ব্যবসা

সরবরাহ ব্যাপক তবুও নাগালের বাইরে ইলিশের দাম

শফিকুল ইসলাম

ঢাকা, ০৫ অক্টোবর – বাজার ভরা ইলিশ মাছ। বিভিন্ন সাইজের ইলিশের সমারোহ চলছে এখন দেশের মাছ বাজারগুলোয়। ১৫০ গ্রাম ওজন থেকে শুরু করে দুই কেজি থেকে আড়াই কেজি ওজনের সাইজের ইলিশও বাজারে দেখা যাচ্ছে এবছর। ক্রেতাদের অভিযোগ, সরবরাহ ব্যাপক হলেও দাম এখনও সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে। ৪৫০ টাকা থেকে শুরু করে ২৫০০ টাকা কেজি দরের ইলিশও বিক্রি হচ্ছে রাজধানীর বাজারগুলোয়। বাকি নেই রাজধানীর অলিগলি, পাড়া-মহল্লাও। ইলিশের এই দাম স্বাভাবিক নিয়মেই মাছের সাইজের ওপর নির্ভর করে। কেজিতে ৫টা ওঠে এমন সাইজের ইলিশ ৪০০ থেকে ৪৫০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। আর দুই কেজির ওপরের সাইজের ইলিশ বিক্রি হচ্ছে আড়াই হাজার টাকা কেজি দরে। রাজধানীর বাজার ঘুরে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।

সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, সরবরাহ ব্যাপক হলেও নিম্নবিত্ত বা নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের ক্রেতাদের ক্রয়ক্ষমতার নাগালে আসেনি ইলিশের দাম। সাইজের ওপর নির্ভর করা এ মাছের দাম সব সময়ই সাধারণ ক্রেতাদের নাগালের বাইরে থাকায় ক্ষোভও প্রচুর। আর মাত্র দুদিন পরেই ২২ দিনের জন্য ইলিশ ধরা, বাজারজাত করা, বিপণন কর বন্ধ থাকবে ইলিশের। এই ২২ দিন কেউ কাউকে উপহার হিসেবেও দিতে পারবেন না। এ সময় করা যাবে না ইলিশ সংরক্ষণ। ফলে নদীতে সাগরে যা ইলিশ ধরা পড়ছে সবই বাজারে আসছে। এ কারণে বাজার ভরা ইলিশ দেখতে ভালো লাগলেও কেনার সাধ্য নাই অনেকের।

জানা গেছে, এখনও বাজারে এক কেজি সাইজের ইলিশ ১২শ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। সাইজ যদি দেড় কেজি ওজনের হয় তাহলে তার দাম বেড়ে দাঁড়াচ্ছে ১৫ থেকে ১৬শ টাকা। এই দামে এক কেজি ইলিশ মাছ কেনার ক্রেতা কম হলেও অবিক্রিত থাকে না এসব মাছ। বিক্রি হচ্ছে সব সাইজের মাছই। আবার ২০০ গ্রাম থেকে ৩০০ গ্রাম ওজনের ইলিশের কেজি ৫০০ টাকা। ওজন ৪০০ থেকে ৫০০ গ্রাম হলে দাম কেজিপ্রতি ৭০০ টাকা থেকে ৭৫০ টাকা।

সাধারণ ক্রেতারা জানিয়েছেন, বাজারে সরবরাহ কম নয় ইলিশের তবুও দাম চড়া। অন্যদিকে মাছ ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, সরবরাহ থাকলেও ভারতে রফতানির সুযোগ দেওয়ার কারণে বাজারে বড় সাইজের ইলিশের সরবরাহ কম, তাই দাম বেশি। বড় সাইজের ইলিশই ভারতে রফতানি হচ্ছে। ব্যাপক চাহিদার কারণেই ছোট সাইজের ইলিশের দামও চড়েছে।

নিম্নচাপের কারণে সাগর উত্তাল রয়েছে বিধায় কয়েক দিনের টানা দুর্যোগে অনেক জেলে গভীর সমুদ্রে মাছ ধরতে যায়নি। মাছের ট্রলারডুবিতে মারাও গেছেন কয়েকজন জেলে। বিস্তর জেলেকে সাগর থেকে জীবিত উদ্ধার করা হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে মাছ ধরা ট্রলারগুলো উপকূলের কাছাকাছি নিরাপদে অবস্থান করছিলো। মঙ্গলবার (৪ অক্টোবর) সকাল থেকে আবহাওয়া ভালো হতে শুরু করলে ট্রলারগুলো আবার সাগরে ফিরছে বলে জানা গেছে।

বরিশালের ইলিশ ব্যবসায়ী স্বপন সিকদার জানিয়েছে, গত দুদিনে বরিশাল পোর্ট রোড মাছের মোকাম থেকে আনুমানিক ৩০ টনের মতো ইলিশ মাছ ভারতে রফতানি হয়েছে। আরও ইলিশ রফতানি প্রক্রিয়াধীন। আগামীকাল ৫ অক্টোবর পর্যন্ত চলবে এই রফতানি। তাই বড় ইলিশ সব ক্রেতাদের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে।

