ইসলাম

ইসলামে অভ্যর্থনা জানানোর রীতি ও পদ্ধতি

ড. আবু সালেহ মুহাম্মদ তোহা

অভ্যর্থনা (Welcome) হলো সংবর্ধনা, আপ্যায়ন, সমাদর ও সসম্মানে গ্রহণ ইত্যাদি। পৃথিবীতে ইসলাম এসেছে সভ্য, উন্নত ও চির সুন্দর সমাজ বিনির্মাণের উদ্দেশ্যে। ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র ও বৈশ্বিক পরিমণ্ডলের ক্ষুদ্র থেকে শুরু করে সব বিষয়ে রয়েছে ইসলামের সুনির্দিষ্ট নীতিমালা। অতিথিদের সম্মান ও অভ্যর্থনা জানানোর পদ্ধতি নিম্নরূপ—

সালাম : সালামের মাধ্যমে পরস্পরের মধ্যে ভালোবাসা সৃষ্টি হয়, হিংসা-বিদ্বেষ দূর হয় এবং শান্তি-সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ঈমানি পরিবেশ তৈরি হয়।

মহান আল্লাহ প্রথম মানুষ হিসেবে আদম (আ.)-কে সৃষ্টি করেন। এরপর ফেরেশতা কর্তৃক তাকে অভ্যর্থনা জানানোর আয়োজন করেন। আদম (আ.) ফেরেশতাদের উদ্দেশ্যে ‘আস-সালামু আলাইকুম’ বললে ফেরেশতারা জবাবে বলেন, ‘আস-সালামু আলাইকা ওয়া রহমাতুল্লাহ’।
আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যখন মহান আল্লাহ আদম (আ.)-কে সৃষ্টি করলেন, তখন বললেন, যাও, অমুক স্থানে ফেরেশতাদের একটি দল আছে, তাদের সালাম করো এবং তাদের জবাব শোনো। কারণ সেটিই তোমার এবং তোমার সন্তানদের অভিবাদন। আদম (আ.) গিয়ে ফেরেশতাদের উদ্দেশ্যে ‘আস-সালামু আলাইকুম’ বলে সালাম দিলেন। ফেরেশতারা জবাবে বলেন, ‘আস-সালামু আলাইকা ওয়া রহমাতুল্লাহ’। তারা ‘ওয়া রহমাতুল্লাহ’ বেশি বলেন। তখন থেকেই সালামের সূচনা হয়। (বুখারি, হাদিস : ৫৮৭৩; মুসলিম, হাদিস : ৭৩৪২)

এ ছাড়া আগমনকারী অবস্থানকারীকে সালাম দেওয়াই ইসলামী শিষ্টাচার। হাদিসে বলা হয়েছে, আরোহী হেঁটে চলা ব্যক্তিকে, চলমান থেমে থাকা ব্যক্তিকে, আগমনকারী অবস্থানকারীকে, কমসংখ্যক বেশিসংখ্যক লোককে এবং কম বয়সী বেশি বয়সীকে সালাম প্রদান করবে। (বুখারি, হাদিস : ৫৮৭৭; মুসলিম, হাদিস : ৫৭৭২)

মুসাফাহা বা করমর্দন : মুসাফাহা বা করমর্দন হলো সালামের পরিপূরক। আবদুল্লাহ ইবন মাসউদ (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘সালামের পরিপূর্ণতা হলো মুসাফাহা। ’ (তিরমিজি, হাদিস: ২৭৩০)

সালাম বিনিময়ের পর উভয়ে উভয়ের দুই হাতের মাধ্যমে মুসাফাহা করাই সুন্নাহসম্মত।

কারণ প্রথমত, এ বিষয়ে ইমাম বুখারি (রহ.) সহিহ বুখারির মুসাফাহা অধ্যায়ে বলেছেন, ‘উভয় হাত দ্বারা মুসাফাহা করার বর্ণনা। হাম্মাদ ইবন জায়েদ (রহ.) আবদুল্লাহ ইবন মুবারক (রহ.)-এর সঙ্গে উভয় হাত দ্বারা মুসাফাহা করেছেন। ’ (বুখারি, অধ্যায়: অনুমতি প্রার্থনা, অনুচ্ছেদ: দুহাত ধরে মুসাফাহা, শিরোনাম।

দ্বিতীয়ত, আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) বলেন, ‘রাসুলুল্লাহ (সা.) আমাকে ‘আত-তাহিয়্যাত’ এমনভাবে মুখস্থ করিয়েছেন যে আমার হাত তাঁর উভয় হাতের মধ্যে ছিল। ’ বুখারি, হাদিস : ৫৯১০)

