডেন্ট জিনপিং নিজেও।
সম্মেলনকে ঘিরে বেইজিংয়ে কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হয়েছে। সেই সঙ্গে জোরদার করা হয়েছে করোনা পরীক্ষা। শুধু তাই নয়, পার্শ্ববর্তী হুবেই প্রদেশের স্টিল মিলগুলোর মাধ্যমে যাতে বায়ুদূষণ না ঘটে, সেটিও নিশ্চিতের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
এক দশক আগে চীনের ক্ষমতায় আসেন জিনপিং। এর পর থেকেই দেশটির রাজনীতিতে অস্বচ্ছতা বেড়েছে। দলের পর্যবেক্ষকদের মূল পদে কাদের রাখা হবে এবং এই নিয়োগের বিষয়ে নানা প্রশ্নও রয়েছে। তবুও দেশের নিরাপত্তা, স্ব্বনির্ভরতা, অর্থনীতিতে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ, দৃঢ় কূটনীতি, শক্তিশালী সামরিক সক্ষমতা এবং তাইওয়ান দখল করাকেই গুরুত্বপূর্ণ মনে করে দেশটির অধিকাংশ মানুষ। ফলে রাজনীতির এসব বিতর্কিত নীতি নিয়ে খুব কম সংখ্যক মানুষই প্রশ্ন তোলেন।
প্রত্যাশা: ২০১৭ সালে দলটির সর্বশেষ কংগ্রেসে জিনপিংয়ের উদ্বোধনী বক্তব্য ব্যাপক আশাব্যঞ্জক ছিল, যাতে ২০৫০ সালের মধ্যে চীনকে একটি শীর্ষস্থানীয় বৈশ্বিক শক্তিতে পরিণত করার উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনা তুলে ধরেন তিনি। প্রায় সাড়ে তিন ঘণ্টার ওই বক্তব্যে তিনি ৭০ বার ‘সংস্কার’ শব্দটির উল্লেখ করেন। কিন্তু তারপর থেকে পরিস্থিতি নাটকীয়ভাবে পরিবর্তন হতে থাকে। করোনার আঘাতসহ নানাভাবে চীনের অর্থনীতি নিম্নমুখী, পশ্চিমাদের সঙ্গে বেইজিংয়ের সংকট তীব্রতর হয়েছে। তবুও এই কংগ্রেস ঘিরে শূন্য-কভিড নীতির কারণে ক্ষতিগ্রস্ত বিনিয়োগকারী ও হতাশ বহু চীনা নাগরিক ঘুরে দাঁড়ানোর আশায় বুক বেঁধেছেন। কিন্তু সেই আশা পূরণ হবে না বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।
তাঁরা বলছেন, অর্থনীতিকে পুনরুজ্জীবিত করার নীতিতে কোনো তাৎক্ষণিক বা নাটকীয় পরিবর্তন আনতে পারে না এই কংগ্রেস। চীনে প্রায় ৫.৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হলেও চলতি বছর প্রবৃদ্ধি হতে পারে ৩ শতাংশের কাছাকাছি। ২০২৩ সালের মার্চ পর্যন্ত করোনার বিধিনিষেধ প্রত্যাহার কিংবা দেশটির আবাসন খাতের যে ধস- সে বিষয়ে উল্লেখযোগ্য কোনো নীতির পরিবর্তন দেখছেন না বিশ্লেষকরা। কারণ, শূন্য-কভিড নীতিতে অটল চীন।
বিরল বিক্ষোভ: এদিকে, শি জিনপিং ও দেশটির করোনার বিধিনিষেধের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করেছেন নাগরিকরা। দেশটিতে এমন বিক্ষোভের ঘটনা বিরল। কংগ্রেসের মাত্র দু’দিন আগে বেইজিংয়ে এই বিক্ষোভ শুরু করলে পুলিশ তাদের সড়ক থেকে সরিয়ে দেয়।
বিবিসির খবরে বলা হয়, কংগ্রেসের আগেই বেইজিংয়ের জনগণের মধ্যে হতাশা বাড়ছে। কারণ, ফের প্রেসিডেন্ট হতে যাচ্ছেন জিনপিং। বিক্ষোভকারীরা বিভিন্ন সড়কে ব্যানার ও প্ল্যাকার্ড হাতে অবস্থান নেওয়ার চেষ্টা করেন। সেই সঙ্গে বেইজিংয়ের বিভিন্ন স্থানে জিনপিংয়ের নিন্দা জানিয়ে টাঙানো হয় ব্যানার। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও অনেকেই প্রতিবাদ জানাচ্ছেন।
আন্দোলনকারীরা এক ব্যানারে লিখেছেন, ‘আমরা আর করোনা টেস্ট চাই না, খেয়েপরে বাঁচতে চাই। আর লকডাউন নয়, আমাদের মুক্তভাবে চলাচল করতে দাও।’ অপর ব্যানারে লেখা হয়, ‘স্বৈরতান্ত্রিক বিশ্বাসঘাতক শি জিনপিংকে উৎখাত করতে আমরা তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তুলব।’
আজীবন ক্ষমতা: প্রেসিডেন্টের মেয়াদ বাড়াতে দলীয় কেন্দ্রীয় কমিটি সংবিধানে পরিবর্তন আনে ২০১৮ সালে। দুই মেয়াদের বেশি চীনের প্রেসিডেন্ট ও ভাইস প্রেসিডেন্ট পদে কেউ থাকতে পারবেন না- এমন একটি ধারা ছিল সংবিধানে। সে সময় সেই ধারা বাতিল করা হয়। এর মাধ্যমে তৃতীয় বা আরও বেশি মেয়াদে জিনপিংয়ের ক্ষমতায় থাকার যে বাধা ছিল, তা তুলে দেওয়া হয়।
সূত্র: সমকাল
এম ইউ/১৫ অক্টোবর ২০২২