জাতীয়

জয়-লেখকের আশকারায় রিভা-রাজিয়া বেপরোয়া

ঢাকা, ২৭ সেপ্টেম্বর – সিটবাণিজ্য, চাঁদাবাজি, শিক্ষার্থী নির্যাতনসহ নানা অভিযোগে বিভিন্ন সময়ে গণমাধ্যমের শিরোনাম হয়েছেন ইডেন কলেজ শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি তামান্না জেসমিন রিভা ও সাধারণ সম্পাদক রাজিয়া সুলতানা। তবে এত এত অভিযোগের পরও তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। সর্বশেষ গত রবিবার দুপক্ষের সংঘর্ষের পর ইডেন কলেজ শাখা ছাত্রলীগের কমিটির সাংগঠনিক কার্যক্রম স্থগিত করা হয়। স্থায়ীভাবে সংগঠন থেকে বহিষ্কার করা হয় রিভা-রাজিয়ার বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া ১৬ জনকে। কিন্তু রিভা-রাজিয়ার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

নেতাকর্মীদের অভিযোগ, কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সভাপতি আল নাহিয়ান খান জয় ও সাধারণ সম্পাদক লেখক ভট্টাচার্যের ‘কাছের লোক’ হওয়ায় নানা অভিযোগের পরও তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। বরং জয়-লেখকের আশকারা পেয়ে পেয়ে দিন দিন বেপরোয়া হয়ে উঠছেন রিভা-রাজিয়া।

গত ১৪ মে রিভাকে সভাপতি ও রাজিয়া সুলতানাকে সম্পাদক করে ৪৮ সদস্যের ইডেন কলেজ শাখা ছাত্রলীগের কমিটি গঠন করা হয়। কমিটি ঘোষণার পর থেকেই তাদের বিরুদ্ধে একের পর এক অভিযোগ উঠতে থাকে। কমিটি ঘোষণার দিনেই সভাপতি-সম্পাদকের বিরুদ্ধে মিছিল করে ছাত্রলীগের একাংশ। পরবর্তী সময়ে তাদের বিরুদ্ধে সিটবাণিজ্য, চাঁদাবাজি, সাধারণ শিক্ষার্থীদের নির্যাতনসহ একের পর এক অভিযোগ আসতে থাকে। ছাত্রলীগের কর্মসূচিতে না যাওয়ায় গত ২০ আগস্ট চতুর্থ বর্ষের কয়েক শিক্ষার্থীকে ছাত্রী নিবাসের কক্ষ থেকে বের করে দেওয়ার হুমকি দেন রিভা। হুমকি দেওয়ার একটি অডিও ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ে। সেখানে রিভাকে গালাগালি করতে শোনা যায়।

এরপর অভিযোগ ওঠে, দুই ছাত্রীকে সাত ঘণ্টা আটকে রেখে নির্যাতন এবং নগ্ন ভিডিও ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেওয়ার হুমকি দিয়েছেন রিভা। গত ১৯ সেপ্টেম্বর বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব ছাত্রী নিবাসের পাঠকক্ষের প্রবেশমুখে টেবিল বসিয়ে পড়ছিলেন ছাত্রলীগের এক কর্মী। এতে অন্য শিক্ষার্থীদের চলাচলে সমস্যা হওয়ায় এক ছাত্রী তাকে সরে যাওয়ার অনুরোধ করেন। এ নিয়ে কথাকাটাকাটির জেরে সহসভাপতি আয়েশা ইসলামের নেতৃত্বে ছাত্রলীগের কর্মীরা তার পায়ে গরম চা ঢেলে দেন। হাতও মচকে দেন। আয়েশা ইসলাম সভাপতি রিভার অনুসারী।

ইডেন ছাত্রলীগের মধ্যে কোন্দল তৈরি হয় মূলত সিটবাণিজ্য নিয়ে; কমিটির সবাইকে ভাগ না দেওয়ার কারণে। জানা যায়, ইডেন কলেজের ৬টি হলে ছাত্রলীগের জন্য বরাদ্দ রয়েছে ১০০টি কক্ষ। কিন্তু এর বাইরেও প্রায় ৩০টি কক্ষ থাকার সত্যতা মিলেছে। প্রত্যেক কক্ষে ১০-১৫ জন করে থাকে। তাদের মধ্যে কেউ কেউ এককালীন ১৫-৩০ হাজার টাকা দিয়ে উঠেছে, আবার কেউ মাসিক ২ থেকে ৩ হাজার টাকা ভাড়া দিয়ে থাকেন। কেউ কেউ আবার বার্ষিক চুক্তি করে নেন। প্রায় সব কক্ষ রিভা-রাজিয়ার নিয়ন্ত্রণে। টাকা উঠানোর জন্য তাদের রয়েছে পছন্দের কর্মী বাহিনী।

