এশিয়া

ক্ষমতা গোছাতেই চিনপিংয়ের দুর্নীতিবিরোধী অভিযান

বেইজিং, ১৫ অক্টোবর – একদলীয় শাসনব্যবস্থার দেশ চীনের প্রেসিডেন্ট হিসেবে শি চিনপিং তৃতীয় দফায় দায়িত্ব গ্রহণ করছেন, বিশেষজ্ঞরা এ ব্যাপারে একরকম নিশ্চিত। এ ক্ষেত্রে তারা কমিউনিস্ট পার্টিতে নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখতে চিনপিং দুর্নীতিবিরোধী শুদ্ধি অভিযানকে কিভাবে কাজে লাগিয়েছেন, সেটিকে সূচক হিসেবে দেখছেন। দলীয় সম্মেলনের আগে চিনপিংয়ের সেই সব কর্মকাণ্ড নিয়ে চলছে চুলচেরা বিশ্লেষণ।

কাল রবিবার থেকে শুরু হচ্ছে চীনের ক্ষমতাসীন কমিউনিস্ট পার্টির (সিসিপি) ২০তম সম্মেলন।

সপ্তাহব্যাপী সম্মেলনের আগে গতকাল শুক্রবার ফ্রান্সভিত্তিক সংবাদমাধ্যম এএফপি চিনপিংয়ের শাসনামল নিয়ে একাধিক বিশ্লেষণ প্রকাশ করে। এসবের মধ্যে শি চিনপিংয়ের রাজনৈতিক কৌশল নিয়ে নানামুখী মূল্যায়ন তুলে ধরা হয়।
বিশ্লেষকরা বলছেন, চিনপিং দুর্নীতিবিরোধী ‘শুদ্ধি অভিযানের চূড়ান্ত ধাপ’ বাস্তবায়ন করার মাধ্যমে তার সব প্রতিদ্বন্দ্বী ও প্রতিবন্ধকতা সরিয়ে দিয়েছেন। ২০১২ সালে সিসিপির ১৮তম কংগ্রেসের মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় বসার পর থেকে তিনি এই কাজে সক্রিয় ছিলেন।

এএফপির প্রতিবেদনে বলা হয়, চিনপিং প্রেসিডেন্ট এবং পিপলস লিবারেশন আর্মির (পিএলএ) শীর্ষ কমান্ডার পদে বসার পর এ পর্যন্ত ১৫ লাখেরও বেশি ব্যক্তিকে শাস্তি দেওয়া হয়েছে। সিসিপির শৃঙ্খলা রক্ষা কমিটি এবং জার্মানিভিত্তিক দুর্নীতিবিরোধী সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের তথ্য-উপাত্তে এই চিত্র উঠে এসেছে।

বিশ্লেষকরা দাবি করেছেন, চলতি বছরের শুরু থেকে এ পর্যন্ত প্রায় এক হাজার ১০০ কর্মকর্তাকে দলীয় শাস্তির মুখে পড়তে হয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হলেন জননিরাপত্তাবিষয়ক সাবেক উপমন্ত্রী সান লিজুন এবং সাবেক বিচারমন্ত্রী ফু ঝেংগুয়া। তারা এখন করাবন্দি। বলা হচ্ছে, দলীয় সম্মেলনকে সামনে রেখে এসব কাজ করা হয়েছে।

অবশ্য হংকংয়ে চীনা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনৈতিক বিশ্লেষক উইলি লাম বলেন, আবারও নেতৃত্ব ধরে রাখার নিশ্চয়তা সত্ত্বেও চিনপিং সম্ভবত দলে সিদ্ধান্ত গ্রহণের নিয়ন্ত্রণ প্রশ্নে বিভ্রান্ত হয়ে রয়েছেন। এ জন্য চিনপিং নতুন মেয়াদে আরো কঠোর হতে পারেন।

