ঢাকা, ০৪ অক্টোবর – উগ্রবাদে জড়িয়ে ‘হিজরত’-এর উদ্দেশ্যে ঘর ছেড়েছেন এমন সন্দেহভাজনের তালিকায় এবার উঠেছে সরকারি চাকুরের নাম। নেছার উদ্দিন (৩৪) নামে ওই ব্যক্তি ভোলার চরফ্যাসনের কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের বৈজ্ঞানিক সহকারী। নেছারের বাড়ি পটুয়াখালী। ‘নিখোঁজ’ হওয়ার ঘটনায় তাঁর বাবা চরফ্যাসন থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেছেন।
রাজধানীর গুলশানের হলি আর্টিসান বেকারি ও শোলাকিয়ায় হামলার পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ব্যাপক ধরপাকড়ে উগ্রপন্থি কার্যক্রম অনেকটা নিষ্ফ্ক্রিয় হয়ে আসে। তবে হঠাৎ করে দেশের বেশ কয়েকটি জেলা থেকে তরুণ ও যুবকরা নিখোঁজ হওয়ার ঘটনায় ফের জঙ্গিবাদ চাঙ্গা হওয়ার শঙ্কা তৈরি হয়েছে। এখন পর্যন্ত ঢাকা, কুমিল্লা, নারায়ণগঞ্জ, গোপালগঞ্জ, পটুয়াখালী, ভোলা ও সিলেট থেকে ঘর ছাড়ার তথ্য মিলেছে। সব মিলিয়ে ‘নিখোঁজ’ সংখ্যা অন্তত ৪০। তাঁদের অধিকাংশই কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় ও মাদ্রাসা শিক্ষার্থী।
জঙ্গি তৎপরতার ব্যাপারে তথ্য রাখেন এমন একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত নভেম্বরে সিলেট থেকে যাঁরা নিখোঁজ হন, তাঁদের সঙ্গে রয়েছে সম্প্রতি ঘরছাড়া তরুণদের যোগসূত্র। নতুন একটি জঙ্গি মঞ্চ তৈরির চেষ্টা করছে তাঁরা- এমন কিছু আলামত গোয়েন্দারা পেয়েছেন। রোহিঙ্গাদের কেউ এই কার্যক্রমে জড়ানোর চেষ্টা করছে কিনা, সেদিকেও রাখা হচ্ছে তীক্ষষ্ট নজর। কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটের প্রধান ডিআইজি মো. আসাদুজ্জামান বলেন, তরুণরা ঘর ছাড়ছে- এটাই আমাদের কাছে উদ্বেগের বিষয়। প্রথমত. অনলাইনে তাদের উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে। যারা ফাঁদে পা দিয়েছে, তাদের ‘গোপন গ্রুপে’ সংযুক্ত করে নিয়েছে। এটা কোন জঙ্গি সংগঠনে বিশ্বাসী- এটা স্পষ্টভাবে বলার সময় এখনও আসেনি। তাদের ‘সেফ হাউস’ খোঁজা হচ্ছে। অন্য একটি সূত্র বলছে, নিখোঁজদের কেউ আনসার আল ইসলামের আদর্শে উদ্বুদ্ধ করে তাঁরা হিজরতের উদ্দেশে বের হতে পারেন।
গত সেপ্টেম্বরে ভোলার চরফ্যাসন ও বোরহান উদ্দিন থেকে নিখোঁজ হয়েছেন তিনজন। এর মধ্যে চরফ্যাসন থেকে ঘর ছাড়েন বৈজ্ঞানিক সহকারী নেছার ও বোরহানউদ্দিনের মাদ্রাসা ছাত্র মাহমুদুল (১৬)। গত ১৬ সেপ্টেম্বর মাহমুদুল ও তার সহপাঠী তামিম (১৫) একসঙ্গে ঘর ছাড়ে। তবে নিখোঁজের চার দিন পর বাসায় ফেরে তামিম। পরে পুলিশসহ একাধিক গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে। তামিম দাবি করে, ইউটিউবে উগ্রপন্থি ভিডিও দেখে জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ হয় সে। এরপর মাহমুদুলের পরামর্শে ‘ইসলামের জন্য জিহাদ’ করতে ঘর ছাড়ে। ভোলা থেকে এসে ঢাকায় একটি মসজিদে ছিল। সেখান থেকে সীমান্ত এলাকায় যায়। সীমান্ত পার হয়ে পাকিস্তান যাওয়ার পরিকল্পনা ছিল। সেটাতে ব্যর্থ হয়ে বাড়ি ফিরে আসে তামিম। তবে মাহমুদুল ফেরেনি।
