জাতীয়

বৈধ বারে অবৈধ চাঁদাবাজির সুযোগ চায় সবাই

আমানুর রহমান রনি

ঢাকা, ১০ অক্টোবর – মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের মহাপরিচালকের প্রতিনিধি বা অনুমতি ছাড়া দেশের অনুমোদিত কোনও বারে পুলিশ বা অন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এককভাবে অভিযান পরিচালনার আইনগত বৈধতা নেই। লাইসেন্সকৃত বারে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের অনুমতি ও প্রতিনিধি থাকা সাপেক্ষে যেকোনও সংস্থা অভিযান পরিচালনা করবে। কিন্তু রাজধানীর উত্তরায় ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) সেই নিয়ম ভঙ্গ করে অভিযান পরিচালনা করেছে বলে অভিযোগ উঠেছে।

এর পেছনে অন্য কোনও কারণ রয়েছে বলে মনে করছে বার মালিকদের সংগঠন ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর। পুলিশ ছাড়াও প্রায়ই আরও চারটি সংস্থা দেশের অনুমোদিত বারে হুটহাট অভিযান পরিচালনা করার নামে হয়রানি করে বলেও অভিযোগ উঠেছে। কাগজপত্র ঠিকঠাক থাকলেও এসব সংস্থা বিভিন্ন অজুহাতে ভয়ভীতি দেখায়। যা তারা বছরের পর বছর সহ্য করে যাচ্ছেন। তারা শিগগিরই এবিষয়ে সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।

অভিযানের সময় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের একজন কর্মকর্তাকে একটি কক্ষে আটকে রাখা নিয়ে ডিবির বিরুদ্ধে অপেশাদার আচরণের অভিযোগ যাচ্ছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে।

বৃহস্পতিবার (৭ অক্টোবর) রাত ৯টা থেকে ভোর রাত পর্যন্ত রাজধানীর উত্তরার ১৩ নম্বর সেক্টরের গরিবে নেওয়াজ অ্যাভিনিউয়ের ‘লেক ভিউ রেস্টুরেন্ট ও বার’-এ অভিযান চালায় ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। অবশ্য অভিযানের সময় পুলিশ ওই বারের নাম বলেছে ‘কিংফিশার।’ তবে কাগজপত্রে দেখা গেছে, সেটি একটি রেস্টুরেন্ট ও বার। যার নাম ‘লেকভিউ রেস্টুরেন্ট ও বার’। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর থেকে ২০১৮ সালে প্রতিষ্ঠানটি বার পরিচালনার লাইসেন্স পায়। ভবনের পঞ্চম ও ষষ্ঠ তলার অনুমোদন নেওয়া আছে। মালিক মুক্তার হোসেন।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন ২০১৮ এর ২০ থেকে ২৩ ধারা পর্যন্ত বারে অভিযানের বিষয়ে বলা রয়েছে। ২০ ধারায় বারে প্রবেশ ও ইত্যাদি ক্ষমতা প্রদান করা হয়েছে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের (ডিএনসি) মহাপরিচালককে। এই ধারায় বলা হয়েছে, অনুমোদিত বারে মহাপরিচালক বা তার নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা প্রবেশ, জব্দ ও তল্লাশি করতে পারবে। তবে অন্য কোনও বাহিনীর কথা বলা নেই।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বারের অনুমোদন বা লাইসেন্স মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর দেয়, তারাই এর দেখভাল করেন। বারে কোনও সংস্থা বা বাহিনী অভিযান পরিচালনা করতে হলে অবশ্যই মহাপরিচালকের প্রতিনিধিদের সঙ্গে রাখতে হবে।

তবে উত্তরায় ডিবির ওই অভিযানে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণের কাউকে জানায়নি পুলিশ। মহাপরিচালকের কোনও প্রতিনিধিও ছিলেন না। উল্টো অভিযানের বিষয়ে খবর পেয়ে অফিসের নির্দেশে সেখানে যান মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের উত্তরা এলাকার পরিদর্শক মাহবুবুর রহমান। তিনি অভিযোগ করেন, ‘আমাকে ডিবি পুলিশ একটি কক্ষে আটকে রেখে অপেশাদার আচরণ করে।’