জানা যায়, নিজেদের মধ্যে এ কোন্দল মেটাতে গত ১৪ জুন কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ ইডেন কলেজ শাখার নেতৃবৃন্দকে নিয়ে বসেন। অন্তর্কোন্দল দমনে কক্ষ ভাগাভাগি করে দেন। সেখানে জয়-লেখক প্রত্যেক পোস্টেড নেত্রীকে ১টি করে রুম বরাদ্দের নির্দেশ দেন ইডেন কলেজের সভাপতি-সম্পাদককে। কিন্তু তার পরও সেটা করেননি রিভা-রাজিয়া। ইডেন কলেজ ছাত্রলীগে মূলত তিনটি গ্রুপ রয়েছে। সভাপতির ১টি, সাধারণ সম্পাদকের ১টি ও কমিটি না মানা বিদ্রোহীদের ১টি।

হলে শুধু সিটবাণিজ্যই নয়, তাদের ইচ্ছেমতো যখন-তখন যাকে তাকে হল থেকে নামিয়ে দেওয়া বা উঠানো, মেয়েদের শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করা, ক্যান্টিনে চাঁদাবাজি, বনিবনা না হওয়ায় হলের মুদি দোকানের পরিচালক বদলে দেওয়া, অনৈতিক সুবিধা নিয়ে হলের ওয়াইফাই প্রোভাইডার বদলে দেওয়া, নিজস্ব কর্মিবাহিনী তৈরি করে হাতেগোনা কয়েকজন দিয়ে পুরো রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করা, অন্য নেত্রীদের সঙ্গে খারাপ আচরণ করা, অন্য নেত্রীদের বহিষ্কারের হুমকি-ধমকি, মেয়েদের আপত্তিকর ছবি তুলে তা ছড়িয়ে দেওয়ার হুমকি দেওয়াসহ বিস্তর অভিযোগ রিভা-রাজিয়ার বিরুদ্ধে। তবে বরাবরই শিরোনামে রিভার নাম উঠে এলেও অনৈতিক সব সুবিধারই সমান ভাগ পায় রাজিয়া গ্রুপও। ইডেন কলেজ ছাত্রলীগের নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা যায়, রিভা কিছুটা উগ্র মেজাজের হলেও রাজিয়া বেশ কৌশলী। যে কারণে রাজিয়া কিছুটা অন্তরালে।

আর এসব নিয়ে গণমাধ্যমে বক্তব্য দেওয়ায় রবিবার সহসভাপতি জান্নাতুল ফেরদৌসকে মারধর করে রিভা-রাজিয়া। পরে দুই গ্রুপের সংঘর্ষ বাধে। সংঘর্ষের পর রিভা-রাজিয়াকে মারধর করে বের করে দেয় বিদ্রোহীরা। পরে রবিবার রাতে ইডেন কলেজ শাখা ছাত্রলীগের কমিটি স্থগিত করে দেয় কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ। পাশাপাশি সাংগঠনিক শৃঙ্খলাভঙ্গের অভিযোগে বিদ্রোহী ১৬ জনকে স্থায়ীভাবে বহিষ্কার করা হয়। বহিষ্কৃৃতরা হলেন- সহসভাপতি সোনালি আক্তার, সুস্মিতা বাড়ৈ, জেবুন্নাহার শিলা, কল্পনা বেগম, জান্নাতুল ফেরদৌস, আফরোজা রশ্মি, মারজানা ঊর্মি, সানজিদা পারভীন চৌধুরী, এসএম মিলি, সাদিয়া জাহান সাথী, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ফাতেমা খানম বিন্তি, সাংগাঠনিক সম্পাদক সামিয়া আক্তার বৈশাখী এবং কর্মী রাফিয়া নীলা, নোশিন শার্মিলী, জান্নাতুল লিমা ও সূচনা আক্তার।

গতকাল সকালে সংবাদ সম্মেলন করে বহিষ্কৃত নেতাকর্মীরা। ‘বিনা তদন্তে বহিষ্কার, নেপথ্যে কারা’ শিরোনামের সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পড়ে শোনান বহিষ্কৃত সহসভাপতি সুস্মিতা বাড়ৈ ও সাংগঠনিক সম্পাদক সামিয়া আক্তার ওরফে বৈশাখী। বক্তব্যের প্রথম অংশ পড়ে শোনান সুস্মিতা। এতে বলা হয়, ‘প্রাথমিক তদন্তে বহিষ্কার বিষয়টি আমাদের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ ঘটায়। নির্যাতনের শিকার সহযোদ্ধার পাশে দাঁড়ানোর অপরাধে আজ আমাদের স্থায়ী বহিষ্কার করা হয়েছে। ইডেন কলেজ শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি তামান্না জেসমিন ও সাধারণ সম্পাদক রাজিয়া সুলতানার বিরুদ্ধে বিস্তর অভিযোগ ও হাজার হাজার প্রমাণ আছে। তাদের চাঁদাবাজির ভিডিও, ইডেন কলেজের অধ্যক্ষকে নিয়ে কটূক্তিসহ বিস্তর অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও তাদের কেন বহিষ্কার করা হলো না? কোন তদন্তের ভিত্তিতে আমাদের ছাত্রলীগ থেকে স্থায়ী বহিষ্কার করা হলো?’