তৃতীয়ত, হাদিসে হাত দ্বারা মুসাফাহা করার কথা বর্ণিত হয়েছে। হাত বললে দুই হাতই বোঝায়। যেমন—আবদুল্লাহ ইবন আমর (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘প্রকৃত মুসলমান সে ব্যক্তি, যার মুখ ও হাতের অনিষ্ট থেকে মুসলমানরা নিরাপদ থাকে। ’ (বুখারি, হাদিস : ১০; মুসলিম, হাদিস : ১৭১)

এখানে হাত বললেও অবশ্যই দুই হাত উদ্দেশ্য। পক্ষান্তরে কোনো এক হাত বোঝাতে চাইলে নির্দিষ্ট করে ডান বা বাম হাত উল্লেখ করা হয়। যেমন—খাদ্য গ্রহণ করার ক্ষেত্রে ডান হাত দ্বারা খেতে বলা হয়েছে। (দ্র. বুখারি, হাদিস : ৫০৬১; মুসলিম, হাদিস : ৫৩৮৭)

বাম হাতে খেতে নিষেধ করা হয়েছে। (দ্র. মুসলিম, হাদিস : ৫৩৮৩)

ডান হাতে ইসতিনজা করতে নিষেধ করা হয়েছে। (দ্র. বুখারি, হাদিস: ১৫৩; মুসলিম, হাদিস: ৬৩৮)

চতুর্থত, এক হাতে মুসাফাহা করা বর্তমানে একটি ফ্যাশনে পরিণত হয়েছে। যা পরিত্যাজ্য। অথচ মুসাফাহা একটি ইবাদত, যা স্বীয় বৈশিষ্ট্য ও স্বাতন্ত্র্যে সমৃদ্ধ।

মুয়ানাকা বা কোলাকুলি : দীর্ঘদিন পর একে অন্যের সঙ্গে সাক্ষাৎ হলে পরস্পরে মুয়ানাকা বা কোলাকুলি করা সুন্নত। কেউ সফর থেকে এলে দীর্ঘদিন পর দেখা-সাক্ষাৎ হওয়ায় সাহাবায়ে কেরাম মুয়ানাকা বা কোলাকুলি করতেন। আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, জায়েদ ইবন হারিসা (রা.) যখন মদিনায় এলেন তখন রাসুলুল্লাহ (সা.) আমার ঘরে ছিলেন। জায়েদ (রা.) তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে আমার ঘরে এলেন এবং দরজায় টোকা দিলেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) নিজের কাপড় সামলাতে সামলাতে উঠে গেলেন এবং জায়েদের সঙ্গে কোলাকুলি করলেন এবং তাকে আদর করলেন। (তিরমিজি, হাদিস : ২৭৩২)

শাবি (রহ.) বলেন, সাহাবায়ে কেরাম পরস্পরে মুসাফাহা করতেন আর কেউ সফর থেকে এলে তার সঙ্গে কোলাকুলি করতেন। (ইবন আবি শায়বা, আল-মুসান্নাফ, হাদিস : ২৬২৩৪)

দাঁড়িয়ে যাওয়া ও এগিয়ে যাওয়া : সফর থেকে আগত ব্যক্তির আগমনে আনন্দ প্রকাশ করে তার জন্য দাঁড়ানো মুস্তাহাব। আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, ফাতেমা (রা.) যখনই রাসুল (সা.)-এর কাছে আসতেন, রাসুল (সা.) তাঁর দিকে দাঁড়িয়ে অগ্রসর হতেন, চুমু খেতেন। তিনি তাঁকে নিজের জায়গায় বসাতেন। (তিরমিজি, হাদিস : ৩৮৭২)

এভাবে কোনো ব্যক্তির সফলতার ওপর আনন্দিত হয়ে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য দাঁড়ানোও মুস্তাহাব। (ফাতহুল মুলহিম : ৩/১২৭)

কাব ইবনে মালেক (রা.) বলেন, আমি মসজিদে প্রবেশ করলে তালহা (রা.) আমার দিকে আনন্দিত হয়ে বসা থেকে উঠে দৌড়ে এগিয়ে এসেছেন এবং অভিনন্দন জানিয়েছেন। (বুখারি, হাদিস: ৪৪১৮)

আবু সাইদ খুদরি (রা.) থেকে বর্ণিত, বনু কুরাইজার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় রাসুলুল্লাহ (সা.) সাদ ইবনে মুয়াজ (রা.)-কে ডেকে পাঠিয়েছেন। সাদ (রা.) একটি গাধায় চড়ে আসেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) তাঁর ব্যাপারে বলেন, তোমরা তোমাদের নেতা সাদের দিকে দাঁড়িয়ে এগিয়ে যাও। (মুসলিম, হাদিস : ১৭৬৮)