একইভাবে ভোলার ইলিশ ব্যবসায়ী আনোয়ার মহাজন জানিয়েছেন, তেতুলিয়া ও মেঘনার ইলিশ এবার প্রচুর ধরা পড়ছে। সাইজও খারাপ নয়। সরকারের পক্ষ থেকে বিভিন্ন সময়ের নিষেধাজ্ঞার কারণেই ইলিশের সাইজ বড় হচ্ছে। দাম ভালো পাওয়া যাচ্ছে। তবে রফতানির সুযোগ বিদ্যমান থাকায় চাহিদা ব্যাপক। দেশের ক্রেতারাও কিনতে চাচ্ছেন, আবার যারা ভারতে রফতানি করবেন তারাও বড় সাইজের ইলিশ কিনতে চাচ্ছেন। এর ফলে ইলিশের বাজারে এক ধরনের অদৃশ্য চাপ পড়ছে। এ কারণেই দাম কমছে না।

চাঁদপুরের ইলিশ ব্যবসায়ী লক্ষণ চন্দ্র দাস জানিয়েছেন, দুদিন পরেই মা ইলিশকে ডিম ছাড়ার সুযোগ দিতে ২২ দিনের জন্য ইলিশ ধরার উপর নিষেধাজ্ঞা আসছে। সে কারণে ব্যবসায়ী এবং ক্রেতা উভয়েরই ইলিশের ওপর আগ্রহ বাড়ছে। জেলেদের জালে যা ধরা পড়ছে তাই বাজারে সরবরাহ করা হচ্ছে। অপরদিকে দুদিন পরে আর ২২ দিনের জন্য ইলিশ পাওয়া যাবে না ভেবে ক্রেতাও ইলিশ কেনার জন্য মরিয়া হয়ে উঠছেন। এতে বাড়ছে ইলিশের দাম। সরবরাহ ব্যাপক হলেও চাহিদার কারণে দাম এবছর স্থিতিশীল হচ্ছে না। দাম ওঠানামা করছে।

মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সূত্র মতে প্রতি বছরই বাড়ছে ইলিশের উৎপাদন। মাত্র দেড় দশকের ব্যবধানে এ সংখ্যা ছাড়িয়ে গেছে ২ লাখ টনের ঘর। পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ১৯৮৬-৮৭ সালে দেশে ইলিশ উৎপাদন হতো ১ লাখ ৯৫ হাজার টন। ২০০২-০৩ অর্থবছরে ১ লাখ ৯১ হাজার টন ইলিশ উৎপাদিত হয়। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে সেই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩ লাখ ৯৫ হাজার টন। এবছর এর উৎপাদন ৫ লাখ টন ছাড়িয়ে যেতে পারে।

বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের গবেষণা তথ্যমতে, ১০ বছর আগে দেশের ২১টি উপজেলার নদ-নদীতে ইলিশ পাওয়া যেতো। বর্তমানে ১২৫টি উপজেলার নদ-নদীতে এই মাছ পাওয়া যাচ্ছে। পদ্মার শাখানদী মহানন্দা থেকে শুরু করে মৌলভীবাজারের হাকালুকি হাওর এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মেদির হাওরেও এ বছর ইলিশ পাওয়া গেছে।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে মৎস্যমন্ত্রী শ. ম রেজাউল করিম জানিয়েছেন, সরকার ইলিশ রক্ষায় ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। সেসব কর্মসূচি বাস্তবায়নও হচ্ছে। এ কারণেই অতীতের যে কোনও সময়ের তুলনায় ইলিশের উৎপাদন ও সাইজ দুটোই বেড়েছে। আশা করছি এবছর ৫ লাখ টনের বেশি ইলিশ ধলা পড়বে। যার সুফল আমরা পাবো।

উল্লেখ্য, আগামী ৭ অক্টোবর থেকে ২২ দিন ইলিশ ধরা নিষিদ্ধ করছে সরকার। ইলিশের প্রধান প্রজনন মৌসুমে ইলিশ মাছ ধরার ওপর প্রতিবছরের ন্যায় এবছরও নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে সরকারের পক্ষ থেকে। মা ইলিশের প্রজনন নিরাপদ রাখার লক্ষ্যে আগামী ৭ থেকে ২৮ অক্টোবর পর্যন্ত ২২ দিন সারা দেশে ইলিশ ধরা বন্ধ থাকবে। এ সময়ে পরিবহন, ক্রয়-বিক্রয়, মজুত ও বিনিময় নিষিদ্ধ থাকবে। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের এক বিজ্ঞপ্তিতে এ কথা বলা হয়েছে।

সূত্র: বাংলা ট্রিবিউন
আইএ/ ০৫ অক্টোবর ২০২২

Back to top button