অপরাধ

নামে ম্যানেজিং কমিটি কাজে দলাদলি বাণিজ্য

এম এইচ রবিন

ঢাকা, ৭ অক্টোবর – একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পরিচালনায় (ম্যানেজিং কমিটি) যারা থাকেন, তাদের হাতেই প্রতিষ্ঠানটির মানোন্নয়ন হওয়ার কথা। কিন্তু প্রায়ই দেখা যায়, প্রতিষ্ঠানের মানোন্নয়নের চেয়ে নিজেদের উন্নয়নেই কমিটির সদস্যরা বেশি ব্যস্ত থাকছেন। তারা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রভাব বিস্তার, স্বজনপ্রীতি, দলীয় প্রীতি, ভর্তি বাণিজ্য, নিয়োগ বাণিজ্য, কেনাকাটার অর্থ আত্মসাৎসহ নানা স্বার্থে জড়িয়ে পড়ছেন। এ বিষয়ে বিশিষ্টজনদের পরামর্শ হলো, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মানোন্নয়নে পরিচালনা কমিটিতে অবশ্যই রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত যোগ্য ও সৎ লোকদের জায়গা দিতে হবে।

সম্প্রতি রাজধানীর মিরপুর এলাকার মনিপুর উচ্চবিদ্যালয় ও কলেজে নানা অনিয়মের অভিযোগ ওঠে। এসব অভিযোগ নিয়ে ঢাকা শিক্ষা বোর্ড এবং মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরে (মাউশি) চিঠি চালাচালিও হয়। মূল অভিযোগ হলো, একটি গোষ্ঠী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি ‘ইচ্ছামতো’ নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছে। ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের তদন্তে উঠে আসে, পরিচালনা পর্ষদ নিয়ম ভেঙে ৬০ বছর বয়স হওয়ার পরও ফরহাদ হোসেনের (অধ্যক্ষ) চাকরির মেয়াদ বাড়িয়েছে (চুক্তিতে)। এর পেছনে পরিচালনা কমিটির দুরভিসন্ধি থাকার অভিযোগ রয়েছে অভিভাবকদের।

বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটিতে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ নিয়োগের ব্যবস্থা নিতে মাউশিকে চিঠি দিয়েছে ঢাকা মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড। এতে বলা হয়, গত বছরের ২৩ মে থেকে মনিপুর উচ্চবিদ্যালয় ও কলেজে পরিচালনা কমিটি নেই।

এর মধ্যেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে খবর আসে, গত ২৮ সেপ্টেম্বর প্রতিষ্ঠানের সিনিয়র প্রভাষক (ইংরেজি) মো. মুস্তাফিজুর ইসলামকে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব দিয়েছে এডহক ম্যানেজিং কমিটি। কমিটির সভাপতি অধ্যাপক রাশেদা আক্তার স্বাক্ষরিত ওই অফিস আদেশ নিয়ে অভিভাবক ও শিক্ষকদের মধ্যে আলোচনা-সমালোচনা চলছে। তারা বলছেন, প্রতিষ্ঠানের যে কমিটিকে সরকার স্বীকৃতি দেয়নি, ওই কমিটি কীভাবে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ নিয়োগ করে? জানা গেছে, ইতোমধ্যে ঢাকা শিক্ষা বোর্ড ওই প্রতিষ্ঠানের নতুন কমিটি করারও নির্দেশনা দিয়েছে।

মনিপুর স্কুল অ্যান্ড কলেজের মতোই বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে অযাচিত খবরদারির দায়িত্ব পরিচালনা পর্ষদের হাতে। সরকারি অর্থে প্রতিষ্ঠানের সবকিছু চললেও সরকারের হাতে প্রতিষ্ঠানের খরবদারি থাকে না।

জানা গেছে, বেসরকারি এমপিওভুক্ত স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা-কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতাসহ প্রায় সব ধরনের খরচই সরকার বহন করে। শিক্ষার্থীদের বই থেকে শুরু করে প্রতিষ্ঠানের চেয়ার-টেবিল, বেঞ্চসহ সব আসবাবপত্র, বিভিন্ন শিক্ষা উপকরণ, নতুন ভবন তৈরি, ভবন সংস্কার, শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ ব্যয় ইত্যাদি সরকার দেয়। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বরাদ্দের বড় অংশটিই ব্যয় হয় এসব খাতে। অথচ এসব প্রতিষ্ঠানের তদারকি করে বেসরকারি পরিচালনা পর্ষদ/কমিটি। এরা রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে নানাবিধ অনিয়ম দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ে। তাদের প্রভাবে শিক্ষকরাও নাজেহাল হন। তাদের নানা কার্যক্রমে প্রশ্নবিদ্ধ হয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।

শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এক সময়ে যখন সরকার পুরো বেতন-ভাতা দিত না, তখন শিক্ষকদের বেতনের টাকা সংগ্রহ করে দেওয়ার জন্য কমিটির দরকার ছিল। সমাজের বিদ্যোৎসাহীরা স্কুলের কমিটিতে থাকতেন। এখন সেই মহৎ উদ্দেশ্যে কেউ কমিটিতে আসেন না। তারা অনেকটাই স্বার্থ হাসিলের জন্যই যুক্ত হন। এদের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ হওয়ায় প্রতিষ্ঠানে তাদের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

এ প্রসঙ্গে শিক্ষাবিদ ইমেরিটাস প্রফেসর সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, কমিটি বদলিয়ে কিছু হবে না। আসলে, সমাজটাকে বদলাতে হবে। সমাজে যেটা হচ্ছে, শিক্ষিত লোকেরা বেশি দুর্নীতি করে। একজন উচ্চশিক্ষিত উপাচার্যের বিরুদ্ধেও দুর্নীতির খবর প্রকাশ হচ্ছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কমিটিতে যোগ্য সৎ লোকদের সম্পৃক্তির বিষয়টির প্রতি সরকারের নজর দিতে হবে।

শিক্ষাবিদ অধ্যাপক মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, আলোচনা-সমালোচনা ঊর্ধ্বে রেখে কমিটিতে সংস্কার আনা উচিত। তবে যে কারণে কমিটিগুলো সমালোচিত, তা থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত সৎ যোগ্য শিক্ষিত ব্যক্তিকে মনোনীতি করা দরকার।

নিয়মানুযায়ী, স্কুলগুলোর দেখভাল করার দায়িত্ব শিক্ষা বোর্ডের। বোর্ডের কর্মকর্তারা জানান, পাবলিক পরীক্ষা নিয়ে তাদের যতটা সময় ব্যয় হয়, তার চেয়ে বেশি ব্যস্ত থাকতে হয় বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজিং কমিটি বা গভর্নিং বডির মনোনয়ন দেওয়া কিংবা বাতিল করার কাজে। কমিটি কেন্দ্র করে হাজার হাজার মামলা থাকে। এ সবের পেছনে বোর্ডের অযথা সময় ব্যয় হয়। বরং এ কমিটির পরিবর্তে সরকারের উপজেলা পর্যায়ের শিক্ষা প্রশাসনের কর্মকর্তাদের সমন্বয় কমিটি করে দিলে অনেকটা শৃঙ্খলা আসবে বলে মনে করেন তারা।

এ প্রসঙ্গে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের শীর্ষ পর্যায়ের দুজন কর্মকর্তা বলেন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এ ধরনের কমিটির কোনো প্রয়োজন নেই। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এসব প্রতিষ্ঠান পরিচালনার সক্ষমতা আছে। ম্যানেজিং কমিটি-গভর্নিং বডির কারণে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে নানামুখী ঝামেলা পোহাতে হচ্ছে।

শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে ভুয়া বিল ভাউচার দিয়ে বিভিন্ন নামে টাকা লুটপাট করে তহবিল শূন্য করার বহু উদাহরণ রয়েছে। সংস্কারের কোনো কাজ না করেই টাকা তুলে নিয়ে যাওয়ার ঘটনাও কম নয়। স্কুল কমিটির একজন সদস্যের সঙ্গে বেইলি রোডের একটি স্বনামধন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষের ফোনালাপ ফাঁস নিয়ে তোলপাড় সৃষ্টি হয়। এ প্রতিষ্ঠানের সাবেক অধ্যক্ষ থাকাকালীন গভর্নিং বডি বিভিন্ন কাজের নামে বেআইনিভাবে অর্থ নিয়েছেন। বিষয়টি তদন্ত করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তর (ডিআইএ)। ডিআইএর এ রকম অন্তত ৩০টি তদন্ত রিপোর্ট পর্যালোচনায় দেখা গেছে, এর মধ্যে অন্তত ২৮টি প্রতিষ্ঠানের অনিয়মের মূল কারণ গভর্নিং বডি ও ম্যানেজিং কমিটি। এসব কমিটি কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে।

রাজধানীর হাবিবুল্লাহ বাহার কলেজে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক তদন্তে দেখা গেছে, কলেজের গভর্নিং বডি ও বিভিন্ন নামে গঠিত কমিটি ২০১৭-১৮ থেকে তিন অর্থবছরে সম্মানীর নামে ২০ লাখ ১৫ হাজার টাকা নিয়েছেন।

রাজধানীর শেখ বোরহানুদ্দীন পোস্ট গ্র্যাজুয়েট কলেজ গভর্নিং বডির সাবেক এক সভাপতি মাসে গড়ে ৬৫ হাজার টাকা করে সম্মানী নিতেন।

এ প্রসঙ্গে ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক তপন কুমার সরকার বলেন, ‘কোনো গভর্নিং বডির বিরুদ্ধে অনিয়ম পাওয়া গেলে ওই কমিটি ভেঙে দেওয়ার এখতিয়ার বোর্ডের আছে।’

সূত্র: আমাদের সময়
আইএ/ ৭ অক্টোবর ২০২২

Back to top button