জাতীয়

আল্লামা আহমদ শফীকে হারানোর দুই বছর

আহমাদ জামিল

চট্টগ্রামের, ১৮ সেপ্টেম্বর – হেফাজত ইসলাম বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা আমির ও চট্টগ্রামের আল-জামিয়াতুল আহলিয়া দারুল উলুম মঈনুল ইসলাম হাটহাজারী মাদ্রাসার দীর্ঘদিনের মহাপরিচালক আল্লামা শাহ আহমদ শফীর দ্বিতীয় মৃত্যুবার্ষিকী আজ। ২০২০ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর রাজধানী ঢাকার আজগর আলী হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেছিলেন তিনি।

এর একদিন আগে আগে হাটহাজারী মাদ্রাসায় আল্লামা শফীর পুত্র মাওলানা আনাস মাদানী এবং তার অনুসারীদের অনিয়মের অভিযোগ তুলে মাদ্রাসার কিছু ছাত্র আল্লামা শফীকে অবরুদ্ধ করে বিক্ষোভ করে। দুই দিনের বিক্ষোভের পর ১৭ সেপ্টেম্বর রাতে হাটহাজারী মাদ্রাসার শূরা কমিটির সভায় মাদ্রাসার পরিচালকের পদ থেকে সরে দাঁড়াতে হয় তাকে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, আল্লামা শাহ আহমদ শফীর মৃত্যু পরবর্তী সময়ে দেশের কওমি আলেমদের মধ্যে নেতৃত্ব সংকট সৃষ্টি হয়েছে। এরপর থেকে কওমি আলেমদের মধ্যে ‘চেইন অব কমান্ড’ বলতে আর কিছু থাকেনি। কয়েকটি ভাগে স্থায়ীভাবে বিভক্ত হয়ে পড়েছেন তারা।

আল্লামা আহমদ শফী এ দেশের মুসলিম জনমানসে একবিংশ শতাব্দীর বিস্ময়। দীর্ঘ ৩৪ বছর ধরে একাধারে দারুল উলুম হাটহাজারীর মহাপরিচালকের পাশাপাশি শায়খুল হাদিসের দায়িত্ব পালন করেছেন।

কওমি মাদ্রাসার সর্বোচ্চ শিক্ষা বোর্ড বেফাকের চেয়ারম্যান, হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের আমীরসহ এক কথায় কওমি অঙ্গনের এক সর্বেসর্বা বলিষ্ঠ নেতৃত্ব ছিলেন তিনি। বটবৃক্ষের মতো এ দেশের আলেমদের আগলে রেখে পিতৃছায়া দিয়েছিলেন।

কওমি মাদ্রাসাকে নিয়ে গিয়েছিলেন এক অনন্য উচ্চতায়। আলেম সমাজ ও রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে হাজারও বিরোধের মাঝেও কেউ তার ভয়ে কখনো মুখ খোলার কিংবা আগবাড়িয়ে কিছু করবার দুঃসাহস করতেন না। তিনি ছিলেন ঐক্যের সর্বোচ্চ কাণ্ডারি।

শত বছর পার হলেও ফজর নামাজের পর থেকে মধ্যরাত অবধি হাদিসের পাঠদান, দেশব্যাপী সফর করতেন, যা ছিল রীতিমতো এক বিস্ময়কর ব্যাপার।

তিনি ছিলেন ব্রিটিশ বিরোধি আন্দোলনের অগ্রদূত শাইখুল ইসলাম হজরত মাওলানা হোসাইন আহমদ মাদানীর (রহ.) অন্যতম খলিফা।

বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে বেশি গ্রহণযোগ্য ও সর্বজন শ্রদ্ধেয় আলেমেদীন। শেষ দিন পর্যন্ত তিনি আল হাইয়াতুল উলইয়া লিল জামিয়াতিল কওমীয়া বাংলাদেশ ও কওমী মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড (বেফাক)-এর চেয়ারম্যান, দারুল উলুম মুঈনুল ইসলাম হাটহাজারী মাদ্রাসার মহাপরিচালক এবং বহুল আলোচিত সংগঠন হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের আমীর হিসেব দায়িত্ব পালন করেছিলেন।

আল্লামা শাহ আহমদ শফীকে শুধুমাত্র এরকম দু-চারটি প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান, পরিচালক বা আমীর হিসেবে পরিচয় করে দেয়া হবে মারাত্মক ভুল বরং তিনি ছিলেন- এদেশের লক্ষ কোটি ধর্মপ্রাণ মানুষের আস্থা ও বিশ্বাসের কেন্দ্রবিন্দু।

তিনি চলে গেছেন না ফেরার দেশে। এক বুক বেদনা, এক রাশ ঘৃণা আর আর কতগুলো অব্যক্ত যন্ত্রণা নিয়েই বিদায় জানিয়েছেন মাটির পৃথিবীকে।

যে প্রতিষ্ঠানটির জন্য তিলে তিলে নিজেকে ক্ষয় করেছেন। আলো জলমল কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়েছে যার জন্য। ভরা যৌবন তো বটেই বাধ্যর্কের বিছানায় পড়া সময়গুলোতেও যে প্রতিষ্ঠানটির চিন্তায় থাকতেন উদ্বিগ্ন। সেটি দারুল উলূম মুঈনুল ইসলাম হাটহাজারী মাদ্রাসা।

