ঢাকা, ০৯ অক্টোবর – প্রতিষ্ঠার পর বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির আকার বেড়েছে ছয়গুণের বেশি। কাগজে-কলমে দলটিতে নেতার সংখ্যা বাড়লেও নেতৃত্বের বিকাশ তেমন হয়নি। এতে শুরুর দিকে দলের কেন্দ্রীয় কমিটির নেতাদের যে সম্মান ও গুরুত্ব ছিল তা এখন আর নেই। ঢাউস কমিটি করায় গুরত্ব হারাচ্ছে নির্বাহী কমিটি। প্রতিষ্ঠাকালীন দলটির নির্বাহী কমিটির সদস্য ছিল মাত্র ৭৬। বর্তমানে এ সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫০২। বিগত দুটি নির্বাহী কমিটিতে নেতার সংখ্যা অস্বাভাবিকভাবে বাড়ানো হয়। তবে বেশিরভাগ নেতাই দলীয় কর্মকাণ্ডে নিষ্ক্রিয়। পদ নিয়েই ব্যক্তিগত ব্যবসায় ব্যস্ত তারা। যোগ্য ও অনুগতদের পরিবর্তে জায়গা পাচ্ছেন সুবিধাবাদী ও সুযোগসন্ধানীরা। বিএনপির বিভিন্ন স্তরের নেতাদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে এসব তথ্য।
দলটির একাধিক সিনিয়র নেতা বলেন, প্রতিষ্ঠার পর আশি কিংবা নব্বই দশকেও নির্বাহী কমিটির ঐতিহ্য ও গুরুত্ব ছিল। দলের সিনিয়র, যোগ্য এবং জাতীয়ভাবে পরিচিত এমন নেতাদেরই নির্বাহী কমিটিতে জায়গা দেওয়া হতো। ছাত্রদল কিংবা অঙ্গসংগঠনের শীর্ষ দায়িত্বে রয়েছে কিংবা দায়িত্ব শেষ হওয়ার পরপরই নির্বাহী কমিটিতে জায়গা পাওয়ার সুযোগ ছিল না। কিন্তু সেই ধারা থেকে বেরিয়ে এসেছে দলটি। বিগত দুটি কাউন্সিলের পর ঘোষণা করা হয় বিশাল আকারের নির্বাহী কমিটি। ছাত্রদলের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক থাকাবস্থায় তারা নির্বাহী কমিটির সদস্য হন। বর্তমান গঠনতন্ত্রে নির্বাহী কমিটির সংখ্যা ৪৭০। তবে চেয়ারপারসন তার ক্ষমতাবলে এ সংখ্যা ১০ শতাংশ বাড়াতে পারেন। এ ধারাকে কাজে লাগিয়ে ২০১৬ সালের সবশেষ কাউন্সিলের পর ৫০২ সদস্যের নির্বাহী কমিটি ঘোষণা করা হয়। কমিটি ঘোষণার পরও অনেককে নির্বাহী কমিটির সদস্য হিসাবে কো-অপ্ট করা হয়েছে। সবশেষ ছাত্রদলের সদ্য বিদায়ি সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে নির্বাহী কমিটির সদস্য করা হয়। এ নিয়ে দলের নেতাকর্মীদের মধ্যে ক্ষোভ ও হতাশা সৃষ্টি হয়েছে। এত কম বয়সে নির্বাহী কমিটির সদস্য করা নিয়েও উঠেছে নানা সমালোচনা।
কাউন্সিল ছাড়াও চেয়ারপারসনের একক ক্ষমতাবলে মহাসচিবসহ দলের গুরুত্বপূর্ণ পদে সংযোজন ও বিয়োজনের ঘটনাও ঘটেছে। এরশাদবিরোধী আন্দোলনে ১৯৮৫ সালে হঠাৎ করেই দলের মহাসচিব থেকে সরিয়ে দেওয়া হয় প্রতিষ্ঠাকালীন মহাসচিব অধ্যাপক একিউএম বদরুদ্দোজা চৌধুরীকে। এ পদে নিয়োগ দেওয়া হয় কর্নেল (অব.) মোস্তাফিজুর রহমানকে। এক বছর দায়িত্ব পালন শেষে তাকে সরিয়ে মহাসচিব করা হয় কেএম ওবায়দুর রহমানকে। তিনি ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত মহাসচিবের দায়িত্ব পালন করেন। কাউন্সিল ছাড়াই মহাসচিব পদে এ রদবদল করা হয়েছিল। দলটি প্রতিষ্ঠার পর থেকে নির্বাহী কমিটির সদস্য সংখ্যা পর্যায়ক্রমে বাড়ানো হয়।
