ঢাকা, ০৫ অক্টোবর – ক্রেন উল্টে গার্ডার চাপায় পাঁচজনের মৃত্যুর জন্য দায়ী হলেও শাস্তি পাচ্ছেন না বাস র্যাপিড ট্রানজিটের (বিআরটি) চীনা ঠিকাদার। দুর্ঘটনার পরপরই চুক্তি বাতিল করে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না গেঝুবা গ্রুপ কোম্পানি লিমিটেডকে কালো তালিকাভুক্ত করার কথা বলা হলেও সে পথেও হাঁটছে না সরকার। কারণ, এতে প্রকল্প বাস্তবায়নকারীদের গাফিলতিতে উল্টো ঠিকাদারকে ১৯ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।
এ ছাড়া চুক্তি বাতিল হলে প্রকল্প ঝুলে যাওয়া এবং চীনের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতিরও শঙ্কা রয়েছে। তাই শাস্তি না দিয়ে ঠিকাদারের কাছে নিহতের জন্য ক্ষতিপূরণ দাবি করেছে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর (সওজ)। প্রকল্পের বীমা থেকে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে। কিন্তু ঠিকাদার বীমার প্রিমিয়াম দিয়েছে কিনা তা নিশ্চিত না হওয়ায় ক্ষতিপূরণ পাওয়ার বিষয়টিও অনিশ্চিত। আবার গার্ডার দুর্ঘটনায় তদন্ত কমিটির বিরুদ্ধে চীনা নাগরিকদের সঙ্গে অসৌজন্যমূলক আচরণের অভিযোগ মন্ত্রণালয়ে জানিয়েছেন ঠিকাদার।
প্রায় এক মাস বন্ধ থাকার পর ১১ সেপ্টেম্বর থেকে বিআরটির নির্মাণকাজ আবারও শুরু হয়েছে। নিরাপত্তা নিশ্চিত করে কাজ শুরুর শর্ত থাকলেও, নিরাপত্তা ব্যবস্থায় মোটামুটি সন্তুষ্ট বলছে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান।
গাজীপুরের জয়দেবপুর থেকে ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর পর্যন্ত বাসের জন্য সাড়ে ২০ কিলোমিটার দীর্ঘ বিশেষায়িত লেন বা বিআরটি-৩-এর নির্মাণকাজ চলছে। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকসহ (এডিবি) তিন সংস্থার ঋণে ২০১২ সালের এই প্রকল্প চার বছরে শেষ করার পরিকল্পনা ছিল। ছয় বছর মেয়াদ বাড়িয়ে আগামী ডিসেম্বরে সম্পন্ন করার লক্ষ্য থাকলেও তা পূরণ হবে না। ধীরগতির এ প্রকল্পের কারণে চরম ভোগান্তি হচ্ছে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের বিমানবন্দর থেকে জয়দেবপুর অংশে।
গত ১৫ আগস্ট বিকেলে রাজধানীর উত্তরার জসীম উদ্দীন মোড়ে গার্ডার স্থানান্তরের সময় ক্রেন কাত হয়ে প্রাইভেটকারের ওপর পড়ায় পাঁচজন নিহত হন।
মাটির সমতলে ১৭ কিলোমিটার বিআরটি লাইন নির্মাণে ২০১৬ সালে চায়না গেঝুবা গ্রুপ কোম্পানি লিমিটেডের সঙ্গে চুক্তি হয়।
এই অংশ বাস্তবায়ন করছে সওজ। ৮৫৫ কোটি ৩৭ লাখ টাকার এই চুক্তি অনুযায়ী, ২০১৭ সালের ১৩ এপ্রিল থেকে পরবর্তী ৯১৭ দিনে, অর্থাৎ ২০১৯ সালের ১৬ অক্টোবর কাজ সম্পন্নের কথা ছিল। পরে চুক্তির মেয়াদ ২০২০ সালের ১৯ জুন এবং ২০২০ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত বাড়ে। তবে গত ৩১ আগস্ট অগ্রগতি মাত্র ৬৫ দশমিক ৮০ ভাগ।
সূত্র জানিয়েছে, নির্ধারিত সময়ে প্রকল্পের জমি হস্তান্তর ও পরিষেবার লাইন স্থানান্তর করতে না পারায় ঠিকাদার প্রায় সাত মাস কাজ করতে পারেননি। এর জন্য প্রকল্প বাস্তবায়নকারী বাংলাদেশি কর্তৃপক্ষ দায়ী। এর জন্য ‘ডিলেই ড্যামেজ’ বাবদ ১০৪ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ দাবি করেছেন ঠিকাদার।
অন্যদিকে, নির্ধারিত সময়ে কাজ সম্পন্ন করতে না পারলে চুক্তি মূল্যের ১০ শতাংশ ‘লিকুইডেটেড ড্যামেজ’ বাবদ ঠিকাদারকে জরিমানা করতে পারবে কর্তৃপক্ষ। চুক্তিতেই এ শর্ত রয়েছে। এ হিসেবে গেঝুবাকে সর্বোচ্চ ৮৫ কোটি টাকা জরিমানা করতে পারবে সওজ। উল্টো ১৯ কোটি টাকা পাওনা হবেন চীনা ঠিকাদার।
