অভিমত/মতামত

ধর্ষিত দেশে কিছুই হয় না নারীর রক্ষাকবচ

ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানা

আসুন একটু চোখটা বন্ধ করি। কল্পনা করি একটা দৃশ্যকল্প। পাঁচ বছরের একটি শিশুকে চকলেটের লোভ দেখিয়ে এক পুরুষ নিয়ে গেছে কোন নির্মাণাধীন বাড়ির মধ্যে। তারপর সে পুরুষটি ওই শিশুটিকে ধর্ষণ করছে। কল্পনা করুন তো এই শিশুটি, যে স্বাভাবিক যৌন সম্পর্ক বোঝা থেকেও বহু দূরে আছে, কী করছে সে ধর্ষণের সময়? তীব্রতম কষ্টে তার গোঙানি কি আপনার কানে বাজলো? তার রক্তাক্ত হয়ে যাওয়া চারপাশ কি আপনি দেখতে পেলেন?

আরেকটা দৃশ্যকল্প কল্পনা করা যাক। ৭০ বছরের একজন নারী রাতে এশার নামাজের ওযু করার জন্য বের হয়েছেন। পেছন থেকে হঠাৎ এক পুরুষ তার মুখ চেপে ধরে তাকে আবার তার ঘরে নিয়ে যায়। ওই নারী তার বাড়িতে একাই থাকেন।
সেই বাড়িতে ওই নারীকে ওই পুরুষ ধর্ষণ করে। কল্পনা করি তো নারী তাকে কিভাবে বাধা দেয়ার চেষ্টা করেছে? মুক্তি পাবার জন্য কী বলে কাকুতি-মিনতি করেছে?

দৃশ্যকল্প কল্পনা করতে বললেও ঘটনাগুলো ঘটেছিল বাস্তবে। সাভারের আশুলিয়ায় চার দিন আগে ঘটেছিল প্রথম অনুচ্ছেদে বলা ঘটনাটি। আর দ্বিতীয় অনুচ্ছেদের ঘটনা মুন্সীগঞ্জের; ঘটেছিল ছয় দিন আগে।

এই জনপদে বহুদিন থেকেই ধর্ষণ একেবারেই স্বাভাবিক ঘটনা। তরুণীদের ধর্ষণ গা সওয়া হয়ে গেছে আমাদের বহু আগেই। এমনকি গা সওয়া হয়ে গেছে বৃদ্ধা কিংবা শিশুদের মত এক্সট্রিম বয়সীদের ধর্ষিত হওয়া। এই যে আমরা প্রতিদিন এত খবরের স্রোতে ভাসি, আমরা কি জানি পত্রিকায় কত শিশু ধর্ষণের খবর আসে। শিশু আর ধর্ষণ শব্দ দু’টো সার্চ দিয়ে দেখুন না, গত কয়েক সপ্তাহে এমন খবর কত এসেছে দেশের স্বীকৃত মূল ধারার গণমাধ্যমে। কই আমরা তো আর ওসব নিয়ে কথা বলি না। সরকার যেমন বলছে করোনাকে নিয়েই আমাদের পথে চলতে হবে, তেমনি আমরা মেনে নিয়েছি ধর্ষণসহ আর সব বর্বর অপরাধকে নিয়েই আমাদের পথ চলতে হবে।

রাজন এর কথা মনে আছে আমাদের? কয়েক বছর আগে স্রেফ পিটিয়ে মেরে ফেলা হয়েছিল যে শিশুটিকে। সেই ভিডিও এসেছিল আমাদের সামনে। সেই সময়কার একটা ঘটনা মনে পড়ল নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ উপজেলার একলাশপুর ইউনিয়নে এক নারীর বর্বর নির্যাতনের শিকার হওয়ার ভিডিওটির কথা জেনে। যখন রাজন হত্যার বিচার হচ্ছিল তখন সেই বিচার কাভার করতে যাওয়া এক সাংবাদিককে একটা অসাধারণ স্টোরি আমাদের জানিয়েছিলেন।

রাজন হত্যার চাঞ্চল্যকর মামলার বিচারের সময় বহু মানুষ আদালতে যান। এর মধ্যে একজন ছিলেন এক বাবা যার দশ/এগারো বছরের সন্তানকেও পিটিয়ে মেরে ফেলা হয়েছিল। সেই বাবা সন্তান হত্যার বিচারের জন্য নানা জায়গায় গেছেন। বিচার না পেয়ে তার উপলব্ধি জানিয়েছিলেন ওই সাংবাদিককে – ‘আমার পোলার তো ভিডিও নাই, আমি কি বিচার পামু?’