জানতে চাইলে রাজনৈতিক বিশ্লেষক সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, দেশে রাজনীতি বলতে কিছু নেই। চলছে পরিবারতন্ত্র। তারাই নেতৃত্ব তৈরি করে আবার পছন্দ না হলে দূরে ঠেলে দেয়। ফলে সৎ ও যোগ্যরা বাদ পড়ছেন। এতে নেতৃত্বের বিকাশ হচ্ছে না।
তিনি বলেন, দলগুলোতে গণতন্ত্র, আদর্শ, নীতি বলতে কিছু নেই। ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য রাজনীতি করে। রাজনীতিটা অনেকটা সিন্ডিকেটের মতো হয়ে গেছে। টাকা নিয়ে মনোনয়ন দিচ্ছে। ক্ষমতায় গেলে নানা অনিয়ম করে সেই টাকা আবার সুদ-আসলে উঠিয়ে নিচ্ছে। যেমন বিএনপি তেমনি আওয়ামী লীগ।
প্রতিষ্ঠাকালীন নেতাদের মধ্যে হাতেগোনা কয়েকজন বর্তমানে বিএনপির রাজনীতিতে যুক্ত আছেন। তাদের মধ্যে একজন ব্যারিস্টার জমিরউদ্দিন সরকার। প্রতিষ্ঠাকালীন আহ্বায়ক কমিটির সদস্য ছিলেন তিনি। বর্তমানে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য। জানতে চাইলে প্রবীণ এ রাজনীতিবিদ বলেন, কিছু নেতাকে দলে জায়গা দেওয়ার জন্যই কমিটির আকার বড় করা হয়। যারা দীর্ঘদিন দলের রাজনীতি করছে তাদের ধরে রাখতে। কিন্তু দলের কাজ কিছু লোকেই করে থাকে। কমিটিতে নেতা বাড়িয়ে মনে হয় না কিছু লাভ হয়। এতে দলের আর্থিক সংকট হয়তো কিছুটা কমে কিন্তু রাজনৈতিক সংকট দূর করা সম্ভব নয়। বর্তমানে নির্বাহী কমিটির ৪০ শতাংশ নেতা ঠিকমতো কাজ করলেই অনেক কিছু করা সম্ভব। শুধু দলের প্রতি নিবেদিত থাকলে হবে না তা কাজে প্রমাণ করতে হবে বলে মনে করেন তিনি।
অধ্যাপক একিউএম বদরুদ্দোজা চৌধুরী বিএনপির প্রতিষ্ঠাকালীন মহাসচিব ছিলেন। বিএনপি ছেড়েছেন অনেক আগেই। বর্তমানে বিকল্পধারা বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট। বিএনপির শুরু থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত সাংগঠনিক নেতৃত্বের বিষয়ে তার কাছে জানতে চাইলে বিস্তারিত বলতে চাননি। তবে তিনি বলেন, সময়ের সঙ্গে রাজনৈতিক পরিস্থিতিও পরিবর্তন হয়। আমরা যখন বিএনপির প্রতিষ্ঠাকালীন সময়ে ছিলাম সেই পরিস্থিতি এখন নেই। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে খাপ খাইয়ে হিসাব করে রাজনীতি করতে হবে।
বিএনপির ওয়েবসাইট, বিভিন্ন স্তরের নেতাকর্মী ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, ঢাকার রমনা বটমূলের খোলা চত্বরে ১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর ‘বাংলাদেশ জাতীয়তাবদী দল (বিএনপি)’ নামে নতুন রাজনৈতিক দল প্রতিষ্ঠা করা হয়।। শুরুর দিন ১৮ সদস্যের আহ্বায়ক কমিটি গঠন করা হয়। পরে ৭৬ সদস্যের নির্বাহী কমিটি করা হয়। ১৯৮২ সালে দলের দ্বিতীয় কাউন্সিল হয়। ১৯৮৯ সালের ৮ ও ৯ মার্চ তৃতীয়, ১৯৯৩ সালের সেপ্টেম্বরে চতুর্থ, ২০০৮ সালের ৯ ডিসেম্বর পঞ্চম ও ২০১৬ সালের ১৯ মার্চ ষষ্ঠ কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয়। তৃতীয় কাউন্সিলে নির্বাহী কমিটির সদস্য সংখ্যা বাড়িয়ে ১৫১ করা হয়। ৯৬ সালে তা বাড়িয়ে করা হয় ১৭১। পঞ্চম কাউন্সিলের পর নির্বাহী কমিটির আকার বাড়িয়ে করা হয়েছিল ২৫১। ষষ্ঠ কাউন্সিলে এক লাফে তা দ্বিগুণ বাড়িয়ে ৫০২ সদস্যের নির্বাহী কমিটি ঘোষণা করা হয়।
সবশেষ কাউন্সিলে নির্বাহী কমিটির ভাইস চেয়ারম্যানসহ বেশকিছু পদের সংখ্যা বাড়ানো হয়। সৃষ্টি করা হয় নতুন পদ। স্থায়ী কমিটির সংখ্যা ১৫ থেকে বাড়িয়ে করা হয়েছে ১৯। শুরুতে দলে মাত্র পাঁচজন ভাইস চেয়ারম্যান ছিলেন। এ সংখ্যা এখন ৩৫। আগের গঠনতন্ত্রে চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা পরিষদের সংখ্যা ১৫ থাকলেও ষষ্ঠ কাউন্সিলে তা উঠিয়ে দেওয়া হয়। এতে বলা হয়, চেয়ারপারসনকে বিভিন্ন্নভাবে সহায়তার জন্য একটি উপদেষ্টা কাউন্সিল থাকবে। তারা চেয়ারপারসন কর্তৃক মনোনীত হবেন। ষষ্ঠ কাউন্সিলের পর ৭৩ সদস্যের উপদেষ্টা কাউন্সিলের নাম ঘোষণা করা হয়। ষষ্ঠ কাউন্সিলেই গঠনতন্ত্রে সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান পদ পুনরায় সংযোজন করা হয়।
সবশেষ কাউন্সিলে গঠনতন্ত্রে আরও বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আনা হয়। নির্বাহী কমিটির সম্পাদকীয়সহ চেয়ারপারসনের বিশেষ সহকারীর নতুন পদ সৃষ্টি করা হয়। এক নেতারা এক পদ-বিশেষ এ বিধানটিও গঠনতন্ত্রে সংযোজন করা হয়। নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয় সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যানের কর্তব্য, ক্ষমতা ও দায়িত্ব।
ষষ্ঠ কাউন্সিলে বিলুপ্ত করা হয় গঠনতন্ত্রের ৭ ধারা। এ ধারায় বলা হয়েছিল, ‘১৯৭২ সালের রাষ্ট্রপতির আদেশ নং ৬ এর বলে দণ্ডিত ব্যক্তি, দেউলিয়া, উন্মাদ বলে প্রমাণিত ব্যক্তি ও সমাজে দুর্নীতিপরায়ণ বা কুখ্যাত বলে পরিচিত ব্যক্তি নির্বাহী কমিটি সদস্য পদের কিংবা জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলের প্রার্থী পদের অযোগ্য বলে বিবেচিত হবেন।’ দলটির একাধিক নেতা জানান, গঠনতন্ত্রের এ ধারা বলে বিএনপির অনেক নেতাকে নির্বাচনে অযোগ্য কিংবা দলের গুরুত্বপূর্ণ পদ নিয়ে কেউ চ্যালেঞ্জ জানাতে পারেন। নির্বাচন কমিশন কিংবা আদালতে যাওয়ার সুযোগও নিতে পারেন কেউ কেউ। বিশেষ করে চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানসহ সিনিয়র নেতাদের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক মামলা হওয়ায় এ আশঙ্কা তৈরি হয়। তাই কেউ যাতে এ সুযোগ নিতে না পারে সেজন্যই এ ধারা বিলুপ্ত করা হয়।
সূত্র: যুগান্তর
এম ইউ/০৯ অক্টোবর ২০২২