স্থানীয় মাস্তান, বিভিন্ন সংস্থার চাঁদাবাজিতে অতিষ্ঠ হয়ে ২০১৮ সালে রেস্টুরেন্ট ও বার মালিকরা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের মহাপরিচালকের সঙ্গে দেখা করেন। তাদের বিভিন্ন সংকটের কথা জানান। এরপর অধিদফতরের মহাপরিচালক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছ থেকে পরামর্শ নিয়ে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনের আলোকে ২০১৮ সালের ২৭ ডিসেম্বর একটি সার্কুলার জারি করে। সেই সার্কুলারে তিনি উল্লেখ করে দেন, দেশের বারগুলোতে কারা কীভাবে অভিযান পরিচালনা করতে পারবেন। এই সার্কুলার দেশের সকল পুলিশ সুপার, ডিআইজি অফিস, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়, বিভাগীয় কমিশনারের অফিস ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ ২৭ টি প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিদের দেওয়া হয়। সেখানেই অভিযানের বিষয় স্পষ্ট বলা হয়েছে। সেই সার্কুলার অমান্য করে ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন লঙ্ঘন করে উত্তরার লেকভিউ রেস্টুরেন্ট ও বারে অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে।

রবিবার (৯ অক্টোবর) রাতে ঢাকার দুটি বারের মালিকের সঙ্গে কথা হয়। তিনি বলেন, ‘আমরা ব্যবসা করি সকল অনুমোদন নিয়ে। একটি বারের অনুমোদন চাইলেই পাওয়া যায় না। এজন্য বছরের পর বছর বিভিন্ন দফতরে ঘুরতে হয়। তারপর লাইসেন্স মিলে। কিন্তু বার দেওয়ার পর স্থানীয় মাস্তান, রাজনৈতিক ব্যক্তি, বিভিন্ন সংস্থার লোকজন আমাদের অন্যায়ভাবে ডিস্টার্ব করে। সমাজে আমাদের হেয় করা হয়। এই চাঁদা, সেই চাঁদা চাইতেই থাকে। আমরা কী চুরি করে এনে টাকা দিবো? উপায় না পেয়ে আমরা মালিকরা একটি সংগঠন দাঁড় করিয়েছি। আমরা শিগগিরই এবিষয়ে সরকারের উচ্চমহলে জানাবো।’

তিনি বলেন, ‘বারে কী কী মদ রয়েছে, কী কী রাখা যাবে না—এ বিষয়ে দেখভালের নির্দিষ্ট লোক রয়েছে। সরকারি অধিদফতর রয়েছে। তাদের কাছে আমরা নিয়মিত জবাবদিহি করি। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর আমাদের জবাবদিহির জায়গা তারপরও কেন অন্য সংস্থা এসে আমাদের ডিস্টার্ব করবে। এর একটি সুরহা প্রয়োজন। আমরাতো ভ্যাট-ট্যাক্স দিয়ে ব্যবসা করি। যাদের মদপানের অনুমতি নেই, তাদের কাছে আমরা বিক্রি করি, বিদেশি মদ রাখি, এসব অভিযোগ আমাদের বিরুদ্ধে করা হয়, এই সমস্যা কীভাবে সমাধান করতে হবে, তা সবাই মিলে বের করতে হবে। তাই বলে কেউ চাঁদা দাবি করতে পারেন না।’

ডিবি ওই অভিযানে বারের ম্যানেজারসহ ৩৫ জনকে গ্রেফতার করেছে। লেকভিউ রেস্টুরেন্ট ও বারের মালিক মুক্তার হোসেন জানান, তাদের কোনও ত্রুটি থাকলে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন আমাদের ধরুক। কিন্তু এভাবে বারে ঢুকে সবাইকে বেধে নিয়ে যাবে, তাহলে তারা ব্যবসা করবেন কীভাবে?