নোয়াখালীর বেগমগঞ্জের একলাশপুর এর জনৈক নারীকে গণধর্ষণের পর আরো নানাভাবে নির্যাতন করা হচ্ছে এমন এক বীভৎস ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। আমরা জানলাম, কেউ দেখলাম। অনেক কিছু দেখার সঙ্গে শুনলাম তার তীব্র আকুতি। বারবার বলছেন – ‘এরে আব্বারে, তোগো আল্লার দোহাই রে’। এবার অন্তত দু’টো দিন মানুষের মত আচরণ (আচরণের ভান) করব আমরা, যদি না সরকারের উদ্দ্যশমূলকভাবে ঘটিয়া দেয়া আর কোন ঘটনা আমাদের সেদিকে নিয়ে না যায়। বীভৎসতার মধ্যে বাস করতে করতে কোন কিছুই আর তেমন গায়ে লাগে না আমাদের। কোন বর্বর ধর্ষণ বা হত্যার খবর শুনলে, পত্রিকায় পড়লে সেটা আমাদের আর স্পর্শ করে না।

নোয়াখালীর ভিডিওটি ভাইরাল হওয়ার ৩২ দিন আগে ঘটেছিল ঘটনাটি। ঘটনা ঘটা যতটা বড় ঘটনা, আমার বিবেচনায় তার চাইতে বড় ঘটনা হচ্ছে এই ঘটনায় কোনো মামলা হয়নি তখন পর্যন্ত। কেন মামলা হয়নি তার জবাব আছে নির্যাতিতার বাবার বক্তব্যে। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ঘটনার সঙ্গে জড়িতরা প্রভাবশালী হওয়ায় ভয়ে তাদের বিরুদ্ধে মুখ খোলার সাহস করেননি তারা। শুধু তাই না নির্যাতনকারীদের ভয়ে সেই নির্যাতিতা বাড়ি থেকে পালিয়ে গেছেন।

নির্যাতিত এবং তার বাবা পুরোপুরি সঠিক। তারা এই দেশে বাস করেন এবং জানেন এই দেশটাকে ক্ষমতাসীনরা কোথায় এনে ঠেকিয়েছে। শুধুমাত্র ধানের শীষে ভোট দেয়ার অপরাধে আওয়ামী ক্যাডারদের দ্বারা ধর্ষণের শিকার হওয়া নোয়াখালীর সুবর্ণচরের সেই নারী মামলা করার ‘দুঃসাহস’ দেখানোর পরিণতির কথা কি জানি না আমরা? গত বছরও ঢাকায় সংবাদ সম্মেলন করে নিরাপত্তা চেয়ে কাকুতি মিনতি করেছিলেন তিনি।

নোয়াখালীর বেগমগঞ্জের আলোচিত বর্বরতার ভিডিও ধর্ষকরা নিজেরা করেছিল। ভিডিও করার সময় তারা বারবার ‘ফেসবুক ফেসবুক’ বলছিল। অর্থাৎ ফেসবুকে ভিডিও ছেড়ে দেবে এই উদ্দেশ্যেই ভিডিওটা করা হয়েছিল। এই ভিডিও ফেইসবুকে ছেড়েছে তারা নিজেরাই। ভিডিওটা ভীষণভাবে ভাইরাল হয়ে পড়ায় তাদের ভবিষ্যতে কী হচ্ছে সেটা একটু সরিয়ে রাখি। কিন্তু এই প্রশ্ন করা আমাদের জন্য খুবই জরুরী – এই সাহস তাদের হলো কী করে?

যে কেউ ধর্ষণ শব্দটির সঙ্গে ছাত্রলীগ, যুবলীগ অথবা আওয়ামী লীগ শব্দগুলোর যেকোনো একটি লিখে গুগলে সার্চ দিন। দেখবেন কী পরিমাণ খবরের ফলাফল আসে। অবাক হয়ে দেখবেন একেবারে নিয়মিতভাবে ধর্ষণের ঘটনা ঘটাচ্ছে সরকারি দলের সঙ্গে জড়িত লোকজন। তাদের এই ধর্ষণের উৎসব চলছে সারা দেশের প্রতিটি জেলা-উপজেলায়, প্রতিটি প্রান্তে। এই দেশে আওয়ামী লীগের সঙ্গে যুক্ত থাকা নিশ্চিত করে রাজনৈতিক আর্থিক এবং সামাজিক, সব ক্ষমতা। তাই হোক বীভৎস রকম লুটপাট কিংবা হত্যা কিংবা ধর্ষণ কোন কিছু করতেই তাদের আর বাধে না। কোনো নারী কি ন্যূনতম নিরাপদ এদের হাত থেকে? কোন আর্থসামাজিক শ্রেণী, কিংবা কোনো পারিবারিক ব্যাকগ্রাউন্ড, এমনকি নিজের অর্জিত ক্ষমতা কি বর্তমান বাংলাদেশে নারীকে নিরাপত্তা দিতে পারে?