বিআরটি প্রকল্পের পরামর্শক দলনেতা ড. মাহবুবুল বারী বলেছেন, ঠিকাদারের দাবি করা ১০৪ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণের বিষয়টি নিষ্পত্তি হয়নি। তবে তাঁরা সালিশি আদালতে বিষয়টি টেনে নিয়ে যেতে পারেন। ঠিকাদারকে জমি বুঝিয়ে দিতে না পারায় যথাসময়ে কাজ করা যায়নি। এখনও মাটির নিচের পরিষেবা লাইন স্থানান্তরের কাজ শেষ হয়নি। বাংলাদেশে প্রকল্প বাস্তবায়নে জমি ও পরিষেবা স্থানান্তর বড় বাধা। গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানি, টেলিফোন কোনো কিছুর লাইন মাটির নিচে নকশা অনুযায়ী নেই। সে কারণে কাজে বিলম্ব হয়। ২০১২ সালের বিআরটি প্রকল্পের শুরু কথা বললেও, আসলে কাজ শুরু হয়েছে ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে।
সওজের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, চুক্তিতে বিআরটির নির্মাণকাজ চলাকালে ঠিকাদারকে বিকল্প রাস্তার ব্যবস্থা করে দেওয়ার শর্ত ছিল। তা পালন করতে পারেনি সওজ। নির্মাণ চলাকালে গাড়ি চলাচল বন্ধ রাখার শর্তটিও মানা যায়নি। এর সঙ্গে যোগ দিয়েছে ১০৪ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণের দাবি। তাই সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে ঠিকাদারকে শাস্তি দেওয়া যায়নি। প্রাক্কলিত দরের চেয়ে ২২ শতাংশ কম টাকায় কাজ করায় ঠিকাদারের এমনিতেই লোকসান হচ্ছে। বাকি যে কাজ রয়েছে, তা সম্পন্ন করতে ঠিকাদারের ২০০-২৫০ কোটি টাকা লাগবে। এই পুরো টাকাই তাঁদের লোকসান হবে। ফলে চুক্তি বাতিল হলে ঠিকাদারের লাভ।
এদিকে, গার্ডার দুর্ঘটনার তদন্ত প্রতিবেদন ১ সেপ্টেম্বর মন্ত্রণালয়ে জমা দেয় কমিটি। সড়ক পরিবহন সচিব এবিএম আমিন উল্লাহ নুরী তখন জানিয়েছিলেন, দুর্ঘটনার জন্য ঠিকাদার দায়ী। এর আগে ৩৪ বার চিঠি দিলেও আমলে নেননি ঠিকাদার। তাঁদের ১২টি দায় পাওয়া গেছে। প্রতিবেদন ঠিকাদার নিয়োগকারী সংস্থা সওজকে পাঠানো হবে। সওজ শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেবে।
সংস্থাটির প্রধান প্রকৌশলী একেএম মনির উদ্দিন বলেছেন, শাস্তি না দেওয়ার কথা সঠিক নয়। ঠিকাদারের কাছে নিহতদের জন্য ক্ষতিপূরণ দাবি করা হয়েছে। তবে তিনি স্বীকার করেন, প্রকল্পের বীমা থেকেই ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে।
তিনি আরও বলেছেন, বিআরটি প্রকল্প এমনিতেই বিলম্ব হয়েছে। ঠিকাদারকে বাদ দিয়ে পুনঃদরপত্র আহ্বান করে কাজ শেষ করতে বাড়তি তিন থেকে চার বছর লেগে যাবে। এতে ভোগান্তি আরও বাড়বে। গেঝুবা একটি বড় ও আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান। তাদের যে ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণম্ন হয়েছে, এটিও তো একটি শাস্তি। ভবিষ্যতে এডিবির অর্থায়নের প্রকল্পে কাজ পেতে সমস্যা হবে।
তদন্ত কমিটির প্রধান ছিলেন বিআরটি প্রকল্পের প্রধান সমন্বয় এবং সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের অতিরিক্ত সচিব নীলিমা আখতার। তিনি বলেন, প্রতিটি ক্ষেত্রেই ঠিকাদারের গাফিলতি ছিল। গেঝুবা শুরু থেকেই অর্থ সংকটে রয়েছে। সে কারণেই কখনও ঠিকভাবে কাজ করেনি।
তদন্ত কমিটি সূত্র জানিয়েছে, গেঝুবা সে দেশের সরকারি প্রতিষ্ঠান হওয়ায় চীনের চাপ ছিল ঠিকাদারের বিরুদ্ধে কঠোর না হতে। কমিটির একজন সদস্য জানিয়েছেন, চীনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের ‘এন্টারটেইন’ না করায় তাঁরা অখুশি হয়ে মন্ত্রণালয়ে অভিযোগ দিয়েছেন।
এডিবির শর্ত ছিল, নিরাপত্তা নিশ্চিত না করে কাজ শুরু করা যাবে না। বিআরটির সওজের প্রকল্প পরিচালক এসএম ইলিয়াস শাহ জানিয়েছেন, নিরাপত্তা জোরদার করে নির্মাণকাজ শুরু হয়েছে। তবে পরামর্শক দলনেতা মাহবুবুল বারী বলেছেন, নিরাপত্তা ব্যবস্থা আন্তর্জাতিক মানের চেয়ে অনেক নিচুতে। যা পুরোপুরি সন্তুষ্ট হওয়ার মতো নয়। তবে আগের চেয়ে নিরাপত্তা বেড়েছে।
সড়ক পরিবহন সচিব এবিএম আমিন উল্লাহ নুরী বলেছেন, টঙ্গীসহ বিআরটির যেসব ফ্লাইওভারের নির্মাণকাজ শেষ হয়েছে, সেগুলো খুলে দেওয়া হবে। টঙ্গীর ফ্লাইওভার খুলে দেওয়ার পর নিচের সেতু ভাঙার কাজ শুরু হবে। বিশেষায়িত বাস না পাওয়া পর্যন্ত বিআরটিতে যাত্রী পরিবহন শুরু হবে না। বিআরটি লেন ফাঁকাই থাকবে। ফ্লাইওভারের মিক্সড লেন দিয়ে সব ধরনের যানবাহন চলবে।
সূত্র: সমকাল
আইএ/ ০৫ অক্টোবর ২০২২