লিখিত বক্তব্যের দ্বিতীয় অংশ পড়ে শোনান সামিয়া আক্তার। এতে বলা হয়, দুপক্ষের সংঘর্ষে শুধু একটা পক্ষকে কেন গণহারে স্থায়ী বহিষ্কার করা হলো? ছাত্রলীগের বিভিন্ন ইউনিটে কোনো সমস্যা হলে তার তদন্ত বা সমাধানের জন্য কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়। আমাদের ক্ষেত্রে সেই নিয়ম না মেনে কেন সরাসরি স্থায়ী বহিষ্কার করা হলো? সংবাদ সম্মেলনে আমরা ২১ নেত্রী উপস্থিত ছিলাম। সেখান থেকে ১২ জনকে কেন বহিষ্কার করা হলো? আমাদের বহিষ্কারাদেশ অবিলম্বে প্রত্যাহার করতে হবে। আমাদের একমাত্র অভিভাবক দেশরত্ন শেখ হাসিনার হস্তক্ষেপ কামনা করছি। যদি এই ভিত্তিহীন বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করা না হয়, আমরা সবাই এর সুষ্ঠু বিচার না হওয়া পর্যন্ত আমরণ অনশন করব।

সংবাদ সম্মেলন শেষে দুপুরের দিকে ধানমন্ডিতে আওয়ামী লীগ সভাপতির রাজনৈতিক কার্যালয়ে যান বহিষ্কৃতরা। সেখান থেকে বেরিয়ে জানান, এখন আর তারা অনশন করবেন না। বহিষ্কৃত সহসভাপতি জান্নাতুল ফেরদৌস বলেন, ‘আমরা বিষয়গুলো বড় ভাইদের জানাতে এসেছিলাম। জানিয়ে এখন চলে যাচ্ছি। সমস্যা সমাধানে তারা দায়িত্ব নিয়েছেন। আমরা কোনো অনশনে নেই। আমাদের কোনো কর্মসূচি নেই।’ তবে ভেতরে কার সঙ্গে তারা আলোচনা করেছেন, সে ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট করে কিছু বলেননি তিনি।

রিভা-রাজিয়ার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেওয়ার বিষয়ে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সহসভাপতি সোহান খান বলেন, সুষ্ঠু তদন্তসাপেক্ষে তাদের বিচার হলে এমন সংঘর্ষ হতো না। বিচার না হওয়ায় তারা আরও বেপরোয়া হয়ে যান। কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সভাপতি-সম্পাদকের কাছের লোক হওয়ায় তারা পার পেয়ে গেছেন। সর্বশেষ ঘটনায়ও একটি অংশের ১৬ জনকে বহিষ্কার করা হলো। অথচ রিভা-রাজিয়ার কিছু হলো না। এ ধরনের ঘটনা আমাদের নারী শিক্ষার্থীদের ছাত্র রাজনীতিবিমুখ করবে।

এ বিষয়ে কথা বলার জন্য আল নাহিয়ান খান জয় ও লেখক ভট্টাচার্যকে ফোন দেওয়া হলেও তারা ফোন ধরেননি। তবে বহিষ্কারের বিষয়ে গণমাধ্যমকে লেখক ভট্টাচার্য বলেন, ‘আগের ঘটনা এবং রবিবারের ঘটনার ফুটেজ দেখে আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি। তারা তদন্ত কমিটি মানতে চায় না। তাই আমরা নিজেরা ভিডিও ফুটেজ দেখে যাদের সরাসরি সংশ্লিষ্টতা পেয়েছি, তাদের আপাতত বহিষ্কার করেছি। এ ছাড়া কলেজ প্রশাসন তদন্ত কমিটি করেছে। তারা তাদের মতো করে জানাবে।’ লেখক আরও বলেন, ‘তারা সংবাদমাধ্যমে যে ধরনের অভিযোগ করেছে, তার একটিরও প্রমাণ দেখাতে পারেনি।’

ছাত্রলীগের দেখভালের দায়িত্বে রয়েছেন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম। ইডেন কলেজ ছাত্রলীগের লাগাতার পরিস্থিতির বিষয়ে তিনি বলেন, ‘এখানে দীর্ঘদিন ধরে যা চলছে, তা খুবই হতাশাজনক। এটা তো আমরা প্রত্যাশা করি না। তবে এই অপ্রীতিকর পরিস্থিতির বিপরীতে তো অ্যাকশন শুরু হয়ে গেছে। তদন্ত চলছে; আরও কেউ দোষী হলে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

সূত্র: আমাদের সময়
আইএ/ ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২২

Back to top button