কার মাধ্যমে তাদের ‘মগজ ধোলাই’ হয়েছে- এমন প্রশ্নে তামিম পুলিশকে জানায়, কোনো ব্যক্তির সঙ্গে তার যোগাযোগ হয়নি। এটা মাহমুদুল জানতে পারে।
কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের বৈজ্ঞানিক সহকারী নেছার উদ্দিন নিখোঁজের ঘটনায় তাঁর বাবা মতিউর রহমান ২৫ সেপ্টেম্বর চরফ্যাসন থানায় জিডি করেন। সেখানে তিনি বলেন, ৫ সেপ্টেম্বর থেকে নেছার নিখোঁজ। তার ব্যবহূত মোবাইল ফোনও বন্ধ। ওই দিন থেকে কর্মস্থলেও অনুপস্থিত তিনি। ঘর ছাড়ার আগের দিন সর্বশেষ নেছার তাঁর স্ত্রীকে ফোন করেছিলেন। অনেক খোঁজাখুঁজি করেও নেছারের খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না।
ভোলার পুলিশ সুপার মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, তামিম স্বেচ্ছায় ফেরত আসার পর তাকে পরিবারের জিম্মায় দেওয়া হয়েছে। এখন কৃষি ইনস্টিটিউটের বৈজ্ঞানিক সহকারী ও বোরহানউদ্দিনের মাদ্রাসা ছাত্রের অবস্থান জানার চেষ্টা চলছে।
জিডির তদন্ত কর্মকর্তা ও বোরহানউদ্দিনের উপপরিদর্শক সিজার হোসেন বলেন, তামিম ফেরত আসার পর তার সহাপাঠী মাহমুদুল পরিবারের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করে দ্রুত ফেরত আসার কথা দিয়েছিল। তবে বেশ কিছুদিন পার হওয়ার পরও সে ফেরত আসেনি। তার মোবাইল ফোনও বন্ধ।
গত ১৫ নভেম্বর সিলেট থেকে যে চার তরুণ নিখোঁজ হন, তাঁরা হলেন- শেখ আহমেদ মামুন, হাসান সায়িদ, সাইফুল ইসলাম তুহিন ও সাদিকুর রহমান। সম্প্রতি আরও ছয় জেলা থেকে যাঁরা নিখোঁজ হয়েছেন, তাঁদের মধ্যে রয়েছেন ভিক্টোরিয়া কলেজের ছাত্র মোহাম্মদ আল সামি, ইমরান বিন রহমান, ইমতিয়াজ আহমেদ রিফাত ও আমিনুল ইসলাম; ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সরতাজ ইসলাম; কুমিল্লা সরকারি কলেজের ছাত্র হাসিবুল ইসলাম ও নিহাল আবদুল্লাহ এবং কুমিল্লার কোবার মসজিদের ইমাম শাহ মোহাম্মদ হাবিবুল্লাহ। এ ছাড়া পটুয়াখালী থেকে নিখোঁজ হয় পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের ছাত্র আল আমিন (২২) ও মিরাজ (২৫)। এ ছাড়া কুয়াকাটা থেকে নিখোঁজ হয় ইব্রাহীম (১৯) ও মোহাম্মদ হোসাইন এবং রাঙ্গাবালির মো. সাবিথ (১৯)। গোপালগঞ্জ থেকে ঘর ছাড়েন রোমান শিকদার (২৩), ঢাকার সূত্রাপুর থেকে রাকিব হাসনাত (২৮) ও নারায়ণগঞ্জের সানারপাড়া থেকে জাহেদ চৌধুরী (২৪)।
সূত্র: সমকাল
আইএ/ ০৪ অক্টোবর ২০২২