উত্তরার ওই বারে অভিযান পরিচালনার পক্ষে রবিবার (৯ অক্টোবর) সাংবাদিকদের কাছে যুক্তি তুলে ধরেন ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা বিভাগের অতিরিক্ত কমিশনার হারুন অর রশিদ। তিনি বলেন, ‘অসামাজিক কার্যকলাপ, অবৈধভাবে মদ বিক্রি বা যেকোনও ঘটনা ঘটলে পুলিশ যেকোনও জায়গায় অভিযান পরিচালনা করতে পারে। পুলিশ মাদকদ্রব্য উদ্ধার করতে পারে কিনা বা মাদকের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করতে পারে কিনা তা আপনারা সাংবাদিকরা ভালো জানেন। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনের ২৩ ধারায় স্পষ্ট বলা আছে কারা তল্লাশি করবেন বা করবেন না।’

এরআগে ২০২১ সালের ১৮ মার্চ জুরাইনের আইরিস পাব অ্যান্ড রেস্টুরেন্টে র‍্যাব ও কাস্টমস যৌথভাবে রেইড দিয়ে তল্লাশি চালায়। এই রেইড চ্যালেঞ্জ করে ওই বছরের ২০ সেপ্টেম্বর উচ্চ আদালতে তারা একটি রিট মামলা করেন। ওই মামলায় তারা দাবি করেন, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনের ২৩ ধারা লঙ্ঘন করে তাদের রেস্টুরেন্টে অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে। এরপর উচ্চ আদালত ওই অভিযানকে অবৈধ ঘোষণা করে নির্দেশনাও দেন।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনের ২৩ ধারায় স্পষ্ট বলা রয়েছে, ‘পরোয়ানা ব্যতিরেকে তল্লাশি, ইত্যাদির ক্ষমতা: মহাপরিচালক অথবা তাহার নিকট থেকে এতদুদ্দেশ্যে সাধারণ অথবা বিশেষভাবে ক্ষমতাপ্রাপ্ত কোনও অফিসার, অথবা পুলিশের উপপরিদর্শক, অথবা তদূর্ধ্ব কোনও অফিসার অথবা বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের ল্যান্স নায়েক অথবা তদূর্ধ্ব কোনও অফিসার, অথবা কোস্ট গার্ড বাহিনীর পেটি অফিসার অথবা তদূর্ধ্ব কোনও অফিসার অভিযান পরিচালনা করতে পারবেন।’

তবে উত্তরায় বারে অভিযানের সময় ডিবি মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের মহাপরিচালকের কাছ থেকে এমন কোনও ক্ষমতা নেয়নি।

পরিদর্শক মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘আমরা খবর পেয়ে সেখানে অফিসের আদেশে গিয়েছি। কিন্তু ডিবি আমাদের সঙ্গে কোনও যোগাযোগ করেনি। উল্টো অভিযানের সময় আমাকে আটকে রাখে।’

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর জানিয়েছে, সারাদেশে ১৮৯টি রেস্টুরেন্ট ও বার রয়েছে। এর সকল লাইসেন্স প্রদান, নবায়ন ও মজুত দেখভাল করে এই সংস্থাটি।

বারে মদপানের অনুমতিও দিয়ে থাকে অধিদফতর। তবে অভিযোগ রয়েছে বারগুলোতে মদপানের লাইসেন্স ছাড়া লোকজন বেশি যাওয়া-আসা করে। এসব ফাঁক-ফোকরের কারণেই বিভিন্ন সংস্থা চাঁদাবাজির সুযোগ পায়। নিয়মিত মাসোহারা নিয়ে থাকে।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ রেস্টুরেন্ট ও বার মালিক সমিতির যুগ্ম-আহ্বায়ক জাহিদ আজাদ শ্যামল বলেন, ‘আমরা সবসময় একটা নিয়মের মধ্যে ব্যবসা করে থাকি। আমারা সরকারকে রাজস্ব দেই। তারপরও আমাদের বিভিন্নভাবে হেয় করা হয়, যা কাক্ষিত না। আমরা সমস্যা ও সংকট নিয়ে শিগগিরই একটি মিটিং ডাকবো। সকল বার ও রেস্টুরেন্টগুলোকে একটি ছাতার নিচে আনার চেষ্টা করছি।’

এদিকে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের কর্মকর্তার সঙ্গে ডিবি পুলিশের অপেশাদার আচরণের বিষয়ে সোমবার (১০ অক্টোবর) স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে লিখিত অভিযোগ দিবে সংস্থাটি। সংস্থার কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা পুলিশের এমন আচরণে ক্ষুব্ধ।

সূত্র: বাংলা ট্রিবিউন
আইএ/ ১০ অক্টোবর ২০২২

Back to top button