কাজেই ব্যক্তি বিশেষের ক্ষেত্রে দাঁড়িয়ে যাওয়া ও প্রয়োজনে এগিয়ে গিয়ে তাঁকে অভিবাদন ও অভ্যর্থনা জানানোর অনুমতি আছে।

আপ্যায়ন : অতিথিকে যথাযথ আপ্যায়ন ও কদর করা একজন মুসলমানের ঈমানি কর্তব্য হিসেবে বিবেচিত। নবী (সা.) অতিথি আপ্যায়নের তাকিদ দিয়েছেন। কাজেই আগত অতিথিদের আদর-আপ্যায়ন ও উপহার-সামগ্রী প্রদান অতি সমীচীন বিষয়। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহ ও পরকালের প্রতি ঈমান রাখে, সে যেন অতিথিদের সমাদর করে। ’ (বুখারি, হাদিস : ৬১৩৬)

মৌখিক অভ্যর্থনা ও অভ্যর্থনা সংগীত : আগন্তুক অতিথিকে মৌখিক অভ্যর্থনা ও অতিথির প্রশংসনীয় গুণাবলিসংবলিত অভ্যর্থনা সংগীতও পরিবেশন করা যেতে পারে। সে ক্ষেত্রে লক্ষণীয় যে ইসলামের অন্য বিধান যেন লঙ্ঘন না হয়। আবদুল্লাহ ইবন আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, যখন আবদুল কায়েস গোত্রের প্রতিনিধিরা নবী (সা.)-এর কাছে আগমন করে তখন নবী (সা.) তাদের জিজ্ঞাসা করেন, ‘তোমরা কারা?’ তারা বলল, ‘আমরা (আবদুল কায়েস গোত্রের) রবিআ শাখার লোক। ’ নবী (সা.) বলেন, ‘ওই জাতিকে মারহাবা! ওই প্রতিনিধিদলকে মারহাবা! এটা তোমাদের অপরিচিত কোনো জায়গা নয়। এখানে লজ্জিত হওয়ার কিছু নেই। ’ (বুখারি, হাদিস : ৫৩; মুসলিম, হাদিস : ১৭)

রাসুলুল্লাহ (সা.) মক্কা থেকে হিজরত করে যখন মদিনায় প্রবেশ করছিলেন, তখন মদিনার মানুষের মধ্যে আনন্দ-উচ্ছ্বাসের জোয়ার নেমে এসেছিল। তারা প্রিয়নবী (সা.)-কে বরণ করে নিতে রাস্তায় বেরিয়ে এসেছিল। নারী ও শিশুরা বাড়ির ছাদে দাঁড়িয়ে নবী (সা.)-কে বিভিন্ন রকমের কবিতা আবৃত্তি করে হৃদয়োৎসারিত উষ্ণতা দিয়ে অভ্যর্থনা জানিয়েছিল। (ইবনে কাসির, আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ৩য় খণ্ড, পৃষ্ঠা ১৮৮)

তারা আবৃত্তি করেছিল—

তলা‘আল বাদরু ‘আলাইনা, মিন ছানিয়্যাতিল বিদা‘আ

ওজাবাশ শুকরু ‘আলাইনা- মাদা‘আ লিল্লাহি দা‘আ

আইয়্যুহাল মাব‘উছু ফি-না—জি’তা বিল আমরিল মুতা‘আ।

অর্থ—‘উদিত হলো নতুন চাঁদ, ওদা পাহাড়ের ঘাঁটি থেকে। দায়িত্ব মোদের শোকর করা, ডাকবেন যত দিন আল্লাহর দিকে। ওহে নবাগত! মোদের মাঝে, অনুগত আমরা সবে তোমার সকল কথায়-কাজে। ’

নবী (সা.) বনু নাজ্জার গোত্রে পৌঁছলে তাদের মেয়েরা অভ্যর্থনা জানিয়ে আবৃত্তি করেছিল—

‘নাহনু জাওয়ারু মিন বানিন-নাজ্জার, ইয়া হাব্বাজা মুহাম্মাদুন মিন জার। ’

অর্থ—‘আমরা নাজ্জার গোত্রের মেয়ে, কী সৌভাগ্য আমাদের, মুহাম্মাদ (সা.) আমাদের প্রতিবেশী। ’ (মুহাম্মাদ ইদ্রিস কান্ধলভি, সিরাতুল মুস্তফা, ১ম খণ্ড, দেওবন্দ : দারুল কিতাব, পৃষ্ঠা ৪০৬)

আইএ

Back to top button