ষড়যন্ত্র হয়েছে তাকে তার প্রিয় প্রতিষ্ঠান থেকে বিচ্ছিন্ন করার জন্য। তার গায়ে মিথ্যা তকমা এটে দেয়া হয়েছে যেন তিনি চলে যান এখান থেকে। কিন্তু অসীম ধৈর্য ও সহিষ্ণুতার পরিচয় দিয়ে তিনি তার প্রিয় মাদ্রাসাটিকে বুকে আগলে রেখেছিলেন পরম মমতায়।

তার ইচ্ছে ছিল শেষ দিনটিতেও তিনি তার যত্নে গড়া এই বাগানটির পরিচর্যার দায়িত্ব পালন করবেন। এখানে ফুলের ঘ্রান নেবেন ফলের স্বাদ উপভোগ করবেন।

কিন্তু সর্বশেষ ২০২০ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর একটি মহলের উসকানিতে ছাত্র আন্দোলনের নামে তার স্বপ্নের জায়গাটিতে যা হল তা কোনদিনও তিনি ভাবেননি।

কতটা কষ্টে! তিনি নিজেই অব্যাহতি নিলেন মাদরাসার মহাপরিচালকের পদ থেকে অব্যাহতি দিলেন ছেলে আনাস মাদানীকেও। সঙ্গে সঙ্গে যেন চির অব্যাহতিও নিয়ে নিলেন অমানবিক ও অকৃতজ্ঞ এ চারণভূমি থেকে।

সেদিন রাতেই তাকে ফায়ার সার্ভিসের একটি অ্যাম্বুলেন্সে করে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের আইসিইউতে ভর্তি করা হয়। সেখানে শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে পরদিন শুক্রবার সন্ধ্যার আগে এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে তাকে ঢাকার আজগর আলী হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়।

শুক্রবার সন্ধ্যায় সোয়া ৬ টায় সেখানেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। ইন্নাল্লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন।

মূলত, হজরত উসমান (রা.) এর শাহাদাতের পর ইসলামী খেলাফতে যেমন বিশৃঙ্খলা ও প্রকাশ্য নৈরাজ্য শুরু হয়েছিল। শাইখুল ইসলাম আল্লামা আহমদ শফীর মৃত্যুর পরও এ দেশের কওমি আলেমরা দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়েছে।

২০২০ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর হাটহাজারী মাদ্রাসায় শুরু হয় কথিত ছাত্র আন্দোলন। সেদিনের বিক্ষোভে শায়খুল ইসলামের কার্যালয় ভাঙচুর, অপমান আর মানসিক নির্যাতনের ভিডিও ফুটেজ এখনো নেট দুনিয়ায় ঘুরছে।

শায়খুল ইসলামের মর্মান্তিক মৃত্যুর পর এ দেশের আলেম সমাজ ও কওমি মাদ্রাসাগুলোর ওপর নেমে আসে মুসিবতের পাহাড়সম মেঘ। অনেককে ভুগতে হচ্ছে লাঞ্ছনা, নির্যাতনে। মাদ্রাসা মাদ্রাসায় চলছে অস্থিতিশীলতা।

এদিকে হেফাজতে ইসলামের প্রতিষ্ঠাতা আমির আল্লামা আহমদ শফী হত্যা মামলার ধীরগতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন দেশের সচেতন আলেমরা।

বাংলাদেশ কওমি মাদ্রাসা শিক্ষক সমিতিসহ কয়েকটি সংগঠনের বিবৃতিতে বলা হয়, আল্লামা আহমদ শফীকে যেভাবে হাটহাজারী মাদ্রাসার কক্ষে নির্যাতন করা হয়েছিল এবং তার রুমের আসবাবপত্র ভাঙচুর করে তছনছ করা হয়েছিল সেটি দেশের সবাই দেখেছে। অক্সিজেন মাস্ক খুলে নেওয়াসহ আল্লামা শফীর সঙ্গে অমানবিক আচরণের করুণ দৃশ্য বিভিন্ন মিডিয়ায় এসেছে। এ বিষয়ে তার ভক্তবৃন্দ প্রতিবাদও জানিয়েছিলেন। আমরাও সঠিক তদন্ত করে এই হত্যার সঙ্গে যারা জড়িতদের অনতিবিলম্বে আইনের আওতায় আনার জন্য সরকারের আমরা জোর দাবি জানিয়েছিলাম।

নেতারা প্রশ্ন রেখে বলেন, যারা আগে আহমদ শফী হত্যার বিচার চেয়েছিল তারা এখন নিশ্চুপ কেন? হঠাৎ কিছুদিন সরব থেকে এখন তারা নীরব কেন?

বিবৃতিতে বলা হয়, আমাদের দাবি অত্যন্ত যৌক্তিক ও স্পষ্ট। আমরা শুরু থেকেই বলেছি এশিয়া মহাদেশের শ্রেষ্ঠ আলেম আল্লামা আহমদ শফী ছিলেন বড় মাপের আলেম ও আধ্যাত্মিক জ্ঞানী ব্যক্তিত্ব। তাকে যে কিছু দৃষ্কৃতকারী রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের জন্য শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করে হত্যা করেছে সেটি পিবিআইয়ের তদন্তেও উঠে এসেছে। আমরা অনতিবিলম্বে এই হত্যাকারীদের বিচার দেখতে চাই।

সূত্র: যুগান্তর
আইএ/ ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২২

Back to top button