বিশ্লেষকরা জানান, দলের ওপর নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখতে এবং নীতি নির্ধারণে নিজের প্রভাব ধরে রাখতে কাছের মানুষকেও ছাড় দেননি চিনপিং। এর মধ্যে অন্যতম হলেন সান লিজুন। তিনি ২০১৯ সালে হংকংয়ের গণতন্ত্রপন্থী আন্দোলন সামাল দেওয়ার দায়িত্ব পালন করেন। তিনি উহানে করোনাভাইরাস মহামারির শুরুর দিনগুলোতে গুরুদায়িত্ব সামলেছেন। সেই লিজুনের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষের কারণে ‘দলের ঐক্য মারাত্মকভাবে বিনষ্টের’ অভিযোগ আনা হয়েছে। তিনিসহ ফু এবং সাবেক তিন পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ঘুষ নেওয়ার অভিযোগও ছিল।

ওয়াশিংটনভিত্তিক স্টিমসন সেন্টারের চীনা কর্মসূচির পরিচালক ইয়ুন সান বলেন, ‘সান লিজুনের ঘটনাটি নিরাপত্তাব্যবস্থার ওপর চিনপিংয়ের নিয়ন্ত্রণের সঙ্গে সম্পর্কিত, যা তার রাজনৈতিক এজেন্ডার জন্য অপরিহার্য ছিল। ’ স্টিমসন দাবি করেন, এর মাধ্যমে চিনপিংয়ের বিরোধীদের প্রতি একটি কঠোর বার্তা দেওয়া হয়েছে।

চিনপিং যে শুধু কর্তৃত্ব ও প্রভাব তৈরি করেছেন, এমন নয়। বরং তিনি আদর্শিকভাবেও নিজেকে অন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছেন বলে মনে করেন পর্যবেক্ষকরা। চীনা বিপ্লবের নেতা মাও জেদংয়ের পর তিনিই একমাত্র নেতা, যিনি নিজের ব্যক্তিগত ভাবমূর্তিকে সবচেয়ে শক্ত জায়গায় নিয়ে গেছেন। এর জেরে বর্তমানে চীনের ১০ বছরের কম বয়সী শিশুদের জন্য ‘শি চিনপিংয়ের চিন্তাধারা’ অধ্যয়ন বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।

সিঙ্গাপুরের ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির চীনা রাজনীতি বিশেষজ্ঞ উ মুলুয়ান বলেন, দুর্নীতিবিরোধী অভিযানকে ব্যবহার করে চিনপিং কমিউনিস্ট পার্টিকে ‘রাষ্ট্রীয় একনায়কত্ব থেকে ব্যক্তিকেন্দ্রিক একনায়কত্বের দিকে নিয়ে গেছেন। ’

এ ছাড়া বিশ্লেষকরা বলছেন, চিনপিং মূলত দলের তিনটি ক্ষমতাকেন্দ্রে নিজের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে অবস্থান দৃঢ় করেছেন। সেগুলো হলো সামরিক বাহিনী, প্রচারব্যবস্থা (প্রপাগান্ডা মেশিন) এবং অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা কাঠামো।

সিসিপির দলীয় অবস্থা তুলে ধরে পর্যবেক্ষকরা বলেন, সিসিপি বিভিন্ন উপদলীয় গোষ্ঠীতে বিভক্ত থাকা সত্ত্বেও ঐক্যের মুখোশ বজায় রাখে। এ বিষয়ে কানাডার মন্ট্রিলভিত্তিক সার্সিয়াস গ্রুপের প্রধান নির্বাহী অ্যালেক্স পায়েট্টি বলেন, ‘চিনপিংবিরোধী অনেকেই রয়েছেন, যাঁরা দলের অনুগত। চিনপিংয়ের অধীন দল যা করছে, তা তারা পছন্দ করেন না। ’

তবে এ বিষয়ে পর্যবেক্ষকরা বলেন, আসন্ন সম্মেলনে দলের সর্বোচ্চ ক্ষমতাধর সাত সদস্যবিশিষ্ট পলিটব্যুরোতে মিত্রদের পদোন্নতি দিয়ে নিজেকে সুবিধাজনক অবস্থায় নিতে পারেন চিনপিং।

সূত্র: কালের কন্ঠ
আইএ/ ১৫ অক্টোবর ২০২২

Back to top button