কয়েকদিন আগে দীর্ঘসময়ের পরিচিত একজনের বাসায় দাওয়াতে গিয়েছিলাম, রাতের খাবার খেয়েছিলাম। যে বাসায় গিয়েছিলাম সেই বাসাটি আমার বাসা থেকে খুব দূরে নয়; উবারের গাড়ি ভাড়া হয় ৬০/৭০ টাকা। রাত এগারোটার দিকে একটা উবারের গাড়ি ভাড়া করে আমি আমার বাসায় রওয়ানা হই। যে বাসায় আমি থাকি, আমি বেড়ে উঠেছি সেই এলাকাতেই, সেই বাসায়। দীর্ঘ সময় বসবাস করি সেখানে; সবকিছু চিনি নিজের হাতের তালুর মতো। করোনার কারণে এখন রাত ১১ টা বাজেতেই শহরটা অনেকটা ফাঁকা হয়ে যায়। ফাঁকা রাস্তায় বাসায় ফিরতে আমার সময় লেগেছে খুব সামান্যই। কিন্তু এই সামান্য রাস্তাকেই আমার কাছে মনে হচ্ছিল অসীম আর এই সামান্য সময়টাকে মনে হচ্ছিল অনন্তকাল।

একজন খুব গুরুত্বপূর্ণ রাজনীতিবিদ বাবা এবং সরকারি চাকরির সর্বোচ্চ পর্যায়ে গিয়ে অবসর নেয়া শিক্ষাবিদ মায়ের সন্তান আমি, দেশের সর্ববৃহৎ রাজনৈতিক দলটির একটি গুরুত্বপূর্ণ পদে আছি আমি, সর্বোপরি দেশের বর্তমান সংসদের একজন সাংসদ আমি। বিব্রত বোধ করলেও নিজের সম্পর্কে এই কয়েকটা কথা আমি লিখেছি আসলে একটা ব্যাপার বোঝানোর জন্য। আমি এই দেশের অত্যন্ত সৌভাগ্যবান নারীদের একজন যার পারিবারিক এবং ব্যক্তিগত কিছু ক্ষমতা আছে। সেই আমি এক অজানা আতঙ্কে ভুগতে ভুগতে সেদিন বাসায় ফিরেছিলাম। করোনার কারণে ড্রাইভারের মুখ মাস্কে ঢাকা। বার বার মনে হচ্ছিল আমার গন্তব্যে না থামিয়ে যদি উবার ড্রাইভার সোজা গাড়ি চালিয়ে অন্য কোথাও নিয়ে যায় আমাকে! কারণ আমি জানি কোন কিছুই আমাকে নিরাপত্তার গ্যারান্টি দেয় না এই বাংলাদেশে। এমসি কলেজে স্বামীর সাথে বেড়াতে যাওয়া মেয়েটি ধর্ষিত হয়েছিল নিজেদের ব্যক্তিগত গাড়ির ভেতরে, সঙ্গে একজন পুরুষ সঙ্গী থাকার পরও। সমাজের প্রিভিলেজড শ্রেণীর অংশ হয়েও তাকে গণধর্ষণের শিকার হতে হয়েছে।

সব কিছু ঘটে চলে কারণ আমরা সব মেনে নিতে শিখে গেছি। আমরা সর্বংসহা হয়ে পড়েছি। সমাজে ঘটে যাওয়া ভয়ংকরতম অন্যায়‌ও আমাদের আর স্পর্শ করে না। রাজনৈতিক দলের নামে দুর্বৃত্তের এক বিরাট দল রাষ্ট্রক্ষমতায়। কারা যাচ্ছে তাই করতে চাইবেই। তাদের যাচ্ছেতাই করার পথে আমরা কতটুকু বাধা তৈরি করছি? কিংবা করছি কি আদৌ?

ফেইসবুকে অনেককে লিখতে দেখছি তারা এই ভিডিওটা দেখতে পারেন‌নি। কেউবা লিখেছেন এই ভিডিওটা দেখবেন না। ‌আমি বরং বলি দেখুন ভিডিওটি, বারবার দেখুন। বহু নারীর ধর্ষিতা কিংবা নির্যাতিতা হবার ভিডিও আপনার সামনে আসে না কারণ অনেক সময়ই তীব্র শকে হয়তো মূর্ছা গেছেন সেই নারী কিংবা একেবারে নির্বাক হয়ে পড়েছেন। সর্বশক্তিতে বাধা দিয়ে চেষ্টা করে, বাবা ডাকে ধর্ষককে কিংবা আল্লাহর দোহাই দেয়। কিন্তু কোন কিছুই নিবৃত্ত করতে পারে না রাষ্ট্রের প্রতিটি বিভাগকে কব্জায় নেয়া ক্ষমতাসীন দলের ক্যাডারদের।

আলোচিত ভিডিওটি হতে পারে একটি মেটাফোরও। নারীটির জায়গায় কল্পনা করুন দেশকে। দেশটি ধর্ষিত হচ্ছে আর নির্যাতিত হচ্ছে এক দঙ্গল দস্যুর হাতে। দেশেরও নাভিশ্বাস উঠে যাচ্ছে, দেশও দস্যুদের বাবা ডাকছে, দিচ্ছে আল্লাহর দোহাই। কিন্তু থেমে থাকে না ধর্ষণ-নির্যাতন। তাকে রক্ষা করতে ঝাঁপিয়ে পড়ার কথা তার যে সন্তানদের, তারা ব্যস্ত কোনো ভাইরাল ঘটনায় ফেইসবুকে স্ট্যাটাস দেয়ায় কিংবা আমার মতো কলাম লিখায়।

আর/০৮:১৪/০৫ অক্টোবর

Back to top button